বাঁচো এবং বাঁচতে দাও’ প্রায়ই এমন একটা ফিলোসফিক্যাল কথা বলতেন তিনি। সহ-অভিনেতাদের কাছে তার দরাজ দিলের কথা শুনা যায়। নাট্যাঙ্গনে নাকি একটি কথা প্রচলিত ছিল যে, যদি টাকা লাগে তবে উনার কাছ থেকে ধার নাও। কারণ ফেরত দিতে হবে না। কাউকে টাকা দিলে তা নাকি বেমালুম ভুলে যেতেন। তাই কোনদিন ফেরতও চাইতেন না। একবার সেটে নাকি চঞ্চল চৌধুরীকে দুপুরের খাবারে ভর্তা দিয়ে ভাত খেতে দেখেছিলেন। চঞ্চলের ভর্তা পছন্দের কথা শুনে একদিন বাসায় নানা রকমের ভর্তা বানিয়ে তাঁকে আসতে বলেন। চঞ্চল তখন পাবনাতে। রাত দুইটায় তিনি ঢাকা ফিরলে ঐ রাতেই নাকি ফরিদীর বাসায় যেতে হয় দাওয়াত রক্ষা করতে। গিয়ে দেখেন প্রায় ৫০ রকমের ভর্তা সামনে করে বসে আছেন তিনি। আরেকবার নাকি হুতাপাড়া থেকে সূবর্ণার জরুরী ফোন পেয়ে রাত ২ টার পর ঢাকায় রওনা হন। হঠাৎ মনে পড়ে প্রোডাকশন বয় ইসমাইলকে কোন টিপস দেয়া হয় নাই। প্রচণ্ড বৃষ্টির মধ্যে বহুদূর এসে নিজে গাড়ি চালিয়ে আবার সেটে ফিরে গিয়ে ঐ রাতেই তাকে কিছু দিয়ে ঢাকায় ফেরেন। এমন বহু গল্প আছে যা তার হৃদয়ের বিশালতার প্রমাণ......
বলছিলাম বাংলাদেশের অভিনয় জগতের এক প্রবাদপ্রতিম অভিনেতা হুমায়ূন ফরিদীর কথা।
শিল্পী হুমায়ুন ফরিদীর জন্ম ২৯ মে, ১৯৫২, নারিন্দা, ঢাকা। বাবা এ.টি এম নুরুল ইসলাম ছিলেন জুরী বোর্ডের কর্মকর্তা। বাবার বদলির চাকরীর সুবাদে ফরিদীকে মৌলভীবাজার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চাঁদপুর, কিশোরগঞ্জ, মাদারীপুরসহ অসংখ্য জেলায় ঘুরতে হয়েছে। মা বেগম ফরিদা ইসলাম গৃহিনী। ছোটবেলায় ছন্নছাড়া স্বভাবের জন্য ফরিদীকে ‘পাগলা’ ‘সম্রাট’,‘গৌতম’-এমন নানা নামে ডাকা হত। প্রাথমিক শিক্ষা নিজ গ্রাম কালীগঞ্জে। মাদারীপুর ইউনাইটেড ইসলামিয়া গভর্নমেন্ট হাই স্কুল পাস দিয়ে চাঁদপুর সরকারি কলেজে ভর্তি হন।১৯৭০ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্গানিক কেমিস্ট্রিতে ভর্তি হলেন। এলো একাত্তুর, চলে গেলেন যুদ্ধে। নয় মাসের যুদ্ধ পরে লাল-সবুজের পতাকা হাতে ঢাকায় ফিরলেও ঢাকা ভার্সিটিতে ফেরেন নি। টানা পাঁচ বছর বোহেমিয়ান জীবন কাটিয়ে শেষে অর্থনীতিতে অনার্স-মাস্টার্স করলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। অনার্সে তিনি প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি বিশিষ্ট নাট্যকার সেলিম আল দীনের সংস্পর্শে আসেন। এই ক্যাম্পাসেই ‘আত্মস্থ ও হিরন্ময়ীদের বৃত্তান্ত’ নামে একটি নাটক লিখে নির্দেশনা দেন এবং অভিনয়ও করেন ফরিদী। ছাত্রাবস্থায়ই ১৯৭৬ সালে তিনি ঢাকা থিয়েটারের সদস্য হন। জড়িয়ে যান মঞ্চের সাথে। স্বাধীনতা উত্তরকালে বাঙালির নিজস্ব নাট্য আঙ্গিক গঠনে গ্রাম থিয়েটারের ভূমিকা ছিল অসামান্য, ফরিদী এর সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। মঞ্চ নাটককে প্রসারিত করতে তিনি নাটক কেন্দ্রিক বিভিন্ন সংগঠন গড়ে তোলেন। ‘গ্র“প থিয়েটার ফেডারেশন’ এর অন্যতম। ১৯৯০ এর দশকে তিনি সিনেমার রূপালি জগতে পা বাড়ান।
সেলিম আল দীনের ‘সংবাদ কার্টুন’-এ একটি ছোট্ট চরিত্রে অভিনয় করে ফরিদী মঞ্চে উঠে আসেন।অবশ্য এর আগে ১৯৬৪ সালে মাত্র ১২ বছর বয়সে কিশোরগঞ্জে মহল্লার নাটক ‘এক কন্যার জনক’-এ অভিনয় করেন। মঞ্চে তার সু-অভিনীত নাটকের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘শকুন্তলা’, ‘ফনিমনসা’, ‘কীত্তনখোলা’, ‘মুন্তাসির ফ্যান্টাসি’, ‘কেরামত মঙ্গল’ প্রভৃতি। ১৯৯০ সালে স্ব-নির্দেশিত ‘ভূত’ দিয়ে শেষ হয় ফরিদীর ঢাকা থিয়েটারের জীবন।
আতিকুল হক চৌধুরীর প্রযোজনায় ‘নিখোঁজ সংবাদ’ ফরিদীর অভিনীত প্রথম টিভি নাটক। আশির দশকের দর্শকদের নিশ্চয়ই বিটিভি’র ‘ভাঙ্গনের শব্দ শুনি’ (১৯৮৩) তে সেরাজ তালুকদারের কথা মনে আছে কি? সেলিম আল দীনের রচনা ও নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুর পরিচালনায় এই নাটকে ফরিদীকে দেখা যায় টুপি দাড়িওয়ালা শয়তানের এক জীবন্ত মূর্তি রূপে।
“আরে আমি তো জমি কিনি না, পানি কিনি, পানি”, “দুধ দিয়া খাইবা না পানি দিয়া খাইবা বাজান”-এই ডায়লগ তখন তুমুল জনপ্রিয়।
এরপর শহীদুল্লাহ কায়সারের ‘সংশপ্তক’ (১৯৮৭-৮৮)-এ ‘কান কাটা রমজান’ চরিত্রে-ফরিদীর অনবদ্য অভিনয় কেউ ভোলে নি। ভুলা কি যায়! অসম্ভব!
নাটকে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি মেলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মাননা। আর ২০০৪ সালে ‘মাতৃত্ব’ ছবিতে সেরা অভিনেতা হিসাবে পান ‘জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগে কিছুদিন অতিথি শিক্ষক হিসাবেও পাঠদান করেন।
৬০ তম জন্মদিনে শেক্সপীয়রের ‘কিং লিয়ার’-এ অভিনয়ের বাসনা ব্যক্ত করেছিলেন। তা আর হয়ে ওঠে নি। ৬০ পূর্ণ হবার আগেই বহু অজানা অপূর্ণ বাসনা নিয়ে চলে গেছেন এই জাত অভিনেতা বহু দূরে অনেক দূরে।
অভিনেতা কেন হলেন এমন এক প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, ‘অভিনয় ছাড়া আর কিছুই পারি না আমি’। ভীষণ কৌতুকপ্রিয় মানুষ ছিলেন। নাটকের সেটে নাকি সদা সবাইকে কৌতুকে মাতিয়ে রাখতেন। এত কৌতুক মনে রাখেন কীভাবে, প্রশ্নের উত্তরে একবার বলেছিলেন, জীবনটাই তো কৌতুক, আমরা কেউ থাকব না, থাকবে শুধু কৌতুক। নিজের জীবনের সাথে কৌতুক করতে করতে অস্তাচলে যাওয়া হুমায়ূন ফরিদীর অভাব কখনোই পূরণ হবার না।২০১২ সালের ১৩ ফেব্রুআরি চলে গেছেন তিনি সব মায়া ছেড়ে।
মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন কিন্তু এ নিয়ে তার কোন উচ্চবাচ্য ছিলো না। এটা তার দৃষ্টিতে ছিলো নিজের দায়িত্ব পালন শেষে ঘরে ফেরার মতো...
তিনি চলে গেছেন বহুদূরে কিন্তু তিনি ঠাঁই নিয়েছেন কোটি ভক্তের হৃদয়ে, মগজে। ফরিদী আছেন পৃথিবীর সব নাট্যমঞ্চের ড্রেসিং রুমে, পাটাতনে আছেন রূপোলি পর্দার আড়ালে, থাকবেন অনন্তকাল।
[দৈনিক পূর্বকোণে প্রকাশিত ড. জাহিদুর রহমানের একটি লেখাকে আমি শুধু অন্য আঙ্গিকে সাজিয়েছি এবং নতুন কিছু যোগ করেছি ]
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ দুপুর ১২:৩৩