কমলকুমার মজুমদারের অন্তর্জলি যাত্রা উপন্যাস, প্রভাতকুমারের পুঁইমাচা গল্প এবং শরত্চন্দ্রের অরক্ষণীয়াসহ বহু কথাসাহিত্যে তত্কালীন হিন্দু সমাজের নাবালিকা বিবাহপ্রথার নিষ্করুণ কাহিনী বর্ণিত হয়েছে ৷ আসলে অরক্ষণীয় প্রথাও ব্রাহ্মণ্যবাদী সমাজপতিদের ধর্মের নামে প্রদত্ত ফতোয়াবাজি ছাড়া অন্য কিছু নয় ৷ শরত্চন্দ্রের 'বিলাসী' গল্পের বর্ণিত 'অন্নপাপ' কি ফতোয়াবাজি নয়? ঐ গল্পে সাপের দংশনে মৃত্যুঞ্জয়ের অকাল মৃত্যু সম্পর্কে সমাজপতি খুড়া বলছে :
"গ্রামটা এবার রসাতলে গেল ৷... অকালকুষ্মাণ্ডটা একটা সাপুড়ের মেয়ে নিকা করিয়া ঘরে আনিয়াছে ৷ আর শুধু নিকা নয়, তাও না হয় চুলায় যাক, তাহার হাতে ভাত পর্যন্ত খাইতেছে ৷... পুরুষ মানুষ অমন একটা ছেড়ে দশটা করুক না, তাতে তো তেমন আসে যায় না, না হয় একটু নিন্দাই হত ৷ কিন্তু হাতে ভাত খেয়ে মরতে গেলি কেন?... অন্নপাপ ৷ বাপরে! এর কি আর প্রায়শ্চিত্ত আছে?"
সবর্ণ বিবাহপ্রথার বিরুদ্ধে অসবর্ণ বিয়ে বর্ণাশ্রমবাদী বাঙালী হিন্দু সমাজে এক বিপ্লবাত্মক ঘটনা ৷ এই অসবর্ণ বিবাহপ্রথার বিরুদ্ধেও তখন কম ফতোয়াবাজি হয়নি ৷ বর্তমানে সেই অসবর্ণ বিয়েতে কোন কোন ধর্মবেত্তা যাজক ব্রাহ্মণদের 'অনুলোম-প্রতিলোম' বিচার ফতোয়াবাজির নতুন সংস্করণ বলে মনে হয় ৷ 'অপাংক্তেয়' শব্দটির অর্থ একালে যদিও পরিবর্তিত হয়ে গেছে, তবু এককালে শব্দটির অর্থ ছিল যারা একই সারিতে বসে ভোজনের উপযুক্ত নয় ৷ সেকালে বর্ণাশ্রম প্রথার কারণে তথাকথিত নিম্নবর্ণের হিন্দুরা ব্রাহ্মণদের সঙ্গে একই পংক্তিতে বসে ভোজন করতে পারতো না ৷ এখনো বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে এই ফতোয়াবাজি প্রচলিত আছে ৷
তবে সমাজ বিকাশের গতিধারা ও ইতিহাসের দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করলে দেখা যায়, আধুনিক ইংরেজি শিক্ষা, মুক্তবুদ্ধির চর্চা এবং সংস্কৃতিগতভাবে উনিশ শতকের বাঙালী হিন্দু নাগরিক মধ্যবিত্ত শ্রেণী সমসাময়িক মুসলিম সমাজের চেয়ে অগ্রসর ৷ ধর্মীয় বাধ্যবাধকতা হিন্দু সমাজে একালে অপেক্ষাকৃত কম বলে ফতোয়াবাজির ক্ষতিকর প্রভাব এখন নগণ্য ৷ পক্ষান্তরে বাঙালী মুসলিম সমাজের ধর্মীয় বাধ্যবাধকতা ও আচরণবিধি অবশ্য পালনীয় বলে এবং বিশেষভাবে বিদ্যাবঞ্চিত গ্রামীণ সমাজে অনুদার যুক্তিহীনতা ও ধর্মভীরুতার সারল্যের সুযোগে ফতোয়াবাজির প্রকোপ বেশি ৷
এখনও গ্রামবাংলায় মধ্যযুগীয় ক্ষয়িষ্ণু সামন্তবাদের অবশেষ-প্রতিভূরা এবং মাদ্রাসায় সামান্য ধর্মীয় শিক্ষা-প্রাপ্তরা রাজত্ব করছে ৷ একদলের আছে জমি-জিরেত, অন্যদলের মাজার-মক্তব ৷ এদের যৌথ প্রয়াসে শিক্ষার আলোহীন গ্রামের সরলপ্রাণ মানুষের জীবন নিয়ন্ত্রিত ৷ মোল্লাতন্ত্র যত্সামান্য আরবী শিক্ষার জোরে পবিত্র ধর্মকে অপব্যাখ্যায় কলুষিত করছে ৷ ফতোয়াবাজি সেই অশিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত ও শ্রেণীস্বার্থপর গ্রাম্য মোড়ল-মুন্সি এবং তাদের দোসর টাউট-বাটপারদের গণবিরোধী অপতত্পরতার সাক্ষ্য ৷
ধর্মনির্বিশেষে ফতোয়াবাজি মাত্রই মানবতা ও শুভবুদ্ধি বিরোধী, ধর্মের যুক্তিহীন অপব্যাখ্যা এবং শিক্ষাবঞ্চিত সংখ্যাগরিষ্ঠ দরিদ্রজনগোষ্ঠীকে নির্যাতনকারী প্রক্রিয়া ৷ তবে আলোচনার সুবিধার্থে এবং এর স্বরূপ উন্মোচনের লক্ষ্যে ফতোয়াবাজিকে মোটাদাগে কয়েকটি শ্রেণীতে বিভাজন করা যায় ৷
যেমন :
প্রগতিশীল রাজনীতি-বিরোধী ফতোয়াবাজি; শিক্ষা-শিল্প-সংস্কৃতি-বিরোধী ফতোয়াবাজি; নারীবিরোধী ফতোয়াবাজি; ধর্মের অনুশাসন ব্যাখ্যায় ফতোয়াবাজি; রাজনীতিকদের ফতোয়াবাজি; বিচিত্র ধরনের ফতোয়াবাজি ৷
ফতোয়াবাজি প্রতিক্রিয়াশীলতার একটি উপসর্গ ৷ ধর্মের নামে অন্ধত্ব, পশ্চাত্পদতা, মধ্যযুগীর ধ্যানধারণার বশবর্তী কূপমণ্ডূকতা এবং সকল ধরনের প্রগতিবিরোধী প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ অপতত্পরতাই ফতোয়াবাজদের লক্ষ্য ৷ তাই সমসাময়িক কালচেতনার মানদণ্ডে অপেক্ষাকৃত প্রগতিশীল রাজনীতি ও রাজনীতিকরা সর্বদা ফতোয়াবাজদের আক্রমণের শিকার হয়েছেন ৷
ফতোয়া দ্বারা মুক্তবুদ্ধির চেতনা, প্রগতিশীল রাজনীতি এবং সংস্কারমুক্ত দর্শন যেমন আক্রান্ত হয়েছে তেমনি রাজনৈতিক দল ও রাজনীতিবিদরা, যাঁরা প্রাগ্রসর জীবনদর্শনে বিশ্বাসী, ফতোয়াবাজদের কালোহাতের থাবা থেকে রেহাই পাননি ৷
একথা কারও অজানা নয় যে, চুয়ান্ন সালে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনের সময় এদেশের বহু মুফতি-মৌলানা-পীরেরা ফতোয়া দিয়েছিল : যুক্তফ্রন্টের প্রার্থীকে ভোট দিলে মুসলমানিত্ব খারিজ হয়ে যাবে ৷ শুধু তা-ই নয়, আরও আপত্তিকর ও কুরুচিপূর্ণ ফতোয়া দিয়েছিল যে, স্ত্রী পর্যন্ত তালাক হয়ে যাবে ৷ ষাটের দশকে স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ফাতেমা জিন্নাহ যখন প্রার্থী হয়েছিলেন তখনও এরকম ফতোয়া জারি করা হয় ৷
কিন্তু আমাদের কথা এই যে, এদেশের ধর্মপ্রাণ সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ এরকম রাজনৈতিক ফতোয়াবাজিতে বিভ্রান্ত হয়নি ৷ তাছাড়া 'ইসলামে নারীনেতৃত্ব নাজায়েজ' বলে ফতোয়া দিয়ে ধর্মান্ধ রাজনৈতিক দলের শঠ নেতারা এদেশে দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক স্বার্থ উদ্ধারের অপচেষ্টা করে আসছে ৷ যোগ্যতা ও জনপ্রিয়তায় যখন এদেশে নারীনেতৃত্ব অগ্রগতি লাভ করে এবং নির্বাচন হয় আসন্ন তখনই নারীনেতৃত্ব বিরোধী কুত্সাপ্রবণ ফতোয়ার ব্যাপকতা লক্ষ্য করা যায় ৷
চলবে........