somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রাসায়নিক অস্ত্র এবং গ্যাস মাস্কের জানা অজানা

২০ শে মে, ২০১৬ সকাল ৮:৩৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


রাসায়নিক অস্ত্র সম্পর্কে আমরা এখন মিডিয়ার কল্যানে অনেক কিছুই জানি।সিরিয়ায় রাসায়নিক অস্ত্রের ব্যাবহার এবং পাল্টাপাল্টি অভিযোগের কারণেই হয়ত মিডিয়ায় বারবার শুনছি।এই রাসায়নিক অস্ত্রের ব্যাবহার বিস্তরভাবে প্রথম চোখে আসে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে।

কিন্তু এর ব্যাবহার কি বিংশ শতাব্দী তেই শুরু?

না। আমাদের পূর্বেও এর ব্যবহার করেছে মানুষ ক্ষমতা দখল বা রক্ষায়।

এর শুরু মধ্যযুগে।

যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতির ফলে যোদ্ধা কমে আসায় মধ্যযুগ থেকে অনেক অধিপতির মনে আধিপত্য বিস্তারের নতুন পথ খুলে যায়, যাতে মানুষ কম লাগবে, কিন্তু শত্রুপক্ষকে সম্পূর্ণরূপে ঘায়েল করে ফেলা সম্ভব হবে। যুদ্ধ ক্ষেত্রে পাথর-কাঠ-লোহার অস্ত্রের জায়গা করে নেয় বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ; দাহ্য গ্যাস, বিষাক্ত গ্যাস, অম্লীয় দ্রবণ এবং বিভিন্ন প্রকারের বিষ যেগুলো শত্রুর কয়েক বংশ নির্বংস করে দিতে সক্ষম।

২৫৬ খৃষ্টাব্দে সিরিয়া আক্রমনে এসে রোমান সৈন্য বাহিনীর ১৯ জন সৈন্য দেয়ালের নিচে সুরঙ্গ খনন শুরু করে এবং সুরঙ্গের মধ্যে প্রায় সব সৈন্যই মারা যায়। ২০০৯ সালে প্রাপ্ত কঙ্কালগুলোর উপর রাসায়নিক পরীক্ষা চালিয়ে দেখা যায় সৈন্যদের মৃত্যুর মূল কারন বিটুমিন ও সালফারের মিশ্রণে তৈরি একপ্রকার বিষাক্ত ধোঁয়া যা তৎকালীন পারস্য বাহিনী খোদাই করা সুরঙ্গের মুখে প্রয়োগ করে এবং তা বহুল পরিমান রোমান সৈন্যের মৃত্যুর কারন হয়।



বিংশ শতাব্দীতে রাসায়নিক অস্ত্র:

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মান বাহিনী প্রথমবারের মতো বেলজিয়ামের এইপার শহরে নতুন নতুন ভয়ঙ্কর সব অস্ত্র ব্যবহার করেছিল। তারা ১৯১৫ সালের ২২ এপ্রিলে সর্বপ্রথম বিষাক্ত ক্লোরিন গ্যাস ব্যবহার করে মিত্রবাহিনীর হাজার হাজার সেনাকে হত্যা করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে রাসায়নিক অস্ত্রের ব্যবহারের ফলে পঁচাশি হাজারেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল এবং দশ লক্ষাধিক মানুষ আহত হয়েছিল।
কিছুকাল পরে তারা বিষাক্ত ফসজেন প্রয়োগ করে ব্রিটিশ বাহিনীর ওপর।

গ্যাস মাস্ক আবিষ্কার:

জার্মান রাসায়নিক আক্রমনে চিন্তায় পড়ে যায় মিত্রবাহিনী ও শত্রু বাহিনীরা । খুঁজতে থাকে আত্মরক্ষার উপায়। বিজ্ঞানী জেমস বার্ট গার্নার আবিষ্কার করেন একটি সাধারণ গ্যাস মাস্কে যদি চারকোল তথা কয়লা পোরা হয়, তাহলে তা ফিল্টার হিসেবে কাজ করবে। গার্নারের এ উদ্ভাবন মিত্রবাহিনী পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে উপযোগী করে ফেলে। আবিষ্কৃত হয় নিরাপদ গ্যাস মাস্ক। ১৯১৭ সালে আমেরিকা যুদ্ধে যোগ দিলে গ্যাস মাস্ক পরিধান বাধ্যতামূলক হয়।

১৯২৩ সালে ইরাকের মুক্তিকামী সংগ্রামীদের দমন করার জন্যে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করার পর


সারিন গ্যাস::

ভয়ঙ্কর এই গ্যাস আবিস্কার হয়েছে হঠাৎ করেই। ১৯৩৮ সালে আইজি ফারবেন নামক একটি জার্মান কেমিক্যাল কোম্পানির তিন গবেষক শক্তিশালী কীটনাশক তৈরি করার চেষ্টা চালাচ্ছিলেন। কীটনাশক আবিষ্কার করতে গিয়ে তারা আবিষ্কার করে ফেললেন বিষাক্ত এ গ্যাস। পরে এই তিনজন গবেষকের নামেই গ্যাসটির নাম রাখা হয় সারিন। ১৯৩৯ সালের মাঝামাঝি জার্মান সেনাবাহিনীর অফিসাররা গ্যাসটিকে যুদ্ধক্ষেত্রে রাসায়নিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তাদের পরিকল্পনায় ৫০০ লিটার থেকে ১০ টন সারিন গ্যাসের উৎপানদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল। ভাগ্যিস ততদিনে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধটা শেষ হয়ে গিয়েছিল বলে তারা আর সারিন গ্যাস ব্যবহারের সুযোগ পায়নি।

রাসায়নিক অস্ত্রের আরও কিছু ব্যবহার::

১৯৩০ এর দশকে ইথিওপিয়ার বিরুদ্ধে ইটালির যুদ্ধে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে চীন, ১৯৬৩ সালে ইয়েমেন এবং ভিয়েতনামের বিরুদ্ধে যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই রাসায়নিক অস্ত্র ব্যাপকভাবে ব্যবহার করেছে।

মার্কিন সেনারা ভিয়েতনাম যুদ্ধে আট কোটি লিটারেরও বেশি বিভিন্ন ধরনের বিষাক্ত রাসায়নিক দ্রব্য দেশটির বিভিন্ন শহর, ক্ষেত-খামার, জনগণ এবং বন-জঙ্গলের ওপর বর্ষণ করেছে। এইসব বিষাক্ত দ্রব্য পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি করা ছাড়াও ভিয়েতনামের লক্ষ লক্ষ মানুষকে আক্রান্ত করেছে। মার্কিন সরকার জাপানে পরমাণু অস্ত্র ব্যবহার করার মতো পাশবিক অপরাধের পর নতুন অপরাধ সংঘটিত করেছে ভিয়েতনাম যুদ্ধে। সেখানে তারা নিরীহ জনগণের ওপর রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করে। রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করেছিলেন সাদ্দাম হোসেন। ইরানের ওপর চাপিয়ে দেওয়া আট বছরের যুদ্ধে। ১৯৮০ সালে এই ন্যক্কারজনক যুদ্ধ চলাকালে ইরানের নিরীহ জনগোষ্ঠির ওপর সাদ্দাম বিষাক্ত রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করেছিল। এছাড়া সম্প্রতি সিরিয়ায় রাসায়নিক অস্ত্রের(সারিন গ্যাস) ব্যবহার নিয়ে কাদা ছোড়াছুড়ি চলছে।সরকার দাবী করছে এটা বিদ্রোহীদের কাজ আর বিদ্রোহীদের দাবি এটা সরকারের কাজ


অ্যান্টি গ্যাস মাস্ক গ্যাস(সারিন গ্যাস)::

উপরে সারিন গ্যাস সম্পর্কে আগেই আলোকপাত করেছি।সিরিয়ার সাম্প্রতিক গৃহযুদ্ধে সারিন গ্যাসের ব্যাবহারের প্রমাণ পাওয়া গেছে।
সারিন হচ্ছে একটি বিষাক্ত গ্যাস। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, সায়ানাইডের চেয়েও ২৬ গুণ বেশি মারাত্মক হচ্ছে সারিন গ্যাস। মাত্র ছোট্ট একটি পেরেকের আগার সমান এক ফোঁটা সারিন গ্যাসে মৃত্যু হতে পারে যে কোনো মানুষের। জাতিসংঘের নিরাপত্তা সনদ-৬৮৭-এ সারিন গ্যাসকে গণবিধ্বংসী রাসায়ানিক অস্ত্র হিসেবে তালিকায় রাখা হয়েছে।

বর্ণ বা গন্ধ কিছুই নেই সারিন গ্যাসের। আক্রান্ত হওয়া ছাড়া বোঝা যাবে না কেউ সারিন গ্যাসে আক্রান্ত হয়েছে। শরীরে নানান উপসর্গ দেখা দেয়ার পরেই বোঝা যাবে সারিন গ্যাসের উপস্থিতির কথা। এছাড়া জানার আর কোনো উপায় নেই সাধারণ মানুষের। সারিন গ্যাসের ভয়াবহতার কারণই এটা- বুঝতে না পারা। কিন্তু বোঝার পর আক্রান্ত এলাকা থেকে সরে যাওয়ার আগেই শরীরে যথেষ্ট পরিমাণে সারিন গ্যাস ঢুকে যায়। চিকিৎসা নিতে দেরি হয়ে যায়। যা হবার হয়ে যায় ততক্ষণে। তখন চিকিৎসা নিলেও কাজ হয় না। মানুষের শরীরে সারিন গ্যাস প্রবেশ করে মূলত নিঃশ্বাসের মধ্য দিয়ে। এছাড়া ত্বকের মধ্য দিয়েও ঢুকতে পারে। মানুষের শরীরে প্রায় দুই লাখের বেশি লোমকূপ রয়েছে। এগুলো দিয়েও সারিন গ্যাস ঢুকে পড়ে। ফলে গ্যাস মাস্ক ব্যবহার করলেও রেহাই মেলে না। আর আক্রান্ত হওয়ার আধঘণ্টা আগে কোনো উপসর্গই দেখা দেয় না। কাজেই ব্যবস্থা নিতে দেরি হয়ে যায়। সারিন গ্যাস আক্রান্তদের উপসর্গের মধ্যে রয়েছে- নাক দিয়ে পানি ঝরা, চোখে তারা দেখা, বুক শক্ত হয়ে আসা, নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া, শরীর অবশ হয়ে যাওয়া। এছাড়া আক্রান্ত কারো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ প্যারালাইসিসে আক্রান্ত হয়ে যেতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, যদি কারো শরীরে ২০০ মিলি সারিন গ্যাস প্রবেশ করলে কোনো উপসর্গ দেখা দেয়ার আগেই আক্রান্ত ব্যক্তি মারা যাবে। তাও আবার মাত্র মিনিটখানেকের মধ্যে। মারা যাওয়ার সময় সে বুঝতেই পারবে না কেন মরল।

শরীরে ঢুকেই ফুসফুসের পেশিকে অকার্যকর করে দেয় সারিন গ্যাস। আগে থেকে প্রতিষেধক দেয়া না থাকলে চিকিৎসা নেয়ার আগেই আক্রান্ত ব্যক্তি নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে ঢলে পড়বে মৃত্যুর কোলে। আর যারা সারিনের আঘাত সয়েও বেঁচে থাকবে তাদের ফুসফুস, চোখ আর স্নায়ুতন্ত্রের এমন ক্ষতি হবে, কখনো আর সারবে না। সারা জীবন পঙ্গু হয়ে বেঁচে থাকতে হবে। সারিন গ্যাস বাতাসের চেয়ে ভারি। আবহাওয়ার ওপর ভিত্তি করে আক্রান্ত এলাকায় ছয় ঘণ্টা পর্যন্ত থাকতে পারে। শুধু তাই নয়, এ গ্যাস খাবার ও পানিকেও দূষিত করে। ফলে সারিন গ্যাসের ক্ষতিকর প্রভাব অনেক দিন ধরে থাকতে পারে।

সর্বশেষ এডিট : ২০ শে মে, ২০১৬ সকাল ৮:৩৯
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

পার্বত্য চট্টগ্রাম- মিয়ানমার-মিজোরাম ও মনিপুর রাজ্য মিলে খ্রিস্টান রাষ্ট্র গঠনের চক্রান্ত চলছে?

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:০১


মিজোরামের মুখ্যমন্ত্রী লালদুহোমা সেপ্টেম্বর মাসে আমেরিকা ভ্রমণ করেছেন । সেখানে তিনি ইন্ডিয়ানা তে বক্তব্য প্রদান কালে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী chin-kuki-zo দের জন্য আলাদা রাষ্ট্র গঠনে আমেরিকার সাহায্য চেয়েছেন।... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাসান মাহমুদ গর্ত থেকে বের হয়েছে

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১১:১২


যুক্তরাষ্ট্রের একটি বাংলা টেলিভিশন চ্যানেল হাসান মাহমুদের সাক্ষাৎকার প্রচার করেছে। আমি ভাবতেও পারি নাই উনি এতো তারাতারি গর্ত থেকে বের হয়ে আসবে। এই লোকের কথা শুনলে আমার গায়ের লোম... ...বাকিটুকু পড়ুন

দারিদ্রতা দূরীকরণে যাকাতের তাৎপর্য কতটুকু?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১১:১৮



দরিদ্র দূরীকরণে যাকাতের কোনো ভূমিকা নেই।
যাকাত দিয়ে দারিদ্রতা দূর করা যায় না। যাকাত বহু বছর আগের সিস্টেম। এই সিস্টেম আজকের আধুনিক যুগে কাজ করবে না। বিশ্ব অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

শেখস্তান.....

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:১৫

শেখস্তান.....

বহু বছর পর সম্প্রতি ঢাকা-পিরোজপু সড়ক পথে যাতায়াত করেছিলাম। গোপালগঞ্জ- টুংগীপাড়া এবং সংলগ্ন উপজেলা/ থানা- কোটালিপাড়া, কাশিয়ানী, মকসুদপুর অতিক্রম করার সময় সড়কের দুইপাশে শুধু শেখ পরিবারের নামে বিভিন্ন স্থাপনা দেখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের বিয়ের খাওয়া

লিখেছেন প্রামানিক, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ২:৪৮


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

১৯৬৮ সালের ঘটনা। বর আমার দূর সম্পর্কের ফুফাতো ভাই। নাম মোঃ মোফাত আলী। তার বিয়েটা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। বাবা ছিলেন সেই বিয়ের মাতব্বর।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×