ফ্যাসিস্ট আওয়ামী শাসনের ১৬ বছরের দুঃশাসন, দমন-পীড়ন, গণহত্যা ও দুর্নীতির অবসান হয়েছে, তবে ক্ষমতার পালাবদলের পরে দেশ এখন এক নতুন সংকটের মুখোমুখি। আইনশৃঙ্খলার অবনতি ও মৌলবাদী ইসলামপন্থীদের ক্ষমতায়নের ফলে তথাকথিত "তৌহিদি জনতা" নামক একটি গোষ্ঠীর উত্থান গভীর উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রায় প্রতিদিন এরা ভয়াবহ উপদ্রব সৃষ্টি করছে। সম্প্রতি, বইমেলায় স্টল বন্ধ করা, বইমেলায় স্যানিটারি পণ্যের বিতরণে বাধা সৃষ্টি করা, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনগুলোর নাম যেমন সত্যেন্দ্রনাথ বসু, জগদীশ চন্দ্র বসু, প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, জীবনানন্দ দাশ এর পরিবর্তন, কিংবা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের শিশুকে ধর্মান্তরিত করার মতো ঘটনাগুলো সামনে এসেছে।
অন্যদিকে, তৌহিদি জনতার দুষ্কর্মে সবচেয়ে বেশি লাভবান হচ্ছে ক্ষমতাচ্যুত স্বৈরাচারীরা, যারা দীর্ঘদিন ধরে দাবি করে এসেছে যে তাদের অনুপস্থিতি মানেই দেশ আফগানিস্তানের পথে এগোনো। তৌহিদি জনতার উগ্র কর্মকাণ্ড দেখে তারা এখন বলতে পারছে - "আমরা তো আগেই বলেছিলাম!"
বর্তমানে বাংলাদেশের রাজনীতির মাঠে এখন বিএনপি ও জামাত উভয়ে খুব সক্রিয়। বিএনপি বিগত বছরগুলোতে জামাতের প্রভাবমুক্ত হওয়ার চেষ্টা করেছে এবং বর্তমান প্রেক্ষাপটে তারা নিজেদের আরও প্রগতিশীল হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছে। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর স্পষ্টভাবে রাজনীতিকে শরিয়াতন্ত্র থেকে আলাদা রাখার কথা বলেছেন। বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায়, যেখানে সমাজ বহুত্ববাদী ও বহুসাংস্কৃতিক সহাবস্থানের দিকে যাচ্ছে, সেখানে বিএনপির এই প্রচেষ্টা তাদের রাজনৈতিক বিচক্ষণতা বলে মনে করি।
আওয়ামী রাজনীতি তাদের অবৈধ ক্ষমতাকে রক্ষা এবং অপকর্মের ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার কারণ হিসেবে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা, নারীর ক্ষমতায়ন এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার যথেচ্ছ ব্যবহার করেছে এটা সত্যি, তবে এটাও অস্বীকার করা যাবে না যে তাদের পলায়নের ফলে সংখ্যালঘুদের অধিকার এবং নিরাপত্তার ক্ষেত্রে ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে বিএনপি যখন অসাম্প্রদায়িক শক্তি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছে, তখন জামাত বিএনপির বিরুদ্ধে মিথ্যা অপপ্রচারে নেমেছে।
জামাতের রাজনীতির সবচেয়ে বড় অস্ত্র হলো ঘৃণা। বিভিন্ন সময়ে তারা একেকটি ঘৃণার মন্ত্র তৈরি করে, এবং এই ঘৃণার মন্ত্রের তীব্রতার ওপর নির্ভর করে রাজনীতির মাঠে তাদের সাময়িক সাফল্য। ঘৃণার অংশ হিসেবে তারা বিএনপিকে "ভারতঘেঁষা" বলে চিহ্নিত করার চেষ্টা করছে। জামাতের সবচেয়ে বড় কৌশল হলো সংস্কৃতির রাজনীতির মাধ্যমে মানুষের মগজধোলাই করা। স্বল্পমাত্রার আফিম হিসেবে জামাতের কৌশলগুলো মোটামুটি কাজ করে। যেমন, যখন তারা জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের প্রসঙ্গ তোলে বা মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে সন্দেহ সৃষ্টি করে, তখন তথাকথিত একটি শ্রেণীও হুক্কাহুয়া রব তোলে।
তবে আফিমের প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী হয় না বলেই আমার বিশ্বাস। বাঙালি সংস্কৃতির শিকড় মাটির গভীরে প্রোথিত এবং সেই গভীরে গিয়ে ইসলাম ধর্মের সঙ্গে এর মিলন ঘটেছে। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমাদের সংস্কৃতির এই তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
জামাতের সংকীর্ণ মতাদর্শ কলুর বলদের মতো একই অন্ধকারে ঘুরপাক খায়, সামনে এগোতে পারে না। আর মানুষের সত্য ধর্ম হলো ভবঘুরে পরিব্রাজকের মতো, যা যুক্তি-বুদ্ধি দিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে চলে। পথ চলতে গিয়ে বাধা আসে কখনো, তবু সামনের দিকেই তার লক্ষ। তাই ইসলামপন্থীরা মিথ্যা প্রচারণা ও মগজধোলাই করে ক্ষমতায় যেতে পারবে, এমনটা মনে করি না।
(বিঃদ্রঃ - র্যাডিকাল ইসলামিস্ট বলতে তাদের বোঝানো হয়, যারা ইসলামী মৌলবাদকে সমর্থন করেন এবং রাষ্ট্রনীতি, সরকারব্যবস্থা, রাজনীতি ও সমাজে শরিয়াতন্ত্র বা ইসলামী আইনের পক্ষে মত দেন।)