বিশ্বকোষ শব্দটি বছর দশেক আগেও বোঝাতো মোটাসোটা ২০ খণ্ডের, দামি চামড়ায় বাঁধাই করা, লাইব্রেরিতে কিংবা উচ্চবিত্তদের ঘরের আলমারিতে শোভা পাওয়া একগুচ্ছ বইপত্র। দামের কারণে যা আম-জনতার অনেকেরই নাগালের বাইরে। খ্যাতনামা বিজ্ঞ বিশেষজ্ঞদের হাতে লেখা হতো নিবন্ধগুলো। হাজার বছর ধরে চলে আসা বিশ্বকোষের এই ধারণাতে চিড় ধরেছিলো আজ থেকে ১০ বছর আগে। ২০০১ সালের ১৫ই জানুয়ারি খুব ছোট্ট একটা ঘটনা ঘটেছিলো -- জিমি ওয়েলস নামের এক মার্কিন ব্যবসায়ী এবং ল্যারি স্যাঙ্গার উইকি নামের স্বল্পপরিচিত একটি তথ্যপ্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে শুরু করেছিলেন একটি ওয়েবসাইট, যার উদ্দেশ্য ছিলো বিশ্বকোষ লেখা ও পড়ার ব্যাপারটাকে জনগণের আরো কাছে নিয়ে আসা। আর এই ওয়েবসাইটটিই হলো উইকিপিডিয়া -- ২০১১ সালের জানুয়ারির ১৫ তারিখে যার ১০ বছর পূর্তী হচ্ছে। বিশ্বের ইতিহাসে সর্বকালের সবচেয়ে বড়ো বিশ্বকোষ হিসাবে উইকিপিডিয়া আত্মপ্রকাশ করেছে -- ইতিহাসের কোনো সময়েই দেখা যায়নি এতো বিশাল পরিসরে কয়েকশো ভাষায় বিশ্বকোষ লেখার এরকম প্রয়াস।
জ্ঞান-বিজ্ঞানকে একসাথে জড়ো করে রাখার প্রচেষ্টা কিন্তু আজকের নয়। আজ থেকে প্রায় দুই হাজারেরও বেশি বছর আগে অ্যারিস্টোটল লিখেছিলেন বিশ্বকোষ। তাঁর পর ইতিহাসবিদ প্লিনি লিখেন ৩৭ খন্ডে এক বিশাল বিশ্বকোষ। ৯ম শতকে এরকম একটি বিশ্বকোষ তৈরীর কাজ করেন চীনা পন্ডিতরা। মুসলিম বিজ্ঞানী আবু বকর আল রাযী লিখেন বিজ্ঞানের বিশ্বকোষ। ইবনে সিনা লিখেছেন চিকিৎসার বিশ্বকোষ। অষ্টাদশ শতকে ফরাসি দার্শনিকেরা ২৯ বছর চেষ্টা করে লিখেন একটি বিশ্বকোষ। তার জবাবে ১৭৬৮ সালে স্কটল্যান্ডে অনেক জন বিশেষজ্ঞের প্রচেষ্টায় ব্রিটেনে তৈরী হয় এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার প্রথম সংস্করণ, ৩ খন্ডে। বাংলা ভাষায় প্রথম বিশ্বকোষ রচনা করা হয় সেই উনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে, নরেন্দ্রনাথ বসুর হাতে। বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে বাংলাদেশের এশিয়াটিক সোসাইটির উদ্যোগে ও সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় তৈরী হয় বাংলা ভাষার বিশ্বকোষ বাংলাপিডিয়া।
প্রথাগত বিশ্বকোষ ছাপার বইভিত্ত্বিক হওয়ায় বিশ্বকোষ কেনাটা অনেকের পক্ষেই অসম্ভব। আর বিশ্বকোষের বিস্তীর্ণ জ্ঞানভাণ্ডারের পরিসর চিন্তা করলে যেকোনো সংস্থার পক্ষেই বিশ্বকোষ তৈরী করাটা বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার। এই ব্যাপারটা চিন্তা করে ২০০০ সালের দিকে জিমি ওয়েলস নামে একজন ব্যবসায়ী একটি অনলাইন বিশ্বকোষ তৈরীর উদ্যোগ নেন। এর নাম দেয়া হয় নুপিডিয়া (NuPedia)। এটা অবশ্য বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য স্থানের শিক্ষক ও বিশেষজ্ঞদের সহযোগিতায় তৈরীর কথা ছিলো। কিন্তু এক বছর কেটে গেলেও দেখা গেলো যে, মাত্র গোটা বিশেকের বেশি নিবন্ধ শুরু করা যায় নি। ২০০১ সালে জিমি ওয়েলসের সহযোগী ল্যারি স্যাঙ্গার তাঁকে পরামর্শ দেন যে, উইকি প্রযুক্তি ব্যবহার করে একটি পুরাপুরি উন্মুক্ত বিশ্বকোষ তৈরী করার জন্য। উইকি প্রযুক্তির মূল ধারণাটি হলো, ওয়েবসাইটের পাতাগুলো পাঠকেরা সম্পাদনা ও হালনাগাদ করতে পারেন। শুরুতে কেউ ভাবতেই পারেনি এটা ব্যবহার করে বিশ্বকোষ লেখা আসলে সম্ভব। কিন্তু অল্প কিছু দিনের মধ্যেই হাজার কয়েক নিবন্ধ তৈরী হয়ে গেলো -- উইকিপিডিয়ার আত্ম প্রকাশ ঘটলো ইংরেজি ভাষায়। ইংরেজির পর আস্তে আস্তে নানা ভাষায় উইকিপিডিয়ার আবির্ভাব হতে থাকে, আমাদের বাংলা ভাষার উইকিপিডিয়ারও পত্তন ঘটে ২০০৪ সালের শেষভাগে (http://bn.wikipedia.org)।
অন্যান্য বিশ্বকোষের সাথে উইকিপিডিয়ার বড়ো ধরণের কিছু পার্থক্য আছে। প্রথাগত বিশ্বকোষগুলোর প্রতিটি নিবন্ধ একজন বা অল্প কয়েকজন বিশেষজ্ঞের একটি দলের হাতে লেখা হয়। নিবন্ধের তথ্য ও দৃষ্টিভঙ্গী তাই সেই একজন বা গুটিকয়েক বিশেষজ্ঞের জ্ঞান ও চিন্তাধারার প্রতিফলন ঘটে। কিন্তু উইকিপিডিয়ার যে কোনো নিবন্ধ যে কেউ সম্পাদনা করতে পারে। ফলে প্রতিটি নিবন্ধের সর্বশেষ সংস্করণে বহু বহু ব্যক্তির অবদান থাকে। এর সুবিধাটি হলো, তথ্যের পরিপূর্ণতা এবং নিরপেক্ষতা। কোনো বিষয়েই আসলে একজন বা গুটিকয় বিশেষজ্ঞ সব খুঁটিনাটি নাও জানতে পারেন। পক্ষান্তরে আমাদের সবার কাছেই হয়তো বিষয়টি নিয়ে কিছু না কিছু তথ্য জানা আছে। উইকিপিডিয়ার দর্শনটি হলো, গুটি কয়েক বিশেষজ্ঞের গভীর জ্ঞানের চাইতে বহু মানুষের জানা অল্প অল্প তথ্যগুলোর সংকলন অনেক বেশি পরিপূর্ণ। এছাড়া সব মতের মানুষ কোনো লেখা সম্পাদনা করলে তাতে কোনো বিশেষ মতাদর্শের প্রভাব পড়ার সম্ভাবনাও কম।
বিশ্বকোষ লেখার উইকিপিডিয়া মডেলটির শক্তি ও সাফল্য শুরুতে কেউই আঁচ করতে পারেনি। অবিশেষজ্ঞদের হাতে উচ্চমানের বিশ্বকোষ লেখা সম্ভব -- এটা অনেকেই বিশ্বাস করতে পারেনি। আর যে ওয়েবসাইট যে কেউ নামে বা বেনামে সম্পাদনা করতে পারে, সেটা হিজিবিজি লেখায় ভরে যাবে, এটাও ছিলো অনেকের ধারণা। কিন্তু সবার ধারণাকে ভুল প্রমাণ করে উইকিপিডিয়া আজ আত্মপ্রকাশ করেছে বিশ্বের সবচেয়ে বড়ো ও বহুল ব্যবহৃত জ্ঞানভাণ্ডার হিসাবে। নেচার জার্নালে প্রকাশিত গবেষণায় দেখা গেছে, মানের দিক থেকে উইকিপিডিয়ার নিবন্ধগুলো অনেক ক্ষেত্রেই প্রখ্যাত বিশ্বকোষ ব্রিটানিকার সমতূল্য।
উইকিপিডিয়ার মডেলের এই সাফল্যের কারণ কী? উইকিপিডিয়ার শুরু থেকেই জনমানুষের সমবেত প্রয়াসের উপরে আস্থা রাখা হয়েছে, আর তার সাথে সাথে অলঙ্ঘনীয় কিছু মূলনীতি বেছে নেয়া হয়েছে। উইকিপিডিয়ার সবচেয়ে বড়ো মূলনীতি হলো যাচাইযোগ্যতা। উইকিপিডিয়াতে যে কেউ যেকোনো তথ্য যোগ করতে পারেন বটে, কিন্তু প্রতিটি তথ্যের জন্য দিতে হবে নির্ভরযোগ্য তথ্যসূত্র। আরেকটি মূলনীতি হলো নিরপেক্ষতা। উইকিপিডিয়ার উদ্দেশ্য হলো সূত্র সহ তথ্য উল্লেখ করা মাত্র - তথ্যের ভিত্তিতে আবেগময় মন্তব্য করা নয়। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, "অমুক মতবাদটি একটি ভ্রান্ত মতবাদ" - এধরণের মন্তব্যমূলক বাক্যের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্নের অবকাশ রয়েছে। এর বদলে যদি বলা হয়, "তমুকের মতে অমুক মতবাদটি ভ্রান্ত", তাহলে সেটা মন্তব্যের বদলে হয় কেবল একজন ব্যক্তির মতের কথার উল্লেখ। উইকিপিডিয়াতে কড়া ভাবে এই নিরপেক্ষতার নীতিটি মেনে চলা হয়। এসব মূলনীতির ভিত্তিতে নিবন্ধগুলোর মাননিয়ন্ত্রণ করার ফলে উইকিপিডিয়াতে অসংলগ্ন তথ্য যোগ করা হলে সাথে সাথে সেটা অন্যরা মুছে ফেলতে পারেন।
কেনো মানুষ উইকিপিডিয়ার উপরে কাজ করে? উইকিপিডিয়াতে লিখে কেউ কখনো কোনো পারিশ্রমিক পায়নি। কোনো লেখার মালিকানাও নেই, লেখকদের নাম কেবল দেখা যায় নিবন্ধের ইতিহাস পাতায়। আর উইকিপিডিয়াতে যোগ করা তথ্য রীতিমত সম্প্রদান কারকে বিলিয়ে দেয়া হয় -- যে কেউ যে কোনো উদ্দেশ্যে উইকির তথ্য ব্যবহার করতে পারেন, শর্ত কেবল উইকি থেকে নেয়া এই কথাটি উল্লেখ করতে হবে। তাহলে উইকিপিডিয়াতে লিখে কী লাভ? জবাবটার পেছনে আসলে লুকিয়ে আছে মানব মনস্তত্ত্ব -- ভালো কাজ করা, অন্যকে সাহায্য করার মানসিকতা আমাদের সবার মাঝেই লুকিয়ে আছে। উইকিপিডিয়ার নিরলস কর্মীদের অনুপ্রেরণাও আসলে সেটাই -- কোনো নিবন্ধের তথ্যগত ভুল ঠিক করা, কিংবা কোনো বিষয়ে নিজের জ্ঞানটুকু সেখানে যোগ করে অন্যদের সাহায্য করা -- এই প্রেরণাতেই কর্মীরা কাজ করে চলেন উইকিপিডিয়াতে। বর্তমানে নানা ভাষার ৩৫০টির অধিক উইকিপিডিয়াতে মোট নিবন্ধ রয়েছে দেড় কোটিরও বেশি। বাংলাতে রয়েছে ২২,০০০টি নিবন্ধ। বাংলা উইকিকে এগিয়ে নিতে আরো দরকার উৎসাহী কর্মী। খুব বেশি কিছু করতে হবে না, প্রতিদিন ৫টা মিনিট সময় ফেইসবুক বা অন্যত্র ব্যয় না করে বাংলা উইকিপিডিয়াতে আসুন, নিবন্ধগুলো দেখুন অথবা কোথাও ভুলচুক থাকলে শুধরে দিন। প্রতিদিন দুইটি বাক্যও যদি যোগ করেন, তাহলেই চলবে। আর উইকিপিডিয়ার ব্যাপারে সাহায্য চাইলে বাংলা উইকির কর্মীরা সব সময়েই এগিয়ে আসবেন।
আমাদের প্রত্যেকের কাছেই কিছু না কিছু তথ্য আছে, এই ছোট ছোট তথ্যগুলোকে আমরা যদি একত্রিত করতে পারি, তাহলে কিন্তু খুব বিশাল একটা জ্ঞানের ভান্ডার গড়া সম্ভব।
উইকিপিডিয়ার ১০ বছর পূর্তির উৎসব
সারাবিশ্বের ৪১৪টি স্থানে উইকিপিডিয়ার ১০ বছর উপলক্ষ্যে উৎসবের আয়োজন করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ঢাকাও। ২ সপ্তাহব্যাপী কর্মকাণ্ডের আওতায় গত ৩১শে জানুয়ারি ঢাকার ঐতিহ্যবাহী স্থানগুলোর ছবি তোলার জন্য হয়েছে ফটোওয়াকে। ১৫ই জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয়েছে উইকিপিডিয়ার জন্মোৎসব। বিস্তারিত তথ্য রয়েছে http://ten.wikipedia.org/wiki/Dhaka সাইটে।
(আমার এই লেখাটি গত ১৫ই জানুয়ারি দৈনিক সমকালের উপসম্পাদকীয় পাতায় প্রকাশিত হয়েছে ।)