সত্তরের দশকে ব্রুসলীর হাত ধরে মার্শাল আর্ট ভিত্তিক ছবির যে জয়জয়কার বিশ্ব জুড়ে শুরু হয়েছিল, তার ঢেউ সহসাই আছড়ে পড়ে আমাদের বাংলা চলচ্চিত্রেও। আশির দশকের শুরুতে ওস্তাদ জাহাঙ্গীর আলম ব্যাংকক থেকে মার্শাল আর্ট শিখে এসে চট্টগ্রাম অঞ্চলে একটি মার্শাল আর্ট শেখার স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। ভিসিআর তখন পর্যন্ত ব্যপকভাবে প্রচলিত না থাকায় ব্রুসলীর ছবি বা মার্শাল আর্ট সম্বন্ধে এদেশের মানুষের তেমন কোন ধারনা ছিল না। সৌভাগ্যক্রমে ওস্তাদ জাহাঙ্গীর প্রযোজক-পরিচালক মাসুদ পারভেজের নজরে পড়েন। প্রতিষ্ঠিত পরিচালক এবং ব্যস্ত নায়ক মাসুদ পারভেজ ওস্তাদকে তার যাদুনগর ছবিতে কাজ করার আমন্ত্রন জানান। গতানুগতিক ঢিসুম-ঢাসুম অ্যাকশন দৃশ্যের বদলে এই প্রথম বাংলা ছবির দর্শক সম্পূর্ন নতুন ধরনের অ্যাকশনের স্বাদ পায়। এমনকি ভিসিআরের দর্শকেরাও হিন্দি ছবিতে এ ধরনের অ্যাকশন কখনো দেখেনি। খুব কম সময়ের মধ্যেই অত্যন্ত জনপ্রিয় হয় মার্শাল আর্ট।
মার্শাল আর্ট প্রকৃতপক্ষেই একটি শিল্প। একজন নৃত্যশিল্পী যেমন বহু বছরের সাধনার পরে নাচের মুদ্রাগুলি নিখুঁতভাবে আয়ত্ব করতে পারে, মার্শাল আর্টে হাত-পায়ের কসরৎ রপ্ত করতেও প্রচুর সময় এবং অধ্যবসায় প্রয়োজন। তুমুল ব্যস্ত মাসুদ পারভেজের জন্য এতটা সময় ব্যয় করা সম্ভব ছিল না। ফলে খুব হালকা কিছু কায়দা নিয়েই তাকে সন্তুষ্ট থাকতে হত।
মাসুদ পারভেজের ছোট ভাই মাসুম পারভেজ রুবেল ছোটবেলা থেকেই একজন অ্যাথলেট। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাস্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে পড়াকালীন তিনি বিশ্ববিদ্যালয় দলে ফুটবলও খেলেছেন। তিনিও মার্শাল আর্টের প্রতি উৎসাহিত হন এবং কয়েক বছর ধরে এর চর্চা করছিলেন। তখনও তিনি চলচ্চিত্রে পা রাখেননি।
শহীদুল ইসলাম খোকন ছিলেন একটানা প্রায় দশ বছর মাসুদ পারভেজের প্রধান সহকারী পরিচালক। আশির দশকের মাঝামাঝিতে তিনি পারভেজ সাহেবের আশির্বাদ নিয়ে নিজে ছবি পরিচালনা শুরু করেন। দূর্ভাগ্য, তার প্রথম ছবি পদ্মগোখরা বক্স অফিসে মুখ থুবড়ে পড়ে। এমনকি দ্বিতীয় ছবিও ব্যর্থ হয়। হতাশ শিষ্যকে মাসুদ পারভেজ আবারও কাছে টেনে নেন এবং রুবেলকে নায়ক হিসেবে প্রোমোট করানোর জন্য খোকনকে বেছে নেন। এখানেই তৈরি হয় বাংলা চলচ্চিত্রের সর্বকালের সবচেয়ে সফল পরিচালক-নায়ক জুটির। পরবর্তী প্রায় পনের বছরের বেশি সময় এই জুটি বক্স অফিস শাসন করে একচেটিয়া ভাবে। তাদের প্রথম ছবির নাম লড়াকু, রুবেলের প্রথম হলেও খোকনের তৃতীয় ছবি। প্রথমবারের মত প্রকৃতপক্ষে মার্শাল আর্ট জানা একজন নায়ক নিখুঁত কায়দা কসরৎ দেখান পর্দায়। ব্যাপক জনপ্রিয় হয়েছিল লড়াকু।
বীর পুরুষ ছবিটা এসেছিল লড়াকুর বছর দু'য়েক পরে। প্রত্যেক বড় তারকার জীবনে একটা কাজ থাকে যেটা তাকে মহাতারকাতে পরিনত করে। রুবেল এবং খোকনের শিল্পীজীবনের এই টার্নিং পয়েন্টটা ছিল বীরপুরুষ ছবিটি। শুন্যে উঠে দুই পা দু'দিকে ছড়িয়ে মাটির হাড়ি ভাঙার দৃশ্যটা পুরোনো বাংলা ছবির দর্শকের চোখে লেগে আছে এখনও। কিশোর ও তরুনদের আইকনে পরিনত হন রুবেল।
মরহুম বশির চৌধুরীর দুই যমজ সন্তানের একজন আরমানকে ছোটবেলা হাফিজ নামের এক ব্যক্তি মুক্তিপণের লোভে অপহরণ করে। শিশু আরমানকে বন্ধু আবদুর রহমানের জিম্মায় রেখে হাফিজ গিয়েছিল মুক্তিপণ আনতে। নিঃসন্তান আব্দুর রহমানের স্ত্রী আরমানকে ছাড়তে রাজি না হওয়ায় তারা আরমানকে নিয়ে পালিয়ে যায় এবং নিজ সন্তানের মত বড় করে। দুই ভাই বড় হয় সম্পূর্ন ভিন্ন দুই পরিবেশে, দুই শহরে।
বশির চৌধুরীর অপর সন্তান সোহেলকে বশির চৌধুরীর ভাই আসগর চৌধুরী সম্পত্তির লোভে হত্যা করে। মৃত্যুশয্যায় আব্দুর রহমান আরমানকে ছোটবেলায় ঘটে যাওয়া সব ঘটনা খুলে বলে এবং তার আসল বাবা-মায়ের কাছে ফিরে যেতে বলে। আরমান তার নিজের বাড়িতে ফিরে এলে আসগর চৌধুরী হতাশ এবং ক্ষুদ্ধ হন। আরমান তার ভাইয়ের হত্যাকারী খুঁজে বের করার জন্য এদিক-সেদিক খোঁজখবর শুরু করে। এসময় তার সাথে দু'জনের দেখা হয় - প্রথমজন বশির চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ বন্ধু মার্শাল আর্ট ব্ল্যাকবেল্ট হোল্ডার, পেশাগতজীবনে কবিরাজ সিরাজউদ্দিন (সিরাজ পান্না)। দ্বিতীয়জন এক রহস্যময় ব্যক্তি যে কখনো তার পরিচয় দেয় না, হঠাৎ হঠাৎ তাকে দেখা যায় আবার হঠাৎ উধাও হয়ে যায়। লোকটি আরমানকে বারবার সতর্ক করছিল "সাবধান!! চারিদিকে শত্রু"।
আসগর চৌধুরীর মূল ব্যবসা চোরাচালান এবং এই কাজে তার অংশীদার ভয়ংকর হামজা (ড্যানি সিডাক)। চোরাচালান কাজে এতদিন তারা যে রুট ব্যবহার করছিল, সেখানে পরপর কয়েকবার অজ্ঞাত হামলার কারনে মালামাল খোয়া যাওয়ায় তারা নতুন রুটের সন্ধানে নামে। হামজার সাঙ্গপাঙ্গ যে নতুন রুট খুঁজে পায়, সেখানে জনৈক জমির শেখ তার স্ত্রী এবং একমাত্র ছেলে সহজ-সরল বাবলাকে (রুবেল) নিয়ে বাস করেন। মোটা অংকের টাকার লোভ দেখিয়েও বাড়ি বিক্রি করতে রাজি করাতে না পেরে হামজা জমির শেখ এবং তার স্ত্রীকে হত্যা করে। বাবলা আহত অবস্থায় পালিয়ে যায়।
মরনাপন্ন বাবলাকে পথের ধারে পেয়ে আরমান কবিরাজ সিরাজের বাড়িতে নিয়ে আসে। কবিরাজের চিকিৎসায় সুস্থ হয় বাবলা। বাবা-মায়ের হত্যার প্রতিশোধ নিতে বাবলা কবিরাজের কাছে মার্শাল আর্ট শিখে দুর্ধর্ষ হয়ে উঠে। আসগর-হামজা গং এর শত্রু আরমান এবং বাবলা দু'জনই কবিরাজের ঘনিষ্ঠ বলে এবার তাকেও হত্যা করা হয়। আসগর আলীর আসল রুপ আরমান এবং বাবলার চোখে ধরা পড়ে যায়। প্রতিশোধ নেবার জন্য তারা একসাথে আঘাত হানে আসগর-হামজার ঘাঁটিতে। সবশেষে মধুরেণ সমাপয়েৎ। রহস্যময় ব্যক্তির পরিচয়ও জানা যায় একদম শেষ পর্যায়ে এসে।
বানিজ্যিক বাংলা ছবিতে কাহিনীর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে খুব বেশি মাথা ঘামানোর সুযোগ থাকে না। বাস্তব জীবনের সাথে মিলাতে গেলে প্রায় প্রতিটা সিকোয়েন্সেই ভুল ধরা যাবে। এছাড়া সব বাংলা ছবিই খুব বেশিরকম প্রেডিকটেবল হয়ে থাকে। বীর পুরুষও এসব দোষত্রুটি থেকে মুক্ত না। তাই সে প্রসঙ্গে আর যাচ্ছি না। সার্বিকভাবে এ ছবির কাহিনী সেন্স মেক করেছে, বাংলা ছবির সেসময়কার নিয়মিত দর্শক হিসেবে এতেই আমি খুশি। স্টাইলিশ পরিচালক খোকন জানেন দর্শককে কিভাবে ধরে রাখতে হয়। সিনেমা হলগুলির শোটাইম তিনঘন্টার বলে বাধ্য হয়ে তাকে কিছু অপ্রয়োজনীয় চরিত্র এবং সিকোয়েন্স দিয়ে ছবি লম্বা করতে হয়েছে। এদের বদলে মূল চরিত্রগুলির রোমান্টিক অ্যাঙ্গেল বিকাশের দিকে আরেকটু মনোযোগ দিতে পারতেন।
অভিনেতাদের মধ্যে সোহেল রানা এবং রুবেল ভাল কাজ করেছেন। রুবেলের কোন ছবিতেই কোন নায়িকার কিছু করার থাকে না। সুচরিতাও তার মাপের চরিত্র পাননি। তবে যতটা সময় পর্দায় ছিলেন, অন্ধ মেয়ের চরিত্র ভাল ফুটিয়ে তুলেছেন। ড্যানি সিডাককে ভয়ংকর পিশাচরুপী মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করা হয়েছিল। খুব একটা আকর্ষনীয় হয়নি। খলিল মোটামুটি।
এই ছবিতে দু'জন শিল্পী তাদের যাত্রা শুরু করেছিল - সখী এবং সিরাজ পান্না। রুবেলের নায়িকা সখী থাকা বা না থাকা সমান। ছবির মূল ঘটনার সাথে তার চরিত্রের কোন সম্পর্ক ছিল না। দর্শকমনে তেমন কোন প্রভাব তিনি রাখতে পারেননি। নবাগত হিসেবে সিরাজ পান্না বিষ্মিত করেছেন। এই নতুন শিল্পীদের নিয়ে একটু আলোচনা করা যেতে পারে। শুধুমাত্র রুবেলের কারনে বাংলা ছবিতে প্রচুর নতুন অভিনেতা-অভিনেত্রীর আগমন ঘটেছিল। রুবেলের সব ছবিই মার্শাল আর্ট ভিত্তিক বলে তার ভিলেনও মার্শাল আর্ট জানা হওয়া বাধ্যতামূলক। তখনকার ব্যস্ত ভিলেনদের কেউই যেহেতু এই বিদ্যা জানতেন না, পরিচালক খোকন রুবেলের প্রথম ছবি লড়াকুতে ভিলেন হিসেবে নিয়ে এলেন ড্যানি সিডাককে যার একমাত্র যোগ্যতা মার্শাল আর্ট জানা। পরবর্তী ৬-৭ বছর ড্যানি নিয়মিত রুবেলের ছবিতে ভিলেনের চরিত্র করেছেন। ৯১ সালে সন্ত্রাস ছবির মাধ্যমে হুমায়ুন ফরিদীর বাংলা ছবিতে পা রাখার পর তিনিই রুবেলের ছবির নিয়মিত ভিলেন হয়ে উঠেন। অভিনয়ে অপটু প্রায় বেকার ড্যানি এরপর দেলোয়ার জাহান ঝন্টুর মাধ্যমে নায়ক হওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। এখন তিনি প্রায় কর্মশুন্য। মার্শাল আর্ট ছবির আরেকটি অনুসঙ্গ নায়কের একজন গুরুর উপস্থিতি। এই শুন্যস্থান পূরনের জন্য বীর পুরুষ ছবিতে অভিষিক্ত হন সিরাজ পান্না। তিনিও অনেক বছর রুবেলের সাথে চুটিয়ে অভিনয় করেছেন। রুবেলের মার্শাল আর্ট জানা বন্ধুর চরিত্রে নব্বই দশকের শেষের দিকে আসেন আলেকজান্ডার বো। এর কিছুদিন পর রুবেল এবং খোকনের পনের বছরের বন্ধুত্বের ফাটল ধরে। একরোখা খোকন আলেকজান্ডার বোকে নিয়ে ম্যাডাম ফুলি নামে একটি ছবি তৈরি করেন। ছবিটি সফল হলেও আলেকজান্ডার বো রুবেলের জায়গা নিতে পারেননি। তিনি পরে লো বাজেটের কাটপিস নির্ভর ছবির নায়ক হয়ে যান। এখন তিনিও কর্মশুন্য। রুবেলের ছবি খুব বেশি নায়কময় হবার কারনে প্রতিষ্ঠিত নায়িকারা কখনো তার ছবিতে অভিনয় করতে চাইতেন না। ফলে পরিচালকেরা প্রচুর নতুন মেয়েকে তার নায়িকা হিসেবে সুযোগ দিয়েছেন - সখী, মিশেলা, সোহানা, সাথী এবং আরও অনেকে। এদের কেউই ক্যারিয়ার গড়তে পারেননি। ১-২টি ছবি করে বিদায় নিয়েছেন।
আলম খান কোন কালজয়ী সুর এই ছবিতে না দিলেও দুটো চমৎকার রোমান্টিক গান আছে - চোখের আলোয় দেখিনি এবং তোমাকে ভালবাসি । দুটো গানই রেডিও অনুরোধের আসর এবং বিভিন্ন গীতমালা অনুষ্ঠানে নিয়মিত বাজত।
ছবির মূল আকর্ষন অ্যাকশন দৃশ্যগুলি যার কম্পোজিশন করেছেন রুবেল নিজেই তার নিজস্ব ফাইটিং গ্রুপ দি অ্যাকশন ওয়ারিওয়ার্সের ব্যানারে। ছবিতে কোন গোলাগুলি বা বোমাবাজির ব্যাপার নেই। শুধুমাত্র মার্শাল আর্ট ধাঁচে হাত-পায়ের অ্যাকশন। রুবেল ফাইট কম্পোজিশনকে এককথায় বলা যায় অসাধারন। বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হবে সিরাজ পান্নার গুন্ডাদের সাথে ফাইট এবং রুবেল-ড্যানি সিডাকের দ্বৈরথের কথা।
সবশেষে একটি সম্পূর্ন ভিন্ন প্রসঙ্গ। ছবির শুরুর দিকে ধারাবিবরনীতে উপরের এই ছবিটি দেখিয়ে বলা হচ্ছিল "সক্রিয় হয়েছে হায়েনার চোখ"। বীর পুরুষ আজ থেকে ২৪ বছর আগের ছবি। আজকে ২০১১ সালে কোন পরিচালকের বোধহয় এ ধরনের ছবি ব্যবহার করার সাহস হবে না। গত ২৪ বছরে এই হায়েনার দল প্রধান রাজনৈতিক দলগুলির কল্যানে (!) সামাজিক ও রাজনৈতিক স্বীকৃতি পেয়ে গেছে। এখন আমরা তাদের ভয় পাই!
বীর পুরুষ ছবির ইউটিউব লিঙ্ক
----------------------------------------------------------------------------
RaDiO bg24 এর ফেইসবুক পেইজের খবর আমি বোধহয় পেয়েছিলাম ব্লগার রাজসোহানের কাছে। পেইজের অ্যাডমিন দাবি করছিলেন যে তার কাছে সত্তর/আশি/নব্বই দশকের বহু দুর্লভ ব্যান্ড এবং বাংলা ছবির গান আছে। আমার জন্য এর চেয়ে ভাল খোরাক আর হতে পারে না। তাই এই পেইজে নিয়মিত যাতায়াত শুরু করলাম। এদের সংগ্রহ দেখে আমি আসলেই অবাক। যতটা আশা করেছিলাম, তার চেয়ে নিয়মিত বিরামহীনভাবে ভদ্রলোক গান পোস্ট করে যাচ্ছেন প্রতিদিন। শুনলাম, শিঘ্রি পুরোনো বাংলা ছবিও পোস্ট করা শুরু করবেন। আমার কৈশোর ও তারুন্যের হারিয়ে যাওয়া শত শত গানকে আরেকবার ফিরিয়ে দেবার জন্য পেইজটার প্রতি অনেক কৃতজ্ঞতা। এই পোস্ট সেই কৃতজ্ঞতা প্রকাশের একটা খুব ছোট মাধ্যম।