অমর্ত্য সেন বলেছেন "আমি নিজেও একজন হিন্দু। হিন্দুধর্ম নিয়ে আমার কোনোই আপত্তি নেই"। তার আপত্তি হিন্দুত্ববাদী চিন্তার আধিপত্য বেড়ে যাওয়া নিয়ে। সমস্যাটি মানুষের ধর্ম বা ধর্ম পালনের মধ্যে নয়, সমস্যাটি ধর্মান্ধতার যখন অন্যের ধর্ম বা জীবনাচারের প্রতি আমরা অসহিষ্ণু এবং বিদ্বেষ পোষণ করি।
ধর্ম পালনের স্বাধীনতা মানুষের মৌলিক অধিকারগুলোর একটি। মানুষের জীবন-জিজ্ঞাসার বড় অংশ জুড়ে আছে ধর্ম। ধর্ম পালনের মধ্য দিয়ে মানুষ তার আত্ম অনুসন্ধান করে, জীবন-মৃত্যুর সমীকরণ রচনা করে, মৃত্যুর পরে যে অনন্ত জীবন সেই জীবনের পাথেয় সঞ্চয় করে।
ধর্ম পালন করতে গিয়ে নিজের চারপাশে দেয়াল গড়ে তোলার পক্ষপাতী আমি নই। দরজা জানালা খোলা রেখেই ধর্ম পালন করা যায়, তার জন্য অন্ধকারে ঢোকার প্রয়োজন হয় না। যখন আমি শুধু আমার ধর্ম পালন করে সন্তুষ্ট নই তখন সমস্যাটি তৈরি হয়। ধর্ম পালনের অংশ হিসেবে অন্যকে "অভিশপ্ত" বলা বা অন্য সকল ধর্মকে বাতিল করা ধর্মান্ধতা। অন্য ধর্মাবলম্বীদের কেউ যখন "অভিশপ্ত" বলে উল্লেখ করে এবং সেকাজে মানুষের সমর্থন দেখি তখন নিদারুণ হতাশা বোধ করি। কোন পোস্টে যখন এই লেখাটি শুধু মোমিনদের জন্য, অন্যদের পড়ার প্রয়োজন নেই - এ জাতীয় কথার উল্লেখ দেখি তখন সাম্প্রদায়িকতা দেখে পীড়িত হই। সেইসব লেখকদের এর জন্য দায়ী করতে চাই না। আমি মনে করি এর জন্য আমাদের সমাজ, শিক্ষা ব্যবস্থা, রাজনৈতিক পরিস্থিতি সবকিছুই কমবেশি দায়ী। এ দায় সামষ্টিকভাবে আমাদের সকলের উপরেই বর্তায়।
ব্লগে ধর্মীয় লেখায় আমার আপত্তি নেই, তবে সেই লেখাগুলো সকলের জন্য হওয়া প্রয়োজন। হিন্দু-মুসলিম-খ্রীষ্টান-বৌদ্ধ সহ সকলে যেন সেই লেখার পাঠক হতে পারেন এবং আলোচনায় অংশ নিতে পারেন। আর লেখাটি যদি আলোচনার বিষয় বস্তু না হয়ে শুধু মাত্র নীরবে মেনে নেবার বা বিশ্বাসের বিষয় বস্তু হয়, তাহলে সে লেখা ব্লগের জন্য কতখানি উপযুক্ত ভেবে দেখা প্রয়োজন। কালেভদ্রে কিছু কিছু ধর্মীয় লেখায় মন্তব্য করে থাকি। কিছুদিন আগে এমন একটি লেখা ছিল যার বিষয়বস্তু ছিল দোজখে যাওয়ার পরে আল্লাহকে কেউ কেউ বুঝবে এই প্রসঙ্গে। সেখানে মন্তব্য করেছিলাম যে, এমনটি হওয়ার কোন সম্ভাবনা আছে কী যে কেউ কেউ আল্লাহকে বুঝবেন বেহেস্তে যাওয়ার পরে। উদাহরণ হিসেবে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের প্রসঙ্গ টেনেছিলাম। বিদ্যাসাগর জীবনে ধর্ম-কর্ম করেন নি, কিন্তু বিদ্যাসাগরকে দেখে রামকৃষ্ণ পরমহংস বলেছিলেন যে তার সিদ্ধিলাভ হয়ে গেছে। বিদ্যাসাগর হেসে উত্তর দিয়েছিলেন, "কী যে বলেন মশাই, জীবনে কোন দিন ঠাকুর দেবতার নাম নিলাম না, আর আপনি বলেন সিদ্ধিলাভ হয়ে গেছে"! পরে আমার মনে হলো, যে লোকের পোস্টে এই মন্তব্যটি করেছিলাম সেখানে বিদ্যাসাগরের প্রসঙ্গ অপ্রাসঙ্গিক, কেননা খুব সম্ভবত বিদ্যাসাগর বিধর্মী বলেই বাই ডিফল্ট জাহান্নামি। হয়ত শুধু বিদ্যাসাগর নয়, স্বয়ং রামকৃষ্ণ জাহান্নামি!
এ ধরনের আরো কিছু পোস্টে মন্তব্য করতে গিয়ে অনুভব করলাম যে আমাদের মধ্যে যারা ধর্ম বিষয়ে লেখালেখি করেন তাদের সিলেবাসে বিদ্যাসাগর নেই, রবীন্দ্রনাথ নেই, শরৎচন্দ্র বা বিভূতিভূষণ কেউ নেই। কেননা তাদের বিশ্বাস অনুসারে তারা সকলেই "অভিশপ্ত"। যাদের সিলেবাসে বিদ্যাসাগর বা রবীন্দ্রনাথ নেই তাদের সিলেবাস কী করে বাড়িয়ে প্লাটো-অ্যারিস্টোটল-লক-হিউম-দেকার্তে থেকে কান্ট-হেগেল-স্পিনোজা-মার্কস পারি দিয়ে বার্ট্রান্ড রাসেল থেকে মিশেল ফুকো হয়ে অমর্ত্য সেন পর্যন্ত নিয়ে আশা যায় সেটা আমার অজানা। অভিশপ্তদের তালিকা যে অতিশয় লম্বা!
ধর্মান্ধতা এবং সংকীর্ণ চিন্তা আমাদের সামনের দিকে চালিত করে না। দরজা-জানালা বন্ধ করে দিয়ে, কবরের অন্ধকারে বসে জ্ঞান আলোচনা শুধু নয় কার্যকরী কোন আলোচনাই সম্ভব নয়। বলা হয়ে থাকে শিক্ষা কে হতে হবে সার্বজনীন আর জ্ঞান হলো সেটি যা মানুষের মধ্যে ভেদাভেদ ঘুচিয়ে ঐক্য তৈরি করে।
শুরু করেছিলাম অমর্ত্য সেনের একটি উক্তি দিয়ে। যারা তাঁর লেখার সাথে সুপরিচিত তাঁরা জানেন যে অমর্ত্য সেন কারণে অকারণে বাংলাদেশের ভূয়সী প্রশংসা করেন। ঐ সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন "হিন্দুত্ববাদী চিন্তায় যে ধরনের সংকীর্ণতা আছে, বাংলাদেশে মুসলমানদের চিন্তায় সেই রকমের সংকীর্ণতা নেই।" অমর্ত্য সেনের এই কথাটি সত্যি হলে খুব খুশি হতাম, কিন্তু জানি একথা সত্যি নয়। চিন্তার সংকীর্ণতায় হিন্দুত্ববাদীদের চেয়ে আমাদের মোল্লারা শুধু নয় তথাকথিত শিক্ষিতেরাও কম এগিয়ে নেই। নিজের চারপাশে সংস্কারের দেয়ালগুলো ভেঙ্গে ফেলতে পারাটা কঠিন কাজ। সে কাজের জন্য সুশিক্ষা এবং পঠন-পাঠনের বিকল্প নেই।
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই মার্চ, ২০২৪ ভোর ৪:০৩