আমার বাবার দাদার দাদা ছিলেন মোটামুটি রকমের জমিনদার লোক। নাম তার মালু শেখ। বেশ ভালো ভূসম্পত্তির মালিক ছিলেন। ক্ষমতাধর লোক ছিলেন। তার বাস ছিলো বর্তমান গুলশান-মহাখালী এলাকায়।
ফেলু শেখ ছিলেন আমার দাদার দাদা। তিনিও তার বাবা মালু শেখের মতোই ছিলোন ক্ষমতাধর।
আমার বাবার দাদার নাম তরফ আলী। সম্ভবতো নরম সরম লোক ছিলেন। যদিও ক্ষমতা আর সম্পত্তি ছিলো বাপ-দাদাদের মতোই।
আমার দাদার নাম একিন আলী। তিনি ছিলেন খুবই ভালো মানুষ, কাউকে ধমক দিতেন না, কারো সাথে খারাপ ব্যবহার করতেন না। এলাকার মাতব্বর ছিলেন, তার দাদার মতোই বেশ ক্ষমতাধর লোক ছিলেন। দাদা-বাবার মতো একিন আলীর নিবাসও ছিলো গুলশান এলাকায়। সেই সময় গুলশান এলাকার অবস্থা এমন ছিলো না। সবটাই ছিলা ঝোপঝারে ভরা। দিনের বেলাই শেয়াল ঘুরে বেরাতো। শীতের সময় কিছু সবজি চাষ হতো। আম-কাঠালের সময় বাগানে বাগানে প্রচুর আম-কাঠাল হতো। গুলশানের কাঠাল ছিলো অতি-সুস্বাদু।
বেচারার দাদার ভাগ্য খারাপ বলতে হবে। সেই সময় সরকার গুলশানের জমিগুলি একোয়ার করে নিলো। সরকারী লোকদের সাথে গেঞ্জাম করে টিকতে না পরে ঘটি-বাটি-বাড়ি সব ফেলে গুলশান থেকে উত্তর বাড্ডাতে চলে আসতে হলো।
আমার দাদার ছিলো ৭ ছেলে। প্রায় সবাই জেদী। আমার সবচেয়ে নিরিহ-ঠান্ডা যে জেঠা (বাবার বড় ভাই) তার সাথে একদিন সাঁতারকুল ব্রিজ দিয়ে যাচ্ছিলাম। ঠিক সেই সময় একজন ঝামেলা করায় জেঠা আমাকে নির্দেশ দেয় সেই লোককে ব্রিজের উপর থেকে নিচে ফেলে দিতে। আমি তখন সম্ভবতো ৪র্থ-৫ম শ্রেণীর ছাত্র। জেঠার কথা শুনে লোকটা দে-ছুট। (সে আমাদের ভালো করেই চিনে।)
এলাকায় যদি কখনো ঝামেলা হতো তার সমাধান বিচারকরা না করতে পারলে দাদার কাছে আসতো। দাদা যেটা বলে দিতো সেটাই ফাইনাল। তার উপরে কেউ কিছু করার বা বলার সাহস পেতো না। তবে কিনা, দাদা একজনকে খুব ভয় পেতো। তিনি আর কেউ নন, আমার দাদী সবুরন নেছা। দাদীর সামনে দাদা ছিলো ভিজে বিড়াল।
আমার এক বড় চাচাতো ভাই একটি ঘটনা আমাদের খুব শোনাতো।
যেকোন কারণেই হোক একদিন দাদী দাদাকে ভীষণরকম ঝারছিলো। বুড়া, খাটাস, বদমাইস, আইলসা, কামচোর এই সব গালি দেয়া ছাড়াও দাদার বপা-দাদার গুষ্টি ধুয়ে দিচ্ছিলো। দাদা বারান্দায় চৌকিতে বসে চুপচাপু সব হজম করছিলো।
তো বেচারা নিরিহ দাদা শেষ পর্যন্ত আর সহ্য করতে না পরে অনেকক্ষণ পরে - "ধুর চো...রানি, থাক তুই, আমি গেলাম.." বলে চৌকি থেকে নেমে বাড়ির বাইরে চলে গেলেন।
এরপর শুরু হলো আমার দাদীর কান্না।
বিলাপ করে-করে বলতে লাগলেন- বুইড়া আমারে গালি দিলো? এতো বড় সাহস। আমার বাপ-মা তুইলা গাইলাইলো। আমি আর থাকমু না.....।
কাঁদতে কাঁদতে দাদী তাঁর ৭ ছেলের বাড়িতে গিয়ে দাদার নামে বিচার দিয়ে এলো।
দাদা বেচারার পরে কি শাস্তি হয়েছিলো সেটি আর জানা হয়নি আমার।
দাদার প্রভাব আরো এক যায়গায় খাটো হয়ে যেতো। তিনি তার ৭ ছেলেকে এক সাথে রাখতে পারেন নি। আসলে এক সাথেই ছিলো, তবুও কোনো কারণ ছাড়াই তাদের মধ্যে কিছু দূরুত্ব ছিলো। তাঁরা ২ ভাই, ৩ ভাই করে আলাদা আলাদা দল হয়ে ছিলো। তাদের মধ্যে কোনো ঝগড়া ছিলো না, কোনো বিবাদ ছিলো না। তবুও তেমন ভাবে আন্তরিকতাও ছিলো না। নিজেদের মধ্যে একতার অভাব ছিলো। দাদা যখনই তার ৭ ছেলেকে কোনো কারণে ডাকতেন ৭ ছেলেই ছুটে আসতো। দাদা বারান্দার চৌকিতে বসে মাটির দেয়ালে (দাদা মাটির ঘরে থাকতেন) হেলান দিয়ে বসতেন। তাঁর ৭ ছেলে এসে সবাই তার দিকে পিছন ফিরে বসে বলতো - কও বাজি।
এভাবে বসলে মুখমুখী হতে হয় না।
ছবিটি সংগৃহীত, আশাকরি উপরের ছবিটার মর্ম এখন পরিষ্কার হবে পাঠকের কাছে।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০২২ রাত ৮:৩৬