উৎসর্গঃ ব্লগার রিমঝিম বর্ষার কন্যা সারাহ*
প্রতি বছর এই থার্টি ফার্স্টের সময়টাতে এসে কিছু বাঙালির অনর্থক চুলকানি লক্ষ্য করি। সারাবছরে বৈশাখ, জ্যোষ্ঠ কোনটা কবে আসে তার খবর থাকে না, এমন কিছু মানুষ যেমন এই দিন হঠাৎ বাঙালি হয়ে ওঠেন। তেমনভাবে জুমার নামাজ ছাড়া কোন কালে কপাল-নাক একসাথে মাটিতে ছোঁয়ান না, এমন কিছু মানুষ হঠাৎ মুমিন মুসলমান হবার চেষ্টা করেন। ভয়াবহ যন্ত্রনা।
বাংলা ব্লগ বাঙালির আটপৌরে চরিত্রেরই কিবোর্ডিয় প্রতিফলন। একই চুলকানি, একই প্যানপ্যানানি এখানেও দেখছি আর বিরক্ত হচ্ছি। চেষ্টা করে দেখা যাক, এসব চর্মরোগের কিছু ব্যবস্থা করা যায় কিনা! শুরুতেই বলে নেয়া ভাল যে থার্টি ফার্স্টের ব্যাপক আনন্দ উৎসব করা বা না করা একান্ত ব্যক্তিগত এবং অর্থনৈতিক সামর্থের ব্যাপার। এটা নিয়ে আমার কোন বক্তব্য নাই। এই পোস্ট তাদের উদ্দেশ্যে লিখিত যাদের এই দিনে শুভ নববর্ষ জানাতেও গায়ে জ্বালা করে।
চুলকানি একঃ- আমাদের বাংলা বর্ষপঞ্জিকা মেনে পহেলা বৈশাখই শুধু পালন করব, ইংরেজি থার্টি ফার্স্টের কি প্রয়োজন?
চুলকানি দুইঃ- মুমিন মুসলমানের হিজরী সন থাকতে ইহুদি-নাসারাদের খ্রিস্টীয় ক্যালেন্ডার নিয়ে মাতামাতির কি প্রয়োজন?
মলমঃ- প্রচলিতভাবে যাকে বাংলা বর্ষপঞ্জিকা বলে ডাকা হয়, সেটাকে ঠিক বাংলার নিজস্ব সম্পত্তি বলা যায় না। এটা সমগ্র ভারতবর্ষে বহু প্রাচীনকাল থেকে প্রচলিত হিন্দু ক্যালেন্ডারের একটি সংস্করন। সম্রাট আকবর এটা সরকারীভাবে চালু করেছিলেন। তাকে একটা ছোট ধন্যবাদ দিতে হবে এই জন্য যে তিনি মাস বা দিনের হিন্দু (!) নামগুলির মুসলমানি (!) করিয়ে ফারসীতে পরিবর্তন করে ফেলেননি। এখনও সারা ভারতেই এই ক্যালেন্ডার অল্পসল্প প্রচলিত আছে, বিশেষ করে দক্ষিন ভারতে।
হিজরী বর্ষপঞ্জির ইতিহাসের সাথেও সরাসরি মুহম্মদ (সাঃ) বা কোন নবী-রাসুলের যোগাযোগ নাই। মুহম্মদ (সাঃ) মারা যাবার ৫/৬ বছর পর এটা চালু করেন উমর (রাঃ)। তার আগেও অবশ্য আরবে চান্দ্রমাসের প্রচলন ছিল। তবে উমর (রাঃ) এই মাস এবং বছরের হিসাবকে একটা নিয়মের মধ্যে নিয়ে আসেন। হিজরী বর্ষপঞ্জির সাথে মূল ইসলামের একটাই অতি সামান্য যোগসূত্র আছে - মুহম্মদ (সাঃ) এর হিজরতের দিনটাকে উমর (রাঃ) বর্ষপঞ্জির প্রথম দিন হিসেবে নির্দিষ্ট করেছেন। এছাড়া হিসাবের সুবিধার্থে বাধ্যতামূলক রোজা রাখার ২৯/৩০ দিনকে এখানে একটি পূর্নাঙ্গ মাস হিসেবে ধরা হয়েছে। ব্যস, এখানেই ইসলাম শেষ।
সময়, দিন, তারিখ ইত্যাদি এমন কিছু বিষয় যা সারাবিশ্বে অবশ্যই একই হতে হবে। এর কোন অন্যথা করা যাবে না। রেনেসাঁ পরবর্তী সময়ে ইউরোপীয়দের আগ্রাসনের কারনে তাদের গ্রেগরীয়ান ক্যালেন্ডার সারা বিশ্বে বহুল প্রচলিত হয়ে গেছে। এই সময় এসে এই বাস্তবতা অস্বীকার করার একেবারেই অনর্থক।
ফসলের হিসাবে রাখার সুবিধার্থে গ্রাম বাংলার কৃষক সমাজের কাছে বাংলা সনের উপযোগীতা হয়ত আজও আছে। এর বাইরে জাতীয় বা ব্যক্তিগত জীবনে পয়লা বৈশাখের উৎসব ছাড়া বাংলা সন-তারিখের কোন ব্যবহার নাই। ব্যবহার থাকার প্রয়োজন নাই আর ব্যবহারে বাড়ানোর কোন উপায়ও নাই।
একইভাবে ধর্মীয় উৎসব ছাড়া হিজরী সনেরও কোন ভূমিকা নাই। এছাড়া হিজরী সন পুরোপুরি অবৈজ্ঞানিক। হিজরী ক্যালেন্ডার মানতে গেলে প্রতি মাসের এক তারিখে কোন গুরুত্বপূর্ন কাজ রাখা যাবে না কারন সেটা মাসের এক তারিখ হবে নাকি আগের মাসের ত্রিশ তারিখ, সেটা নির্দিষ্ট করে বলা যাচ্ছে না।
এত কথার সারমর্ম হচ্ছে, আজকের যুগে বাংলা বা হিজরী ক্যালেন্ডারকে খুব গুরুত্ব দিয়ে জীবন জটিল করার কোন অর্থ নাই। সার্বজনীয় গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারকে মেনে নেয়াই ভাল।
চুলকানি তিনঃ- ইহুদি নাসারাদের সংস্কৃতি এই নববর্ষ, এটা পালন করলে তাদের সাথে জাহান্নাম লাভ হবে।
মলমঃ- গ্রেগরিয়ান নববর্ষ প্রথা কোনভাবে ধর্মীয় কোন উৎসব না। এর সাথে খ্রিস্টসমাজের সম্পর্ক এইটুকুই যে এটা তারাই প্রথম শুরু করেছিল। তবে ধর্মীয় উৎসব হিসেবে নয়, সামাজিক উৎসব হিসেবে। খ্রিস্টানদের প্রচলনকৃত সংস্কৃতির ব্যাপারে এতটা অ্যালার্জি থাকলে শার্ট-প্যান্ট থেকে শুরু করে বর্তমান বিচারব্যাবস্থা, সরকারব্যাবস্থা সব কিছুর উপরই অ্যালার্জি থাকতে বাধ্য। এখানে কোন ডাবল স্ট্যান্ডার্ড রাখা উচিৎ না।
চুলকানি চারঃ- নববর্ষ উৎসব নানা ধরনের নোংরামি, অশ্লীলতা ডেকে আনে।
মলমঃ- বিশাল সংখ্যক লোক কম্পিউটার ব্যবহার করে পর্ন দেখার কাজে। তার অর্থ এই না যে আপনাকেও সেটা করতে হবে বা আপনি কোন ভাল কাজে কম্পিউটার ব্যবহার করতে পারবেন না। আপনি এটা হাদিস শোনাতেও ব্যবহার করতে পারেন। নববর্ষ উৎসবে নোংরামি এড়িয়ে চলুন। নিজ নিজ সামাজিক এবং অর্থনৈতিক অবস্থা অনুসারে আনন্দঘন পরিবেশের মাধ্যমে নতুন বছরকে স্বাগত জানান।
চুলকানি পাঁচঃ- নববর্ষ এমন কি বড় ব্যাপার! বছরের আরেকটা দিনই তো, কি আর এমন পার্থক্য!!
মলমঃ- না, আসলেই কোন পার্থক্য নাই। একইভাবে জন্মদিন বা ঈদের দিনের সাথেও তেমনি বছরের আরেকটা দিনের তেমন পার্থক্য নাই। কিন্তু আমরা এসব দিন পালন করি, উৎসবে মেতে উঠি। মানুষের শরীর এবং মন কোন লোহার যন্ত্র না, দু'টোরই সময় সময় বিরতি দরকার হয়। পশ্চিমা দেশের মানুষের উন্নতির পেছনে একটা বড় কারন হচ্ছে - তারা তাদের হলিডে, উইকেন্ড সত্যিকার অর্থেই পালন করে থাকে। নির্ভেজাল আনন্দের মধ্য দিয়ে তাদের কর্মবিরতি উপভোগ করে তারা বাকি সপ্তাহ বা বছরের জন্য শক্তি সঞ্চয় করে নেয়। আমাদের পাঁচ দিনের ঈদের ছুটির শুরু এবং শেষের দু'দিন চলে যায় শুধু বাস/ট্রেনে অমানুষিক জ্যাম আর ধাক্কাধাক্কিতে। নতুন কর্মশক্তি লাভ তো দূরের কথা, বরং লোকে আরও বেশি ক্লান্ত হয়ে পড়ে বাড়ি থেকে ফিরে। এ ধরনের বোরিং জীবন থেকে একটা নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখ আপনাকে ক্ষনিকের জন্য একটু আনন্দ দিতে পারলে ক্ষতি কি?
সবাইকে নতুন বছরের শুভেচ্ছা।
---------------------------------------------------------------------
ব্লগার রিমঝিম বর্ষার ব্লগে তার কন্যার খোঁজখবর খুব একটা পাওয়া যায় না। আমি অবশ্য কবিতার ভয়ে তার ব্লগে খুব একটা যাইও না। সারাহকে মূলত পাওয়া যায় মায়ের ফেসবুকে। সেখানে তার অসংখ্য ছবি এবং কিছু ভিডিও আছে। রাজকন্যাকে প্রথমবার দেখে মনে হয়েছিল এবং আজকেও সেটাই মনে হয় - এই মেয়েটার চোখে-মুখে এক্সপ্রেশন খেলা করে। এমন এক্সপ্রেশন যা দেখলেই মন ভাল হয়ে যায়, কুৎসিত পৃথিবীকে আচমকা খুব সুন্দর মনে হয়।
সারাহ মা, এই বছর, আগামি বছর, সামনের সবগুলি বছর যেন তোমার জন্য শুধু রাশি রাশি আনন্দের উপলক্ষ বয়ে নিয়ে আসে। কোন মন্দ যেন কখনো তোমাকে স্পর্শ না করে।