ধরা যাক, রেললাইনের উপরে একজন মানুষ (নারী, বয়স ২৯, বিবাহিত, বাচ্চা নাই, স্বামী ফ্যাক্টরির মালিক, বেশিরভাগ সময় বাইরের লোকের সাথে সময় কাটায়, বাসায় থাকলেও কঠোর এবং ঠাণ্ডা আচরণ করে) জীবনের উদ্দেশ্য বা ইচ্ছা হারাইয়া আত্মহত্যা করার জন্যে দাঁড়াইয়া গেছেন।
তিনি চাইতেছেন "দুনিয়া যেমনে চলতেছে তেমনেই চলতে দেওয়া" উচিত। আত্মহত্যা কইরা তার হাজব্যান্ড এবং দুনিয়ার চলার পথ সুগম করা উচিৎ।
আপনি ঘটনাক্রমে রেললাইন পার হওয়ার সময়ে ওনারে দেইখা অভিসন্ধি বুঝতে পাইরা কৌতূহলবশতঃ খাড়াইয়া গেছেন তার পাশে। ওই মুহূর্তে কাছাকাছি অন্য লোক নাই যে তারে এই আকাম থিকা সরাইতে পারে, কেবল আপনিই।
অল্প দূরে ট্রেন আসতেছে, হর্ন বাজাইতেছে, আপনি তা দেখতেছেন শুনতেছেন, সিনেমা বা নাটকের মতই। কিন্তু কী করবেন বুঝতে পারতেছেন না। কারণ আপনি দর্শন চর্চা করেন!
আপনি চাইলে আত্মহত্যা করতে চাওয়া মেয়েটারে ধাক্কা দিয়া সরাইয়া দিতে পারেন। আবার চাইলে কোনো কিছু না কইরা দুনিয়া যেমনে চলতেছে তেমনেই চলতে দিত পারেন, মেয়েটার লণ্ডভণ্ড চিড়াচ্যাপ্টা মাথা ও শরীরের উপর দিয়া।
আপনি কোনটা করবেন?
চাইবেন তার আত্মহত্যা সে করুক। আপনি কিছু করবেন না?
২.
এইখানে "দুনিয়া যেমনে চলতেছে তেমনেই চলতে দেওয়া উচিৎ" বলতে আসলে কী বোঝাবে?
তারে ধাক্কা দিয়া সরাইয়া দেওয়া? চুপচাপ দাঁড়াইয়া থাইকা তারে আত্মহত্যা করতে দেওয়া?
কোনটা?
৩.
পৃথিবীর কোনো ঘটনাই এমনে এমনে ঘটে না। যেগুলি এমনি এমনি ঘটে সেগুলি হচ্ছে বিপর্যয়, দুর্যোগ বা দুর্ঘটনা ও অন্য কাজের ফলাফল বা প্রতিক্রিয়া ইত্যাদি।
বাকি যেগুলি কাজ সেগুলি আমরা ইচ্ছা দিয়া করি বইলাই কাজ।
কাজ মাত্রই আমি যেইটা চাই, সেইটা করা। আমি যা চাই না তা যখন করি সেইটা কাজ না, সেইটা হইল শ্রম দেওয়া।
ভারতে ও পৃথিবীতে বহু দর্শন আছে যেগুলি চেষ্টা না করার দর্শন। আমি সেগুলির নাম বললাম না, তর্ক এড়াইতে।
এই ফিলসফি বা বাদগুলি মানুষের ঘটনা ঘটানোর বা কাজ সম্পন্ন করার ইচ্ছার মূল্য দেয় না। ইচ্ছাটাও যে একটা হওয়া বা করা এসব তত্ত্বে তার গুরুত্ব বা উল্লেখ নাই।
ব্যক্তি ও ব্যক্তির ইচ্ছারে বাদ দিয়া জগৎ নির্মাণ হইল দার্শনিক ভ্রান্তি। কেননা ব্যক্তির ক্ষেত্রে তার দুনিয়া মানে তার কাজ এবং তার চিন্তাও। কেবল ফলাফল বা কাজের ফলাফলই দর্শন নয়। কাজ বা ইচ্ছা করতে থাকাটারও মূল্য অপরিসীম।
৪.
মানে হইল, সভ্যতায় কাজের মূল্য আছে। সভ্যতা তৈরিই হইছে কাজ দিয়া। অর্থাৎ মানুষের ইচ্ছার উদ্দেশ্যমূলক প্রয়োগ দিয়া।
"যা হওয়ার তা হবে" বা "দুনিয়া যেমনে চলতেছে তেমনেই চলতে দেও" দিয়া সভ্যতা তৈরি হয় নাই। বরং জঙ্গল ও সমুদ্র তৈরি হইছে।
এই "যা হওয়ার তাই হবে" দার্শনিকতার মূল সমস্যা হইল এইটা সমাজ ও সভ্যতায় মানুষের কাজ ও কাজ এর প্রয়োগরে অস্বীকার করে।
৫.
তো আপনি কী করবেন, মেয়েটারে বাঁচাইবেন নাকি মরতে দিবেন? যেইটাই করেন তা কি আপনার ইচ্ছার উপরে নির্ভরশীল না?