ষাটের দশকে আমাদের দেশে অত্যাবশ্যকীয় পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচীর কাজ শুরু হয় ৷ পৃথিবীর যে দেশগুলোতে জনসংখ্যার ঘনত্ব বেশি সেখানে এই কর্মসূচী ব্যাপকভাবে গৃহীত হয়েছে ৷ কিন্তু এদেশে ফতোয়াবাজরা এই জনকল্যাণমূলক কর্মসূচীর বিরুদ্ধে সংগঠিত হয়ে 'আন্দোলন' শুরু করে ৷ ধর্মের দোহাই দিয়ে তারা ফতোয়া দেয় যে, পরিবার পরিকল্পনা ইসলামি অনুশাসন বিরোধী ৷ প্রতিক্রিয়াশীল ধর্মান্ধগোষ্ঠী তখন এই ফতোয়ার মাধ্যমে সরলপ্রাণ, ধর্মভীরু ও নিরক্ষর মানুষকে ক্ষেপিয়ে তোলার অপচেষ্টা করেছিল ৷ তখন মাঠপর্যায়ে পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচী বাস্তবায়ন করতে গিয়ে অনেকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত ও নির্যাতিত হয়েছে- এরকম খবর সেকালে সংবাদপত্রে পাওয়া যায় ৷
আদিমকালের মানবসভ্যতায় মাতৃতান্ত্রিক পরিবার প্রথাই প্রচলিত ছিল, বর্তমানে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু ক্ষুদ্র জাতিসত্তা ছাড়া আর কোথাও মাতৃতান্ত্রিক পরিবার প্রথা প্রচলিত নেই ৷ বাংলাদেশের পরিবার যেমন পিতৃতান্ত্রিক তেমনি সমাজও পুরুষতন্ত্রে শাসিত ৷ নারীরা এখানে পুরুষতন্ত্রের পক্ষপুটে লালিত ৷ তাই ফতোয়া কখনও নারীরা দেয় না, দেয় পুরুষরাই ৷ আর পুরুষশাসিত সমাজ বলেই অদ্যাবধি এদেশে সিংহভাগ ফতোয়া জারি করা হয়েছে নারীর বিরুদ্ধে ৷
প্রাচীনকাল থেকে আজতক নারী সমাজই ফতোয়াবাজির শিকার হয়েছে বেশি ৷ 'বেশি' মানে শতকরা একান্নভাগ নয়, নিরানব্বই ভাগ ৷ প্রাচীন ভারতীয় পুরাণ এবং দর্শনে নারী 'নরকের দ্বার' হিসেবে চিত্রিত হয়েছে ৷ বাংলাদেশে ফতোয়াবাজির পরিসংখ্যান নিলে দেখা যাবে, নারীবিরোধী ফতোয়াবাজির পরিমাণ যেমন ব্যাপক তেমনি বহুমাত্রিক ও বিচিত্র ৷ অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, 'নারী নরকের দ্বার' নয় ঠিকই, কিন্তু এদেশে নারীসমাজের জীবন নরকের দ্বারপ্রান্তে উপনীত ৷
একথা মিথ্যা নয় যে, বাংলাদেশের অধিকাংশ নারী এখনো 'অবরোধবাসিনী' ৷ সর্ববিধ কুসংস্কারাচ্ছন্নতা, আধুনিক শিক্ষাহীনতা এবং পুরুষতন্ত্রের শৃঙ্খলে তারা যেমন দৈহিকভাবে বন্দি তেমনি মানসিকভাবে বন্ধ্যা ৷ আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান-দর্শনের সকল আলোকরশ্মি থেকে এদেশের অধিকাংশ নারী বঞ্চিত বলে অচলা, অবলা এবং জড়প্রায় ৷ মধ্যযুগীয় পশ্চাত্পদ দর্শনে আস্থাশীল মৌলবাদী প্রতিক্রিয়াশীলরা এই নারীজাতিকে এখনও 'ভোগের সামগ্রী' বলে 'লৌহ্যবনিকার অন্তরালে' রাখতে চায় ৷ মৌলবাদ নারীকে শুধু অন্তরালে রাখে না, তাকে নির্যাতনও করে ৷ কারণ ধর্মান্ধতার ঘনীভূত রূপ মৌলবাদে বিকশিত, আর মৌলবাদের নির্যাতন-রূপ প্রকাশিত হয় ফতোয়াবাজিতে ৷ তাই ফতোয়াবাজরা ধর্মান্ধ মৌলবাদী গোষ্ঠীর কেবল দোসর নয়, উন্নত সংস্করণও ৷
শাসন করবার শক্তি, সাহস এবং ক্ষমতা যাদের আছে তারা আবার নির্যাতনও করে ৷ শাসক এবং নির্যাতক ক্ষমতাবানদের এই দুই রূপ ৷ সামন্ত সমাজে ফতোয়াবাজরা ক্ষমতাবানদেরই প্রতিভূ ৷ তাদের শাসন ও নির্যাতনের দাপট প্রধানত প্রয়োগ করা হয় নারীদের ওপর ৷ একদা শরত্চন্দ্র বাঙালীর শাসক ও নির্যাতক চরিত্র বর্ণনা করতে গিয়ে বিদ্রুপাত্মকভাবে বলেছিলেন :
'শুনিয়াছি না-কি বিলাত প্রভৃতি ম্লেচ্ছ দেশে পুরুষদের মধ্যে একটা কুসংস্কার আছে, স্ত্রীলোক দুর্বল এবং নিরুপায় বলিয়া তাহার গায়ে হাত তুলিতে নাই ৷ এ-আবার একটা কি কথা! সনাতন হিন্দু এ সংস্কার মানে না ৷ আমরা বলি, যাহারই গায়ে জোর নাই, তাহারই গায়ে হাত তুলিতে পারা যায় ৷ তা সে নর-নারী যাই হোক না কেন ৷" ('বিলাসী')
সন্দেহ নেই যে, এদেশে নারীনির্যাতনের মূল প্রক্রিয়া ফতোয়াবাজির মধ্যে নিহিত ৷ লক্ষণীয় যে, বাংলাদেশে নারীবিরোধী ফতোয়াবাজি উত্থানের ইতিহাস দীর্ঘ হলেও বিগত বিশ শতকের শেষ দশক (১৯৯০-২০০০) এবং একুশ শতকের বর্তমান সময় পর্যন্ত নারীবিরোধী ফতোয়াবাজি সংক্রামক ব্যাধির মত ক্রমবিস্তারশীল ৷
বাংলাদেশে কেবল ব্যক্তি-নারীই যে ফতোয়াবাজির শিকার হয়ে নির্যাতিত হয়েছে বা মর্মান্তিক মৃত্যুবরণ করেছে, এমন নয় ৷ এদেশে নারীরা সমষ্টিগতভাবেও ফতোয়া দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে ৷ বাঙালী মুসলিম নারী জাগরণের অগ্রদূত বলে যিনি খ্যাত, সেই মহীয়সী নারী বেগম রোকেয়ার সমকালে সামষ্টিক নারী নির্যাতনের বিস্তৃত প্রেক্ষাপট ও প্রকৃতি আলোচনা না করেও বলা যায়, এস. ওয়াজেদ আলীর ভাষায়, 'সেই ট্রাডিশন সমানে চলেছে ৷বর্তমান একুশ শতকেও এদেশে অন্তত গ্রামবাংলার নারীরা ফতোয়ার বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত এবং এমন কি নাগরিকের অন্যতম অধিকার ভোট প্রয়োগ থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে ৷
পাক ঔপনিবেশিক আমলে '৫৭ সনে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী সময় থেকে বিশেষভাবে এই রাজনৈতিক ফতোয়াবাজি চলে আসছে৷ বর্তমান সময়ে লক্ষ করা যাচ্ছে ছোট থেকে বড়, সব ধরনের ফতোয়াবাজ পীর-হুজুর, মোল্লা-ইমামরা রাজনৈতিক সমাবেশ থেকে ধর্মীয় মাহফিল, এমন কি মাদ্রাসা-মসজিদে পর্যন্ত ফতোয়াবাজি করে চলেছে ৷ সামপ্রতিককালে পত্র-পত্রিকায় চোখ বুলালেই লক্ষ্য করা যায়, ধর্মের ধ্বজাধারী এই ফতোয়াবাজ রাজনীতিকরা ধর্মপ্রাণ সরল মানুষদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে এই বলে যে, অমুক দলে ভোট দিলে 'জারজ সন্তান', তমুক মার্কায় ভোট দিলে 'কাফের' হয়ে যাবে ইত্যাদি ৷
প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতির হীনস্বার্থে ধর্মান্ধ মৌলবাদীরাই যে কেবল ফতোয়াবাজি করে এমন নয়৷ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তির দাবিদার রাজনীতিবিদরাও নারীবিরোধী ফতোয়াবাজিতে কম পারঙ্গম নয় ৷ প্রসঙ্গত উল্লেখ যে, ২০০০ সালের ১লা জানুয়ারী মিলেনিয়াম উত্সব পালনকালে গভীররাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে বাঁধন নামে এক তরুণী একদল সন্ত্রাসী কর্তৃক দৈহিক নিপীড়নের শিকার হয়েছিল ৷ এই ঘটনা নিয়ে আওয়ামী লীগের সাংসদ জয়নাল হাজারী 'বাঁধনের বিচার চাই' শিরোনামে একটি বই লিখেছেন ৷ সেই বইয়ে সাংসদ নারীদের পোশাক-পরিচ্ছদ, চলাফেরা এবং নারীস্বাধীনতার বিরুদ্ধে যেসব আপত্তিকর কথাবার্তা লিখেছেন, তা ফতোয়াবাজিরই নামান্তর ৷ সে-বইয়ে নারীদের তিনি নতুন করে 'অবরোধবাসিনী' করে তোলার অপপ্রয়াস চালিয়ে ছিলেন ৷
চলবে.........