অধিক ব্যবহারে শব্দের পুষ্টিগুণ হারায় যায়। এই কথা সিদ্দিকা কবীর বলে নাই, আমিই বলতেছি। গরীবের কথা মূল্যহীন হইলেও সত্যি।

এই যেমন "মনটা মরে গেছে" আর "মনমরা", জিনিস একই কিন্তু গভীরতায় কম-বেশ আছে। কেউ যখন বলে ছেলেটা মনমরা হয়ে আছে, আমরা স্বাভাবিকভাবেই নেই। প্রতিদিন একবার নিয়ম করে মনমরা হওয়াটা মানুষের দৈনিক পালনীয় প্রেসক্রিপশনের মধ্যেই পড়ে। তবে কেউ যখন বলে, ছেলেটার মন মরে গেছে! আমরা একটু চিন্তিত হই। ভাবি, আহারে! মনটা মরেই গেলো? বড় ভালো ছিলো মনটা!
মনমরা শব্দটা এত বেশি ব্যবহার করি যে এই মরায় কিছু যায় আসে না। মরা মন দিব্বি হেঁটে ঘুরে বেড়ায়। মনটা মরে গেছে বললে অভিব্যক্তির গভীরতা বাড়ে। কল্পনায় মন নামক বস্তুটাকে লাইফ সাপোর্ট দিয়ে রাখা হইছে এমন একটা দৃশ্য ভেসে উঠে।

শব্দের অধিক ব্যবহার্য্যের এই হচ্ছে ফলাফল। "ভালোবাসা" নামক শব্দটারও এই দশা হইছে। বাংলা সাহিত্যে অতি মাত্রায় ব্যবহারের ফলে এই শব্দ পানির মতো সর্বত্র গড়ায় গিয়ে মাখনের মতো লেপ্টে আছে। ভালোবাসা বলতে যে গভীরতম আবেগীয় অনুভূতি আমরা বুঝি, সে আবেগের অংশবিশেষও আর ভালোবাসা শব্দটার মধ্যে অবশিষ্ট নাই। মাঝেমধ্যে মনে হয় মা ছেলের মধ্যকার অনুভূতিটা, যাকে আমরা ঘুরে ফিরে ভালোবাসাই বলি সেই আবেগের সম্পূর্ণটা প্রকাশ করতে নতুন বাংলা শব্দ বানানো দরকার। কারণ বনে বাদাড়ে, জলে জঙ্গলে, অলিতে গলিতে, মুখের বুলিতে কিংবা ফেসবুকের ইমোর মাধ্যমে এই শব্দটা এতটা সরলীকৃত এবং অপুষ্ট হইছে যে ভালোবাসি আর মুড়ি খাই এক গোত্রীয় শব্দ মনে হয়!

শব্দটা যে দিন দিন গুণগত মান হারাচ্ছে এটা আমরা নিজেরাও একটু চোখ কান খোলা রাখলে বুঝতে পারি।
(যাদের প্রেমিক/প্রেমিকা আছে তারা হৃদয়ও খুলে রাখতে পারেন ফর বেটার এক্সপেরিয়েন্স!)
যেমন অনেক সময়ই দেখা যায় শুধু ভালোবাসায় চিড়া তথা হৃদয় ভিজে না। সেক্ষেত্রে বলতে হয় অনেক ভালোবাসি। তারপরও ঠিক স্বস্তি পাওয়া যায় না। মাঠে নামে "অনেক অনেক ভালোবাসি" স্কোয়াড। এরপর "অনেক অনেক বেশি... ..." ভালোবাসার পেছনে বিশেষণ যুক্ত হইতেই থাকে তাও মন ভরে না। আহারে কী দুঃখ দুর্দশা!

ভালো হয়, ভালোবাসা জিনিসটা নিজে আগে একটু অনুভব করতে শিখলে। তারপর বাপ-মা, ভাই-বোন, প্রেমিক/প্রেমিকা যাকে খুশি তাকে ভোটটা দিয়ে নিজের সামাজিক অধিকার পূর্ণ করেন। এক্ষেত্রে এক ফাইলই যথেষ্ট!

কেউ যখন ভালোবাসার পিছনে হাজার বিশেষণ লাগায়ও স্বস্তি পায় না, যা বলতে চাচ্ছে তা ঠিক বলা হইলো না ভাবটা থেকে যাওয়ায় বিশেষণ লাগাইতেই থাকে তখন মনে হয় বলি,
ভাই থামেন! সামনে নাই ইঞ্জিন, আপনে পিছনে বগি লাগায় কী করেন?
এবং কল্পনায় আমি পেটে ব্যথায় আক্রান্ত এক লোককে দেখতে পাই। যার পেটে ভীষণ ব্যথা। সে চিতকাত হয়ে, উল্টে পাল্টে, এপাশ ওপাশ করে, কোনভাবেই ঠিক করতে পারতেছে না কোন দিকে কাত হইলে ব্যথাটা একটু কম হবে!
(কাতা-কাতি টু বি কন্টিনিউড... লাইক এডিং বিশেষণস বিফোর ভালোবাসি!)
এভাবে হয় না। আর যাই হোক, ভালোবাসা হয় না। ভালোবাসা সত্যি হইলে না বলা কথায়ও ভালোবাসা প্রকাশ পায়। বাবা-মা, ছেলে-মেয়েদেরকে সমগ্র জীবনে কয়বার ভালোবাসি বলে? খুব বেশিবার হওয়ার কথা না। তবে এই ভালোবাসার মাত্রাটা এমন যে, আমরা যখন কোন কিছু খুব বেশি হইলে বলি সেটা আকাশ ছুঁইছে... এক্ষেত্রে বলতে হয় আকাশটা যদি অনেক উপরে হইতো তবে সেই ভালোবাসাটা স্পর্শ করতে পারতো! এই ভালোবাসা খাতায় সহস্রবার ভালোবাসি লিখলেও কিছুমাত্র প্রকাশ হয় না।
হৃদয়ে কিছুমিছু অনুভব না করে সাদা পাতায় রক্তাক্ষরে ভালোবাসি লিখলেও সেটা শেষ পর্যন্ত ব্লাড ডোনেট হয়। ভালোবাসা আর হয় না!