পোস্ট উৎসর্গঃ ব্লগার জুন, রীমা তাঁর দুরসম্পর্কের কাজিন।
বাংলাদেশে গাইনী বিশেষজ্ঞের ইতিহাস খুব একটা পুরোনো না। এই সামহোয়ারেও অনেক ব্লগার পাওয়া যাবে যাদের মা কোনদিনই প্রসবকালে কোন ডাক্তারের কাছে যাননি, স্থানীয় দাই বা মুরুব্বিস্থানীয় কেউই কাজ সেরে দিয়েছেন। সত্তর বা আশির দশকে তাই হাতে গোনা কয়েকজন গাইনী বিশেষজ্ঞ ঢাকায় ছিলেন। তাদের মধ্যে অন্যতম প্রভাবশালী এবং ধনী ছিলেন ডাক্তার মেহেরুন্নেসা। ডাক্তারের আদরের পুত্রধন, নাম মুনীর। মুনীর পারিবারিকভাবে বিয়ে করেন শহীদ সাংবাদিক নিজামউদ্দিন আহমেদের (১৯৭১ এ ইত্তেফাকে কর্মরত ছিলেন) কন্যা শারমীন রীমাকে ১৯৮৯ সালে। বিয়ের মাত্র তিন মাস পর ৯ই এপ্রিল পুলিশ নরসিংদীর কাছাকাছি মিজিমিজি গ্রাম থেকে উদ্ধার করে রীমার লাশ।
বাড়ি থেকে এতদূরে কোন মেয়ের লাশ পাওয়া গেলে যে কেউই সবার আগে ধরে নেয় হয় স্বামী নিজেও খুন হয়েছে বা নিজেই খুন করেছে। পুলিশও শুরু করে মুনীরের খোঁজ। তাকে চরস সহ এক হোটেলে পাওয়া যায়, সেখানে সে পাগল পাগল অবস্থায় গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করছিল। খুব সহসাই পুলিশ বুঝতে পারে যে আসলে পাগলামীর অভিনয় করছে পুলিশকে ধোঁকা দিতে এবং আত্মহত্যারও তার আদৌ কোন পরিকল্পনা ছিল না। একটু খোঁজখবর নিয়েই পুলিশ পুরো ঘটনা বের করে ফেলে।
মুনীর ছিল শিক্ষিত ধনী বাবা-মায়ের পুরোপুরি নষ্ট ছেলে। তার নামে কোন সন্ত্রাসী কার্যক্রমের অভিযোগ ছিল না, তার ছিল চারিত্রিক দোষ। তার চেয়ে অনেক বেশি বয়সের মেয়েদের সাথে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক হত। মায়ের ক্লিনিকের এক বয়স্ক নার্স মিনতির সাথে তার প্রেম হয়, মেহেরুন্নেসা নিজস্ব প্রভাব খাটিয়ে সে সম্পর্ক ভাঙ্গতে সক্ষম হন। কিন্তু এর কিছুদিন পর মুনীরের সাথে সম্পর্ক হয় ১৫-১৬ বছরের কয়েক বাচ্চার মা চল্লিশোর্ধ হোসনে আরা খুকুর সাথে। খুকুর স্বামী ছিল সম্পূর্ন পঙ্গু। সংসার চালানোর জন্য স্বল্পশিক্ষিত খুকুর একটাই উপায় ছিল, সে ছিল পেশাদার কলগার্ল। সমাজের উচ্চপর্যায়ে ছিল তার ব্যবসাক্ষেত্র। অন্তত ১৫ বছরের ছোট মুনীর গভীর প্রেমে পড়ে এই খুকুর। অবস্থা বেগতিক দেখে মেহেরুন্নেসা তার সামাজিক অবস্থানকে কাজে লাগিয়ে মুনীরকে বিয়ে করিয়ে এনেছিলেন সুন্দরী তরুনী রীমাকে।
মুনীর রীমাকে কোনদিনই মন থেকে মেনে নেয়নি। বরং সে সম্পর্ক রেখেছে খুকুর সাথে। খুকু-মুনীরের এই অবাধ সম্পর্কের মধ্যে রীমাকে উটকো ঝামেলা হিসেবে বিবেচনা করে সরিয়ে দেয়ার পরিকল্পনা করা হয়। তবে মূল খুনের ঘটনার ধারেকাছেও খুকু যায়নি। পরিকল্পনা অনুযায়ী মুনীর রীমাকে গাড়িতে করে ঘুরতে নিয়ে যায় মিজিমিজি গ্রামে এবং সেখানে হত্যা করে লাশ ফেলে আসে। উঠে এক সস্তা মানের হোটেলে এবং পাগলামী ও আত্মহত্যার নাটক করতে থাকে।
এই ঘটনাটা সেসময় ব্যপক আলোড়ন তোলে। সব পত্রিকায় বড় বড় স্টোরি ছাপা হয়। এটাকে বলা হয়, বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে আলোচিত খুনের মামলা। খুনের প্রায় মাসখানেক যাবত পত্রিকায় এটা প্রথম বা দ্বিতীয় লিড হিসেবে প্রকাশিত হত।
মূল খুনী মুনীর ছাড়াও পুলিশ প্ররোচনা দেয়া ও পরিকল্পনার অভিযোগে খুকু এবং সাহায্য করার অভিযোগে মুনীরের ব্যবসায়িক ম্যানেজারকে (লোকটার নাম ভুলে গেছি, খুব সম্ভব দীন মোহাম্মদ!) গ্রেফতার করে। নিম্ন আদালত ১৯৯০ সালের ২১শে মে খুকু-মুনীর দুইজনেরই ফাঁসীর আদেশ দেন। পরে উচ্চ আদালতে আপিল করলে খুকু প্রমানের অভাবে বেকসুর খালাস পান। নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষনে বলা হয়ে থাকে, মিডিয়ার অতিরিক্ত প্রচার আদালতকে খুকুর ফাঁসির আদেশ দিতে প্রভাবিত করেছিল। অনেকে আবার দাবি করেন, খুকু তৎকালীন ঢাবি'র শিক্ষক সমিতির সাধারন সম্পাদক ডঃ আক্তারুজ্জামানের শ্যালিকা বলে তাঁর প্রভাবেই ছাড়া পায়। খুকু আসলেই কতটা জানত বা কতটা অবদান রেখেছিল, সেটা শেষ পর্যন্ত একটা রহস্যই থেকে যায়। একটা ছোট্ট ঘটনা, আদালতের রায় ঘোষনার পরদিন পত্রিকায় একটা ছবি ছাপা হয়েছিল, খুকুর ছেলেরা রায় শুনে আদালতে চিৎকার করে তাদের মায়ের জন্য কাঁদছে। খুনী হোক, সমাজের নষ্ট মহিলা হোক, কলগার্ল হোক, কিন্তু খুকু একজন ভাল মা ছিল!
১৯৯৩ সালের জুলাই মাসের কোন এক সুন্দর ভোরে মুনীরের ফাঁসী কার্যকর করা হয়।
* এই মামলা চলাকালীন সময়ে বেশ অনেক গুজব বাজারে চালু হয়েছিল। এদের সত্যতা আমার জানা নাই। তবে তিনটা গুজবের কথা এখানে উল্লেখ করছি।
১) মেহেরুন্নেসা আদৌ বিশেষজ্ঞ বা ডাক্তার নন। আসলে উনি একজন নার্স ছিলেন। (আমার ব্যক্তিগত মত - জানি নারে ভাই, বাংলাদেশে সবই সম্ভব।)
২) মেহেরুন্নেসা রাস্ট্রপতির কাছে ছেলের জীবন ভিক্ষা চেয়েছিলেন এবং তার জীবনের বিনিময়ে সমস্ত সঞ্চয় দিয়ে একটা ফ্রি হাসপাতাল করে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। (আমার ব্যক্তিগত মত - হলেও হতে পারে।)
৩) ফাঁসী কার্যকর করার পর মুনীরের লাশ সাংবাদিকদের দেখানো হয়নি। এ ঘটনায় লোকে সন্দেহ করেছিল, হয়ত সরকার বড় অংকের ঘুষ নিয়ে রাতের অন্ধকারে মুনীরকে বিদেশ পাঠিয়ে দিয়েছে। (আমার ব্যক্তিগত মত - অসত্য।)
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে এপ্রিল, ২০১১ সকাল ১১:২২