কবরের জগত অবরুদ্ধ। দুনিয়ার সাথে এর কোনো যোগাযোগ নাই । চিঠি-পত্র, টেলিফোন, ইন্টারনেট, টেলিগ্রাম ও অন্য কোনো উপায়ে যোগাযোগ সম্ভব হয় না । মানুষ যদি কবরের অবস্থা জানতে পারতো, তাহলে হেদায়াতের জন্য এত প্রচেষ্টার প্রয়োজন হতো না । কবরের চিত্র জীবনের প্রতিটি স্থানে ও স্তরে প্রভাব বিস্তার করত। মূলত দুনিয়াটাই একটা বৃহত্তর কবর পুরীতে পরিণত হয়ে যেত । মাটির উপরের মানুষ যদি মাটির নিচের মানুষের অবস্থা জানতে পারত, তাহলে তার অভাব-অনটন ও প্রয়োজন পূরণ করতে সক্ষম হত। কিন্তু হায়! তাতো সম্ভব নয় । অথচ পায়ের নীচে সর্বত্রই বনি আদমের লাশ দাফন করা হয়েছে । যদি ও আমরা তা জানি না ।
দুনিয়ার অর্থ-সম্পদ মানুষকে মৃত্যু ও দীনদারী থেকে ভুলিয়ে রাখে । অথচ অর্থ সম্পদ ক্ষণস্থায়ী । সে সম্পদের পেছনে সকল সমু ব্যয় হয়ে যায়।
রাসূলুল্লাহ (সা) বলেনঃ
অর্থঃ"তোমাদের মধো কে এমন আছে যার কাছে ওয়ারিসের সম্পদ নিজ সম্পদ অপেক্ষা বেশি প্রিয় ? তাঁরা উত্তর দেন, আমাদের মধো এমন কেউ নেই যার কাছে নিজ সম্পদ অপেক্ষা ওয়ারিসের সম্পদ অধিক প্রিয় । বরং নিজের সম্পদ ওয়ারিশের সম্পদ অপেক্ষাই বেশি প্রিয় । তখন নবী (স) বলেনঃ নিজ সম্পদ বলতে বুঝায় যা সে অগ্রিম পাঠিয়ে দিয়েছে । আর যে সম্পদ অবশিষ্ট তা তো ওয়ারিসের ।" বুখারী
এ হাদিস সম্পদের ব্যাপারে মানুষের মোহ ও ভুল ভাংগিয়ে দিয়েছে । সে সম্পদ মানুষ খরচ করে কিংবা আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করে, সে তো ততটুকুরই মালিক । আর যা রেখে গেছে তা তো ওয়ারিসের , তার নয় । মানুষ ওয়ারিশের জন্যই সম্পদ রেখে যাচ্ছে, কিন্তু সেগুলোকে নিজের সম্পদ বলে ভুল করছে । কবি ঠিকই বলেছেনঃ
"পরের জায়গা পরের জমীন, ঘর বাঁধিয়া আমি রই,
আমি তো সেই ঘরের মালিক নই।"
দুনিয়ার অভাব পূরণের জন্য অগ্রিম নিশ্চয়তার ব্যবস্থা করা হয় । যেমন খাদ্যদ্রব্য মওজুদ করা, ব্যাংকে টাকা সন্ঞয়, বীমা, প্রভিডেন্ট ফান্ড, সার্ভিস বেনিফিট সহ আরো কত ব্যবস্থা আবিষ্কৃত হয়েছে । উদ্দেশ্য হচ্ছে, ভবিষ্যতের নিরাপত্তা ও নিশ্চয়তা বিধান করা । যাতে করে সুখ-শান্তিতে থাকা যায় ।
অনুরূপভাবে পরকালের , বিশেষ করে , কবরের অভাব ও প্রয়োজন পূরণের জন্য ও কিছু নিরাপত্তা নিশ্চয়তার ব্যবস্থা থাকা উত্তম । জীবদ্দশায় যদি কিছু ঘাটতি থেকে থাকে, তাহলে মৃত্যুর পর যাতে সে ঘাটতি পূরণের চেষ্টা করা সম্ভব হয়। তখনকার ঘাটতিই আসল ঘাটতি । দুনিয়ার অভাব অনটন পূরণে অন্যেরা এগিয়ে আসলে ও পরকালের অভাব পূরণে কেউ এগিয়ে আসবে না । সেই ব্যবস্থা জীবদ্দশায় নিজেকে করে যেতে হবে । কে বুদ্ধিমান এ ক্ষেত্রেই তা বুঝা যাবে । কারণ বুদ্ধিমান লোকেরা সন্ঞয় ও বীমা করে । পরকালের সন্ঞয়ে আগ্রহী লোকদের জন্য রাসুলুল্লাহ (স) এক ব্যবস্থার কথা এরশাদ করেছেন ।
তিনি বলেছেনঃ অর্থঃ "যখন আদম সন্তান মারা যায়, তখন তার সকল আমল বন্ধ হয়ে যায় । মাত্র তিনটি আমলের সওয়াব বাকি থাকে । সেগুলো হচ্ছেঃ (১) সদকাহ জারিয়াহ, (২) যে এলম দ্বারা উপকার সাধন করা যায় এবং (৩) নেক সন্তান যে মা-বাপের জন্য দোয়া করে । -মুসলিম
এ হাদিসটিকে ব্যাখ্যা করলে আমরা যে সকল নেক কাজের সওয়াব কবরে পৌঁছে তার একটা পরিষ্কার চিত্র পাবো । আসুন প্রথমে আমরা সদকা জারিয়াহ সম্পর্কে আলোচনা করি ।
সদকাহ
সদকাহ অর্থ দান করা । টাকা-পয়সা ও অর্থ-সম্পদ দান করাকে সদকাহ বলে । দান - সদকাহ দু' ধারনের হয়ে থাকে ।
১. সাধারন দান-সদকাহ
যে দান-সদকাহর ফলাফল অল্প সময়ের জন্য সীমিত , তাকে সাধারণ দান-সদকা বলে । যেমন অভুক্তকে খাবার দেয়া এবং ফকীরকে ভিক্ষা দেয়া ইত্যাদি । এ অর্থ-সম্পদ নির্দিষ্ট প্রয়োজন পূরণের মধ্য দিয়ে ক্ষণস্থায়ী ফল দান করে । এর ফলাফল দীর্ঘস্থায়ী নয় । তবু ও মানুষকে এ দান সদকাহ করতে হবে ।
২.সদকাহ জারিয়াহ
যে দান সদকার ফলাফল দীর্ঘস্থায়ী হয়ে থাকে তাকে সদকাহ জারিয়াহ বলে, দীর্ঘস্থায়ী বলতে অল্পদীর্ঘ ও হতে পারে কিংবা বেশি দীর্ঘ ও হতে পারে, আবার তা কেয়ামত পর্যন্ত ও দীর্ঘ হতে পারে । যেমন কোনো মসজিদ মাদ্রাসা নির্মাণ, রাস্তা-ঘাট, পুল নির্মাণ, খাল ও পুকুর খনন, লোকদের জন্য কোন জনকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা এবং নেক কাজের জন্য জায়গা ও অর্থ-সম্পত্তি ওয়াকফ করে দেয়া ইত্যাদি । যে কোনো ধরণের সমাজকল্যাণ ও জনকল্যাণমূলক কাজ ও সদকাহ জারিয়ার অন্তর্ভুক্ত । কোনো কোনো সমাজকল্যাণমূলক কাজের সুফল সুধূর প্রসারী ও দীর্ঘস্থায়ী হয়ে থাকে । কৃষি, স্বাস্হ্য, শিল্প ও অন্যান্য ক্ষেত্রে জনকল্যাণ ও জনহিতকর কার্যক্রম ও সদকাহ জারিয়ার পর্যায়ভুক্ত। কোনো রোগের ঔষধ, যন্ত্রপাতি, বাস, ট্রেন ও বিমান আবিষ্কার ও এর অন্তর্ভুক্ত । ডায়াবেটিক সমিতির মাধ্যমে বহুমূত্র রোগীদের বিরাট সেবা আন্জাম দেয়া হচ্ছে এটা ও সদকাহ জারিয়ার অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কথা । উলেখ্য, অর্থ ছাড়া এ জাতীয় কোনো সামাজিক এবং অর্থনৈতিক জনহিতকর প্রকল্প দাঁড় করানো সম্ভব নয় । সাথে জ্ঞান-বুদ্ধি এবং প্রজ্ঞাও খরচ করতে হবে । সদকাহ জারিয়ার লক্ষ্য হল জনকল্যাণ । সমাজকল্যাণ ও জনকল্যান হচ্ছে সদকাহ জারিয়ার প্রকৃতি ।
মৃতের আত্মীয়-স্বজন ও তার জন্য আল্লাহর রাস্তায় দান সদকাহ করতে পারে । এর সওয়াব মুর্দার-এর কবরে পৌঁছবে এবং বিপদ মুক্তির কারণ হবে । হযরত সাদ বিন ওবাদাহ থেকে বর্ণিত। তিনি মৃত মায়ের উদ্দেশ্যে নিজ বাগানটি দান করে দিয়েছিলেন ।
দ্বিতীয়ত, উপকারী ইলম । এখানে ইলমের খেদমত বলতে সেই ইলমকে বুঝানো হয়েছে, যার দ্বারা মানুষের উপকার হয় । দীনি ইলমের উপকার হচ্ছে অন্যতম । দুনিয়াবী জ্ঞানের উপকার ও এর অন্তর্ভুক্ত । যেমন জ্ঞান-বিজ্ঞানের যে শাখা দুনিয়ার জীবনে মানুষের উপকার সাধন করে তা সওয়াবের বিষয় । সে অনুযায়ী, জ্ঞানী গুণীদের জ্ঞান চর্চা এবং আবিষ্কারের ফসল দ্বারা মানুষ উপকৃত হলে তারা অবশ্যই সওয়াব পাবেন । সেজন্য মুসলিম জ্ঞানী ও পন্ডিত ব্যক্তিদের এমন জ্ঞানচর্চা করা উচিত যার উদ্দেশ্য মানুষের কল্যাণ সাধন করা । হাদিসে বর্ণিত উপকারী জ্ঞান এ দু' ব্যাপক অর্থ বহন করে । অবশ্য উক্ত জ্ঞান ইসলাম বিরোধি হতে পারবে না ।
দীনি জ্ঞানের চর্চা নিঃসন্দেহে সওয়াবের কাজ । কুরআন, হাদীস ফেকাহ, ইসলামের ইতিহাস সহ অন্যান্য বিষয়ের খেদমত সওয়াবের কাজ । সে জন্য মাদ্রসা ও ইসলামী লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠা করা যায় । ইসলামী কিতাব ও বই পুস্তক এবং পত্র-পত্রিকা প্রকাশ ও প্রচার করা যায় । এছাড়া ও শিক্ষকতা, বক্তৃতা, পোস্টার, লিফলেট ও ব্যানারের মাধ্যমে ইসলামী জ্ঞান ও ধ্যান-ধারণার বিকাশ ও প্রসার করা যায় । এগুলো সবই দ্বীনি ইলেমের সেবার অন্তর্ভুক্ত। যারা এ সকল মাধ্যমের ফলে দ্বীনি জ্ঞান লাভ করবে তাদের সওয়াব মাধ্যম প্রতিষ্ঠাতার কবরে পৌঁছবে । উদাহরণ স্বরুপ বলা যায়, কেউ কাউকে কোনো বিষয়ে জ্ঞান দান করার পর মারা গেলে তার ছাত্ররা অন্যদের মধো ইলমের খেদমত করবে । এভাবে কেয়ামত পর্যন্ত ঐ ধারা চালু থাকবে এবং মৃত ব্যক্তিও কবরে কিয়ামত পর্যন্ত সেই সওয়াব লাভ করতে থাকবে । এভাবে অন্যান্য বিষয়গুলোর উদাহরণো প্রযোজ্য।
তৃতীয়ত, নেক সন্তান মা-বাপের জন্য দোআ করলে, মা-বাপ কবরে এর সুফল পাবে । হাদীসে নেক সন্তনের কথা বলা হয়েছে । সন্তান নেক হলে, মা-বাপের জন্য দোয়া করবে । সন্তান পাপী হলে, সে নিজের কল্যাণের জন্যই যখন নেক কাজ করে না, তখন মা-বাপের কল্যাণের প্রশ্নই আসতে পারে না । সে জন্য সন্তানকে ঈমানদার , নেক, চরিত্রবান, উন্নত আমল -আখলাক ও যোগ্যতা সম্পন্ন করে গড়ে তুলতে হবে । যে সন্তান কুরআন ও হাদীসের জ্ঞান অর্জন করে এবং সে অনুযায়ী ব্যক্তি, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আমল বা কাজ করে সে সন্তান মা-বাপের জন্য আল্লাহর বিরাট রহমত ও নেয়ামত । পক্ষান্তরে, যে সন্তান ইসলামী যিন্দেগীর অনুসরণ করে না, সে মা-বাপের জন্য বিরাট অভিশাপ । কেননা, তাদের গোটা জীবনের কামাই-রোগার যার হাতে রেখে আসা হল, সেই সম্পদ ও সন্তান তাদের কোন কাজে আসল না । এর চেয়ে বড় আফসোস আর কি হতে পারে?
সকল মানুষের উচিৎ মৃতদের জন্য দোয়া করা । এই প্রসংগে রাসূলুল্লাহ (স) হতে একটি হাদীস বর্ণিত আছেঃ অর্থঃ "হযরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত । রাসূলুল্লাহ (স) বলেছেন, নিঃসন্দেহে মৃত ব্যক্তির উদারহণ হলো পানিতে পড়া সাহাযয় প্রার্থী সেই ব্যক্তির মত, যে তার মা-বাপ এবং ভাই বন্ধুর দোয়ার অপেক্ষায় থাকে । যখন তার কাছে দোআ পৌঁছে, তখন তার কাছে তা দুনিয়ার সকল জিনিসের চেয়ে প্রিয়তম মনে হয় । আল্লাহ কবরবাসীদেরকে যমীনবাসীদের দোআর কারণে পাহাড় সমান রহমত দান করেন । জীবিতদের পক্ষ থেকে মৃতদের জন্য উপহার হচ্ছে এস্তেগফার বা ক্ষমা প্রার্থনা ।"- বায়হাকী শোআবুল ঈমান
এ হাদীসে মৃতদের জন্য দোয়ার ব্যাপারে যথেষ্ট উৎসাহিত করা হয়েছে । কেননা এ দোয়ার মাধ্যমে তারা পানিতে পড়া বিপদগ্রস্ত মানুষের মত কবরে বিপদ এবং আযাব থেকে রক্ষা পেতে পারে ।
প্রবাদ আছে, অর্থই সব অনর্থের মূল । খারাপ সন্তানের জন্য অধিক সম্পদ রেখে গেলে অর্থের কারণে তারা আরো বেশি খারাপ হওয়ার সুযোগ পায় । অথচ বর্ধিত অর্থ আল্লাহর রাস্তায় দান করে গেলে কবরের বিপদে বিরাট উপকারে আসতে পারত । সন্তানের জন্য সম্পদ রেখে যেতে হবে । রাসূলুল্লাহ (স) বলেছেন, তোমার সন্তানকে মানুষের কাছে হাত পেতে ভিক্ষা করার চেয়ে ধনী রেখে আসাই উত্তম । এখন এ দু' দৃষ্টিভংগীর মধো সুষ্ঠু সমন্বয় সাধান করতে হবে । তাই সন্তানকে অবশ্যই সুশিক্ষা এবং ইসলামী শিক্ষা দিতে হবে । এটা করতে পারলেই কবরে কাজে আসবে । নচেৎ ঐ সন্তানের কোনো মূল্য নেই ।
আত্মীয় এবং বন্ধ-বান্ধবরা যদি মৃতের জন্য দোআ করে তা যথেষ্ট উপকারে আসবে । এমনকি তারা যদি তার জন্য দান-সদকাহ করে তা দ্বারা সে কবরে উপক্রিত হবে ।
কেউ কুরআন শরীফ পড়ে তার সওয়াব মুর্দার জন্য পৌঁছাতে চাইলে এ বিষয়ে ওলামায়ে কেরামের দু'টো মত আছে । ১ প্রথমটা হচ্ছে, তা জায়েয নেই । কেননা , ইবাদত নিজের জন্যই করা হয়, অন্যের নয় । যেমন নামায রোজা ইত্যাদি আরেকজনের জন্য করা যায় না ।
দ্বিতীয় মত হচ্ছে, তা জায়েয । এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (স)-এর কাছে এসে নিজ মৃত মায়ের জন্য দান করার অনুমতি কামনা তিনি অনুমতি দেন । এতে বুঝা গেল যে, অন্যান্য কিছু ইবাদতের সওয়াব অন্যের জন্য পেশ করা যায় ।
কৃতজ্ঞতায় এ.এন.এম. সিরাজুল ইসলাম ।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে জানুয়ারি, ২০১৩ রাত ১০:০৩