ঘটনা ১-- সেদিন আমার এক বন্ধুকে নামাজের যাওয়ার কথা বলছিলাম। তার উত্তর শুনে তো আমি অবাক। সে বলছিল- দূর বেটা নামাযের দরকার নাই, আমরা শেষ নবীর উম্মত, আমাদের কবরের সাথে জান্নাতের লিংক দেয়া থাকবো, নামায না পড়লে চলবে!
ঘটনা ২-- বন্ধু বান্ধবের আড্ডা থেকে যখন নামাযের জন্য উঠি তখন তাদের নামাযের কথা বললে তারা সবাই সবচেয়ে পপুলার কারণটা দেখায়, "বন্ধু আমি নাপাক বেটা, তুই গিয়ে পড়ে আয়"।
ঘটনা ৩-- গেল কয়দিন আগে এক বড় ভাই বলছিলেন উনার পরিচিত এক ব্যক্তির কথা। তিনি প্রায় প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়েন কিন্তু সেদিন শুধুমাত্র অপবিত্রতার কারণ দেখিয়ে নামায ক্বাযা করেছেন।
ঘটনা ৪-- আমার এক ডাক্তারি পড়ুয়া বন্ধুকে নামাযের সময় আরেকজন বলছিল- তোমার নামায কবুল নাও হতে পারে কিন্তু ডাক্তারের কাজ ঠিকই কবুল হবে।
ঘটনাগুলো চিন্তার অনেক খোরাক যুগিয়েছিল যার দরুন খুঁজে খুঁজে বের করতে লাগলাম কেন আমাদের নামাযের প্রতি এতো অনীহা। কেন আমরা নামাযকে রেখে অন্য কাজকে বেশী প্রাধান্য দেই। এই চিন্তার ফসল আজকের লেখাটি। আমরা কেন নামায পড়ি না বা কেন আমাদের নামাযে এতো অনীহা এর কারণ অনুসন্ধানে চারটি অবস্থানের চিত্র সবসময়ই সব সমাজে ফুটে উঠে।
১) কুরআন যে আল্লাহ্র বাণী তা আপনি বিশ্বাস করেন না সুতরাং নামাযের তো প্রশ্নই আসে না। এই অবস্থায় আপনাকে আমার কিছু বলার নেই শুধু আল্লাহ্র কাছে বলি তিনি যেন আপনাকে হেদায়াত দান করেন।
২) কুরআন স্বয়ং আল্লাহ্র বাণী এবং তিনি নিজে সরাসরি আমাদেরকে এই আদেশগুলো দিয়েছেন, এতে আপনি বিশ্বাস করেন কিন্তু আপনি ভাবেন আপনার অন্তরে তো বিশ্বাস আছে নামায-রোজা আদায় না করলেও চলবে। আল্লাহ্ কুরআনে নামায পড়ার কথা বলেছেন কিন্তু তারপরেও আপনি তাঁর কথা শুনছেন না এবং নামায পড়ছেন না। হাদীসের ভাষায় আপনি কুফরি করছেন। অনেক হাক্কানী আলেমদের মতে সে কাফির হয়ে গেছে।
৩) আপনি একজন অলস মানুষ এবং শুধু অলসতার জন্যই আপনি নামায পড়েন না, এর বেশি কিছু না। এই সমস্ত লোক আমাদের সমাজে অহরহ পাওয়া যায় যারা শুধুমাত্র নিজেদের অলসতার কারণে নামাযে যেতে চায় না। তারা মনে করে প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়া তাদের জন্য অসম্ভব। এতো কঠিন কাজ তাদের দিয়ে হবে না। কিন্তু অন্যান্য বেহুদা কাজে তাদের উৎসাহ আর উদ্দীপনার শেষ নেই। এরা রাত জেগে মুভি দেখতে পারে, কিন্তু নামায পড়তে পারেন না। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বেহুদা ঘুরতে পারে, বন্ধু বান্ধবের সাথে আড্ডা দিতে পারে, কম্পু চালাতে পারে, ফেসবুক-ব্লগে সময় ব্যয় করেতে পারে কিন্তু আল্লাহ্র জন্য ১০ মিনিট ব্যয় করতে পারে না। মোবাইলে প্রিয়জনের সাথে ঘণ্টার উপরে কথা বলে রাখার সময় পর্যন্ত মনে হয়- ইসস আরেকটু কথা বলে নিই, কিন্তু কয়েক মিনিট আল্লাহর সাথে কথা বলার সময় তাদের হয়ে উঠে না।
৪) আপনার কাছে কাজ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আপনার কাজে আপনার, আপনার পরিবারের, মানুষের ব্যাপক উপকার সাধিত হচ্ছে। আল্লাহ নিশ্চয়ই আপনার গুরু দায়িত্বের কথা বুঝবেন। কাজের ব্যস্ততার কারণে যদি পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়তে না পারেন, তাহলে আল্লাহ আপনাকে মাফ করে দিবেন। একজন ডাক্তার মনে করে– আমি একজন ডাক্তার মানুষ। আমি সবসময় তো মানুষের সেবার উপরে আছি। আমি তো মহান কাজ করছি। মানুষের সেবার করার জন্য আল্লাহ হয়তো আমাকে নামাযের হিসেবের ঘাটতি থেকে মাফ করে দিবেন। দুঃখিত আমি ডাক্তারদের মহান বলতে নারাজ। আমি ডাক্তারদের তখন মহান বলতাম যখন তারা তাদের কাজের জন্য কোন পারিশ্রমিক নিতেন না। বিনা খরচে মানুষের চিকিৎসা করতেন। 'মহানের' সংজ্ঞানুসারে তাকেই মহান ডাক্তার বলা যায় যে মামা-চাচা ধরে অন্যায়ভাবে নিজেদের পছন্দের জায়গায় পোস্টিং না নিয়ে, দূরের কোন গ্রামের অভাবী, অসুস্থ মানুষের চিকিৎসায় নিজ উদ্যোগে ছুটে যান, বিনা টাকায় সেবা করে যান দুঃস্থ, গরীব মানুষদের। একজন ডাক্তার যখন তার কাজের জন্য বেতন নিচ্ছেন, তখন তিনি একজন বেতন ভুক্ত কর্মচারী ছাড়া আর কিছুই নন। তিনি যে কারো উপকার করছেন সে কথার সাথেও আমি একমত নই। 'উপকারের' সংজ্ঞায় যখন আর্থিক লেনদেন বিষয়াবলী যোগ হয়ে যায় তখন তা আর সংজ্ঞার ভিতরে থাকে না। আচ্ছা এরপরও দ্বিমতের কারণে মেনে নিলাম তিনি উপকার করছেন। তাহলে তো বলতে হয়, একজন ডাক্তার যেমন করে মানুষের উপকার করছেন ঠিক তেমনি একজন সুইপারও মানুষের উপকার করছে। সুইপাররা না থাকলে লক্ষ লক্ষ মানুষ অসুস্থ যেতো যা অস্বীকার করার উপায় নেই। আমি ডাক্তারদের ছোট করতে এই কথা বলিনি। শুধুমাত্র তাদের চিন্তার আবরণকে আমার ইসলামের দৃষ্টিতে খোলাসা করার চেষ্টা করছি মাত্র। সবাই যে এইরকম চিন্তা করে তা কিন্তু না, অনেক ডাক্তার আছে যারা বিনা টাকায় কিংবা অতি অল্প খরচে রোগী দেখেন।
আপনি ডাক্তার, শিক্ষক, নার্স, ইঞ্জিনিয়ার, সুইপার, রিকশাচালক, ঠেলাওয়ালা, পুলিশ, তথাকথিত সমাজসেবক যাই হোন না কেন আপনার কোন কাজ অন্তত নামাযের চেয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ণ না। পৃথিবীতে নামাযের চেয়ে এমন কোন গুরুত্বপুর্ন কাজ নেই যার জন্য আল্লাহ্ নামাযের হিসাব ছেড়ে দিবেন। নামাযের ব্যাপারে এতো কঠোর আদেশ দেয়া হয়েছে যে, অসুস্থ অবস্থায়, ওযু ছাড়া, বসে, শুয়ে, অপবিত্র পোষাকে, যুদ্ধাবস্থায় নামায আদায় করতে পারবেন। কিন্তু কোন কারণেই স্বেচ্ছায় এক ওয়াক্ত নামাযও পরিত্যাগ বা ক্বাযা করতে পারবেন না। যতক্ষণ হুশ আছে বা হৃদয়ে আল্লাহকে স্মরণ করার ক্ষমতা আছে ততক্ষণ তার নামায রহিত বা মাফ হবে না। এখন আপনার ক্ষমতা আছে পবিত্র হওয়ার, পোশাক পড়ার, মসজিদে যেয়ে জামাতে অংশগ্রহণ করার কিন্তু তারপরও আপনি গেলেন না শুধুমাত্র কাজের দোহায় দিয়ে তাহলে আল্লাহ্ কি আপনাকে মাফ করে দিবেন ??
আপনার অতীব সেই গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য যদি নামায মাফ করে দেয়া হত তাহলে নবী-রাসুলদের নামায পড়ার আর দরকার হতো না। তাদের থেকে অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ কাজ নিশ্চয়ই আপনি আমি করছি না ??
নামায সম্পর্কে মহান আল্লাহ্র কয়েকটি বানীঃ
ধৈর্য্যর সাথে সাহায্য প্রার্থনা কর নামাযের মাধ্যমে। অবশ্য তা যথেষ্ট কঠিন কাজ কিন্তু সে সমস্ত বিনয়ী লোকদের পক্ষেই তা সম্ভব যারা বিশ্বাস রাখে যে, তাদেরকে একদিন তাদের রবের সম্মুখীন হতে হবে এবং তাঁরই দিকে ফিরে যেতে হবে। [সূরা বাকারাহ ২:৪৫-৪৬]
নামাযগুলোর ব্যপারে বিশেষ সতর্ক থাকো, আর মধ্যমপন্থায় নামায পড়।আর আল্লাহর সামনে অত্যন্ত ভক্তি নিয়ে দাঁড়াও। [সূরা বাকারাহ ২:২৩৮]
তোমরা নামায প্রতিষ্ঠা কর এবং যাকাত দাও। তোমরা নিজের জন্যে পূর্বে যে সৎকর্ম প্রেরণ করবে, তা আল্লাহর কাছে পাবে। তোমরা যা কিছু কর, নিশ্চয় আল্লাহ তা প্রত্যক্ষ করেন। [সূরা বাকারাহ ২:১১০]
আর নামায কায়েম কর, যাকাত দান কর এবং নামাযে অবনত হও তাদের সাথে, যারা অবনত হয়। [সূরা বাকারাহ ২:৪৩]
অতঃপর যখন তোমরা নামায সম্পন্ন কর, তখন দন্ডায়মান, উপবিষ্ট ও শায়িত অবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ কর। অতঃপর যখন বিপদমুক্ত হয়ে যাও, তখন নামায ঠিক করে পড়। নিশ্চয় নামায মুসলমানদের উপর ফরয নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে। [সূরা নিসা ৪:১০৩]
আর দিনের দুই প্রান্তেই নামায ঠিক রাখবে, এবং রাতের প্রান্তভাগে পূর্ণ কাজ অবশ্যই পাপ দূর করে দেয়, যারা স্মরণ রাখে তাদের জন্য এটি এক মহা স্মারক। [সূরা হুদ ১১:১১৪]
আপনি আপনার পরিবারের লোকদেরকে নামাযের আদেশ দিন এবং নিজেও এর ওপর অবিচল থাকুন। আমি আপনার কাছে কোন রিযিক চাই না। আমি আপনাকে রিযিক দেই এবং আল্লাহ ভীরুতার পরিণাম শুভ। [সূরা ত্বোয়া-হা ২০:১৩২]
এই কিতাবে যা প্রকাশ করা হয়েছে সেটা পড়। নিয়মিত নিষ্ঠার সাথে নামায পড়। নিশ্চয়ই নামায অশ্লীল এবং অন্যায় কাজ থেকে দূরে রাখে। [আল-আনকাবুত ২৯:৪৫]
নিয়মিত নিষ্ঠার সাথে নামায পড়, যাকাত দাও এবং রাসুলকে অনুসরণ কর, যাতে করে তোমরা আমার অনুগ্রহ পেতে পারো। [আন-নুর ২৪:৫৬]
সেদিন জান্নাতের অধিবাসীরা একে অন্যকে অপরাধীদের ব্যাপারে জিগ্যেস করবে। তারা জিগ্যেস করবে (জাহান্নামিদেরকে), “কে তোমাদেরকে গনগনে আগুনে নিয়ে গেল?” ওরা বলবে, “আমরা নামায পড়তাম না”। [আল-মুদ্দাসির ৭৪:৪৩]
কিন্তু তারপর তাদের পরে কিছু জাতি এসেছিল যারা নামাযকে হারিয়ে ফেলেছিল এবং নিজেদের কামনা-বাসনায় ডুবে ছিল। এরা শীঘ্রই তাদের পাপের পরিণতির মুখোমুখি হবে। [মরিয়ম ১৯:৫৯]
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই এপ্রিল, ২০২১ বিকাল ৫:০৮