জানতাম একদা তোমার চোখে জারুলের বন
ফেলেছে সম্পন্ন ছায়া, রাত্রির নদীর মতো শাড়ি
শরীরের চরে অন্ধকারে জাগিয়েছে অপরূপ
রৌদ্রের জোয়ার কত। সবুজ পাতায় মেশা টিয়ে
তোমার ইচ্ছার ফল লাল ঠোঁটে বিঁধে নিয়ে দূরে
চরাচরে আত্মলোপী অলীক নির্দেশে। শাশ্বত সে
বৃক্ষের গৌরবে তুমি দিয়েছ স্বামীকে দীপ্ত কামের মাধবী
শিশুকে সুপুষ্ট স্তন। দাম্পত্য প্রণয়ে সোহাগিনী
প্রেমিকার মতো হৃদয়ের অন্তহীন জলে, ঢেউয়ে
খর বাসনাকে ধুয়ে দান্ত সাধকের ধ্যানে তবু
গড়েছ সংসার। প্রত্যহের দীপে তুমি তুলে ধরো
আত্মার গহন নিঃসঙ্গতা, নকশি-কাঁথা-বোনা রাতে
স্বপ্নের প্রভায় জ্বলো। তোমার সত্তায় কী উজ্জ্বল
নিঃশঙ্ক অপ্রতিরোধ্য ফল জ্বলে, স্বর্গের সম্ভার।
এবং এখন জানি করুণ কাঠিন্য ভরা হাতে
আত্মায় নিয়েছ তুলে নগরের ফেনিল মদিরা,
আবর্তে আবর্তে মত্ত কাম, প্রাণে স্থির অন্ধ গলি।
হে বহুবল্লভা তুমি আজ কড়ায় ক্রান্তিতে শুধু
গুনে নাও নিষ্কাশিত যৌবনের অকুণ্ঠ মজুরি।
রূপের মলম মেখে সুচতুর মোমের ঊরুর
মদির আগুনে জ্বেলে পুরুষের কবন্ধ বিনোদ
কখনো জানিনি আগে এত ক্লান্ত, এত ক্লান্ত তুমি।
অনেকেই জানেন ফুল আমার খুবই প্রিয়। ফুল কার না প্রিয়! সকলেই ফুল ভালোবাসে। আমি ফুলের ছবি তুলতে পছন্দ করি। ফুলের নাম জানতে চেষ্টা কবরি। এইটুকুই হয়তো ব্যাতিক্রম। আমি যেমনি ভাবে ফুল ভারোবাসি তেমনি ভাবে কবিতাকেও ভালোবাসি এটা বলা যাবে না। বলা যায় আমার সবচেয়ে কম পছন্দের বিষয় হচ্ছে এই কবিতা। কবিতা আমি একেবারেই পড়ি না, তা না। আমি কবিতা পড়ি। ইদানিং আগের চেয়ে বেশীই পড়ছি। সম্ভবতো বয়স বাড়ার সাথে সাথে পড়ার রুচি পালটাচ্ছে। বেশীরভাগ সময় কবিতার অর্থ বুঝতে পারি না বলে কবিতা এড়িয়ে চলি। বিশেষ করে আধুনিক কবিতা। মনে হয় যেনো কঠিন কিছু শব্দের এলোমেলো সমাবেশ, যে যার মতো যেখানে খুশী বসে আছে অর্থের পরোয়া না করেই। আমার পছন্দ কঠিন শব্দের সহজ-সরল কবিতা। আমার পছন্দ নরীর রূপ বর্ননার কবিতা, আমার পছন্দ ফুল-পাখি-প্রকৃতির কবিতা, আমার প্রছন্দ প্রেমের কবিতা, আমার পছন্দ .... কঠিন শব্দে সরল অর্থের কবিতা।
আজ শামসুর রাহমান এর পাঁচ খানি কবিতা রইলো।
২ : কালো মেয়ের জন্যে পঙক্তিমালা
আমার নামধাম তোমার জানার দরকার নেই, কালো মেয়ে।
আমি শাদা কি কালো, হলদে কি বাদামি,
সবুজ কি বেগুনি
তাতে কী এসে যায়? ধ’রে নাও, আমার কোনো বর্ণ
নেই, আমি গোত্রহীন। বলা যায়, আমি শুধু
একটি কণ্ঠস্বর, যা মিশে থাকে ঘন কালো অরণ্যের
লতাপাতায়, ঝিলের টোল-খাওয়া পানিতে
হরিণের মুখ রাখার ভঙ্গিমায়,
উটের গলার ঘণ্টধ্বনিতে। এই কণ্ঠস্বর
বয়ে যায় বিষুব রেখায়, উত্তর মেরুতে, বঙ্গোপসাগরের
তরঙ্গে তরঙ্গে আর আফ্রিকার
অজস্র জেব্রার কুরধ্বনিময় প্রান্তরে।
কালো মেয়ে, তুমি যতই কালো হও,
তোমার সত্তায় আমি দেখেছি গীর্জার মোমবাতির
আলোর মতো আভা, সে আভাকে
প্রণতি জানায় এই কণ্ঠস্বর।
তুমি যখন প্রথম চোখ মেলেছিলে, কালো মেয়ে,
স্বল্পালোকিত কাঠের কেবিনে,
তখন তোমার মুখের দিকে ঝুঁকেছিল একটি কালো মুখ।
যে-স্তন তোমার শিরায় শিরায় বইয়ে দিয়েছিল
জীবনের ধারা, কালো সেই স্তন।
তোমার দোলনা দুলিয়েছিল যে-হাত
সে-হাত কালো,
তোমার জন্যে রুটি বানিয়েছিল যে-হাত,
সে-হাত কালো,
তোমার হাতে প্রথম কাঠের পুতুল
তুলে দিয়েছিল যে-হাত
বড় স্নেহার্দ্র, বড় কালো সে হাত।
কালো মেয়ে, তুমি দারিদ্র্যের গহ্বরে
হামাগুড়ি দিয়ে
মিথ্যার মতো শাদার উৎপীড়নে ধুঁকে ধুঁকে
লাঞ্ছনার অট্রহাসি শুনে বঞ্চনার শত খানাখন্দ
পেরিয়ে গায়ে উপহাসের কাদা মেখে,
পা ঝাড়া দিয়ে জ্যোৎস্নার চন্দনলিপ্ত হরিণীর মতো
এসে দাঁড়িয়েছো যৌবনের চূড়ায়। তোমার বরকে ওরা
ঘরচাড়া করেছে, ওর কালো মথমলের মতো কণ্ঠস্বর
ওরা স্তব্ধ করে দিয়েছে, তোমার কানে কোনোদিন আর গুঞ্জরিত
হবে না তার তারা-ঝলসিত গান। কিন্তু, কালো মেয়ে,
তরমুজের মতো তোমার উদরে
মাসের পর মাস বেড়ে উঠছে ওর সন্তান।
যেদিন তোমাদের দু’জনের সন্তান ওর অস্তিত্ব ঘোষণা করবে
প্রথমবার, সেদিন
সূর্যোদয় গালিচা বিছিয়ে দেবে তার উদ্দেশে,
গান গেয়ে উঠবে রঙ-বেরুঙের পাখি,
গাছপালা করতালিতে
মুখর ক’রে তুলবে দশদিক।
তোমার কোল-আলো-করা ছেলে বেড়ে উঠবে
শক্রর বন্দুকের ছায়ায়
বছরের পর বছর, রাত গভীর হ’লে
স্বাধীনতার দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে
সাক্সফোনে সে তুলবে তোমার পূর্ব পুরুষদের যন্ত্রণার সুর,
জীবনকে মৃত্যুর দেশ থেকে ছিনিয়ে আনার সুর;
তোমার ক্রুশবিদ্ধ মর্যাদার ক্ষতগুলো ধুয়ে
সেখানে ফোটাবে সে প্রসন্ন অর্কিড,
সে তার জোরালো কালো হাতে মুছিয়ে দেবে আফ্রিকার
কালো হীরের মতো চোখ থেকে গড়িয়ে-পড়া অশ্রুজল।
৩ : তোমার ঘুম
কতকাল তোমার সঙ্গে আমার দেখা নেই,
তোমার কণ্ঠস্বর শুনি না কতকাল। যিশুখৃষ্ট
ক্রুশে বিদ্ধ হবার পর
যতদিন গেছে অস্তাচলে, ততদিন তোমার
চোখের চাওয়া আর
স্পর্শের বিদ্যুচ্চমক থেকে আমি বঞ্চিত, মনে হয়।
যখন তোমাকে ফোন করি, তখন
ওপারে একটি ধ্বনি হতে থাকে ক্রমাগত একঘেয়েমির
মতো। কোনো সাড়া মেলে না।
কখনো কেউ রিসিভার তুলে রডিওর ঘোষকের
বলবার ধরন গলায় এনে জানায় তুমি বাড়ি নেই,
আবার কখনো শুনি ঘুমোচ্ছ তুমি।
যখন ঘুমোবার কথা নয়, তখন ঘুমোচ্ছ জেনে
কেমন খটকা লাগে। ভাবি তবে কি
তুমি কোনো জাদুবলে রূপকথার সেই
ঘুমন্ত সুন্দরী হয়ে গেলে? আবার ভাবনাকে
অন্য বাঁকে নিয়ে নিজেকে
প্রবোধ দিই, কারো কারো ঘুম রাত থেকে
মধ্য দুপুর অব্দি গড়ায়, গড়াতেই পারে। তাই
এ নিয়ে নালিশ রুজু করা নিরর্থক। বরং
নিজের ভাগ্যকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে
বলি, আমাদের সংযোগের মুহূর্তটাই রাগুগ্রস্ত।
অথচ বাদশাহ সুলেমানের আমলের রত্নের মতো
কত মুহূর্ত আমাদের কেটেছে
তোমার ড্রইংরুমে। তখন তোমাকে ব্যাবিলনের
উদ্যানের কোনো মনোরম, দুর্লভ, তম্বী গাছ ভেবে
তাকিয়ে থেকেছি তোমার দিকে। এবং
আমার দৃষ্টিতে বিহ্বলতা পাঠ করে বলেছো,
কী দেখছো অমন ক’রে? সে প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে
দ্রুত পাতা ওল্টাতাম ম্যাগাজিনের,
অথবা দৃষ্টি মেলে দিতাম তোমার বাগানের দিকে। দূর অতীত
আর বর্তমান বইতো এক লয়ে পাখির গানে।
অসহ্য এই বিচ্ছেদ যা আমাকে দিনের পর দিন
রাত্রির পর রাত্রি
তোমার ছায়া নিয়ে তৃপ্ত থাকতে জপায়। এই বিচ্ছেদ
উজিয়ে আমি বেঁচে আছি, একথা ভেবে
নিজেকেই কেমন অপরাধী মনে হয়। অথচ তুমিহীনতা
আমাকে জড়িয়ে রাখে কবিতার সঙ্গে
সারাক্ষণ, যেমন বিশ্বাস
প্রাণের স্পন্দনকে। আর কবিতা তৈরি করে
এমন এক পথ, যে-পথ তোমার আসার
মুহূর্তের জন্য বারবার মরীয়া কণ্ঠস্বর হয়।
আজো দুপুরবেলা তোমাকে ফোন করবার পর
ঠাণ্ডা নিঃস্পৃহ এক কণ্ঠস্বর জানালো
তুমি ঘুমিয়ে আছো। সেই কণ্ঠস্বর আমাকে এক ঝটকায়
ছুড়ে দিলে আমার শহরের জনহীন রাস্তায় আর
নৈরাশ্যের সূর্যাস্তের ভেতর। একটা ভয় লিকলিকে
সরীসৃপের ধরনে আমাকে
চাটতে থাকে-তাহ’লে কি আমি অবিরাম ডায়াল
করতে করতে মেথুসেলা হয়ে যাবো? এখন সব পাখি
ঘুমের গুহায় পাখা গুটিয়ে নিঝুম, সকল নদী
ঘুমে প্লাবিত করছে গ্রাম, জনপদ। আমার আয়না জুড়ে
ঘুমিয়ে আছে এক নারী, যে ভুলে গেছে ভালোবাসার
ভাষা। তোমার হৃদয় ঘুমিয়ে পড়েনি তো?
৪ : কবির নির্বাসন
আমার চোখ কি আমার কাছ থেকে
নির্বাসিত হয়েছে
নইলে কেন আমি কোন কিছু
দেখতে পাচ্ছি না?
আমার কণ্ঠ কি আমার কাছে থেকে
নির্বাসিত হয়েছে?
নইলে কেন আমার কণ্ঠ থেকে সত্য কি মিথ্যা কিছুই
উচ্চারিত হচ্ছে না?
আমার পা দুটো কি আমার কাছ থেকে
নির্বাসিত হয়েছে?
নইলে কেন ওরা সামনের দিকে
এগোতে পারছে না?
আমার হাত দুটো কি আমার কাছ থেকে
নির্বাসিত হয়েছে?
নইলে কেন ওরা এত লঙ্কাকাণ্ডের পরেও
মুষ্টিবদ্ধ হচ্ছে না?
আমার কলম কি আমার কাছ থেকে
নির্বাসিত হয়েছে?
নইলে কেন আমি খাতার পাতায় উচ্চারণের স্তবক
ফোটাতে পারছি না?
৫ : স্বাধীনতা তুমি
স্বাধীনতা তুমি
রবিঠাকুরের অজর কবিতা, অবিনাশী গান।
স্বাধীনতা তুমি
কাজী নজরুল ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো
মহান পুরুষ, সৃষ্টিসুখের উল্লাসে কাঁপা-
স্বাধীনতা তুমি
শহীদ মিনারে অমর একুশে ফেব্রুয়ারির উজ্জ্বল সভা
স্বাধীনতা তুমি
পতাকা-শোভিত শ্লোগান-মুখর ঝাঁঝালো মিছিল।
স্বাধীনতা তুমি
ফসলের মাঠে কৃষকের হাসি।
স্বাধীনতা তুমি
রোদেলা দুপুরে মধ্যপুকুরে গ্রাম্য মেয়ের অবাধ সাঁতার।
স্বাধীনতা তুমি
মজুর যুবার রোদে ঝলসিত দক্ষ বাহুর গ্রন্থিল পেশী।
স্বাধীনতা তুমি
অন্ধকারের খাঁ খাঁ সীমান্তে মুক্তিসেনার চোখের ঝিলিক।
স্বাধীনতা তুমি
বটের ছায়ায় তরুণ মেধাবী শিক্ষার্থীর
শানিত কথার ঝলসানি-লাগা সতেজ ভাষণ।
স্বাধীনতা তুমি
চা-খানায় আর মাঠে-ময়দানে ঝোড়ো সংলাপ।
স্বাধীনতা তুমি
কালবোশেখীর দিগন্তজোড়া মত্ত ঝাপটা।
স্বাধীনতা তুমি
শ্রাবণে অকূল মেঘনার বুক
স্বাধীনতা তুমি পিতার কোমল জায়নামাজের উদার জমিন।
স্বাধীনতা তুমি
উঠানে ছড়ানো মায়ের শুভ্র শাড়ির কাঁপন।
স্বাধীনতা তুমি
বোনের হাতের নম্র পাতায় মেহেদীর রঙ।
স্বাধীনতা তুমি বন্ধুর হাতে তারার মতন জ্বলজ্বলে এক রাঙা পোস্টার।
স্বাধীনতা তুমি
গৃহিণীর ঘন খোলা কালো চুল,
হাওয়ায় হাওয়ায় বুনো উদ্দাম।
স্বাধীনতা তুমি
খোকার গায়ের রঙিন কোর্তা,
খুকীর অমন তুলতুলে গালে
রৌদ্রের খেলা।
স্বাধীনতা তুমি
বাগানের ঘর, কোকিলের গান,
বয়েসী বটের ঝিলিমিলি পাতা,
যেমন ইচ্ছে লেখার আমার কবিতার খাতা।
পাঁচ খানি কবিতা - ০১, পাঁচ খানি কবিতা - ০২, পাঁচ খানি কবিতা - ০৩
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০২২ রাত ১০:১২