somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সাদা ময়ূর

০২ রা অক্টোবর, ২০২১ বিকাল ৩:৫৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



প্রায় সকল পাখিই আমার কাছে সুন্দর মনে হয়। তবে সবচেয়ে বেশী সুন্দর পাখিদের তালিকা করলে সেখানে অবশ্যই ময়ূর স্থান পাবে। সচারাচর চিরিয়াখানায় আমরা যে নীল রঙের ময়ূর দেখি সেটি হচ্ছে ভারতীয় ময়ূর বা দেশি ময়ূর। এর বৈজ্ঞানিক নাম Pavo cristatus আর ইংরেজি নাম Indian peafowl, common peafowl,blue peafowl ইত্যাদি। কলাপী, কেকা, কেকী, শিখী, শিখণ্ডী, বর্হী, বর্হিণ এইগুলি ময়ূরের সংস্কৃত নাম।


এই নীল ময়ূর ছাড়াও ধবধবে সাদা রঙের আরেকটি ময়ূর আছে। এই সাদা ময়ূর দেখতে বেশ চমৎকার। অন্যান্য ময়ূরের মতো সাধারণত এদের বনে বাস করতে দেখা যায় না।

বেশ কিছুদিন আগে গিয়েছিলাম গাজীপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কে। অনেকটা সময় চারপাশ ঘুরে বেরিয়ে যখন ময়ূরের খাঁচার সামনে পৌছেছি ততোক্ষণে সেই খাঁচায় ঢুকার সময় শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু আমি দূর থেকে দেখতে পেলাম একটি সাদা ময়ূর পেখম তুলেছে। আমি খাঁচার বাইরে অনেক দূর থেকে কোনো রকমে টপাটপ কয়েকটি ছবি তুলে নিলাম। দূরত্বের কারণে ছবি গুলি খুব একটা ভালো আসেনি।


ওরে বনের ময়ূর কোথায় পেলি এমন চিত্রপাখা
তোর পাখাতে হরির স্মৃতি পাখার শ্রী কি আঁকা॥
তারই মতন হেলে দুলে
নাচিস রে তুই পেখম খুলে
তনুতে তোর ওরে শ্যামের আঁখির নীলাঞ্জন মাখা॥
হারিয়ে নব কিশোরে, দিবা-নিশি ঘুরি
তাই কি শ্যামের বিভূতি তুই আনলি করে চুরি।
সান্ত্বনা কি দিতে মোরে
শ্যামল রেখে গেছে তোরে
তাইতো তোরে হেরি ওরে যায় না কাঁদন রাখা॥
----- কাজী নজরুল ইসলাম -----






রাজসিক এই ময়ূর মানুষের কাছাকাছি খুব একটা আসতে চায় না, তবে যেসব ময়ূর মানুষ দেখে অভ্যস্ত হয়ে যায় তারা মানূষকে ভয় পায়না মোটেও। একারণেই আমরা চিরিয়াখানায় ময়ূরকে নিশ্চিন্তে ঘুরে বেরাতে দেখি, দেখি পেখম তুলতে।


হৃদয় আমার নাচে রে আজিকে ময়ূরের মতো নাচে রে।
শত বরনের ভাব-উচ্ছ্বাস কলাপের মতো করেছে বিকাশ,
আকুল পরান আকাশে চাহিয়া উল্লাসে কারে যাচে রে॥
-----রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর -----



শুনতে পাই আকাশে মেঘ ডাকলেই নাকি ময়ূর পেখম তুলে নাচে। পেখম তুলে নাচতে থাকা ময়ূর দেখতে বেশ লাগে। অনেক সময় দেখেছি লোকজন ময়ূরের খাঁচার সামনে দাঁড়িয়ে হাত তালি দিতে থাকে ময়ূরের পেখম তোলা দেখতে।





ময়ূরের মূল আকর্ষণ তার পেখম। মূলত পেখম থাকে পুরুষ ময়ূরের। স্ত্রী ময়ূরকে (ময়ূরীকে) আকৃষ্ট করার জন্য পুরুষ ময়ূর পেখম তোলে নাচে। স্ত্রী ময়ূরেরও পেখম থাকে, তবে তা আকারে অনেক ছোট এবং পুরুষ ময়ূরের মতো এতো বর্ণময় সুন্দর নয়। অন্য প্রাণিদের বা শত্রুকে ভয় দেখাবার জন্য স্ত্রী ময়ূর তার পেখম তোলে। ভারতীয় নীল ময়ূরের মত সাদা ময়ূরের পেখমে নীল রংয়ের বড় ফোঁটা নেই। সাদা ময়ূরের সকল অংশই সাদা, এমনকি পেখমও সম্পূর্ণ সাদা। এরাই সাদা ময়ূর বা শ্বেত ময়ূর ইংরেজিতে White peacock বা White Peafowl.


রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একটি ছড়ায়া লিখেছিলেন -

টুনটুনি কহিলেন, রে ময়ূর, তোকে
দেখে করুণায় মোর জল আসে চোখে।

ময়ূর কহিল, বটে! কেন, কহ শুনি,
ওগো মহাশয় পক্ষী, ওগো টুনটুনি।

টুনটুনি কহে, এ যে দেখিতে বেআড়া,
দেহ তব যত বড়ো পুচ্ছ তারে বাড়া।
আমি দেখো লঘুভারে ফিরি দিনরাত,
তোমার পশ্চাতে পুচ্ছ বিষম উৎপাত।

ময়ূর কহিল, শোক করিয়ো না মিছে,
জেনো ভাই, ভার থাকে গৌরবের পিছে।



অন্য পাখিদের তুলানায় অনেক কম হলেও ময়ূর কিন্তু উড়তে পারে। দেহের তুলনায় বিশাল পেখম নিয়ে এক গাছ থেক অন্য গাছে ঠিকই উড়ে যেতে পারে সে। ময়ূরের পেখম ৬ ফুট পর্যন্ত লম্বা হতে দেখা যায়।





সাদা ময়ূর হল ভারতীয় নীল ময়ূরের একটি প্রজাজাতী। সত্যি বলতে এগুলি লিউসিস্টিক (Leucistic) এর প্রভাবে নীল না হয়ে সাদা রঙের পালক নিয়ে জন্মায়। এটি এমন একটি অবস্থা যা পশু-পাখির চামড়া বা পালককে প্রভাবিত করে এবং তাদের চামড়া বা পালক থেকে সমস্ত রং সরিয়ে দেয়। ফলে সেই সব পশু-পাখির চামড়া বা পালক সাদা বা ফেকাসে দেখায়। কয়েক বছর আগে চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানায় একটি সাদা বাঘ জন্ম নিয়েছিলো।



খুব বেশী উড়তে পারেনা বলেই হয়তো মাটিতেই বাসা বাঁধে ময়ূরেরা। এরা সাধারনত ৬ থেকে ৮টি ডিম পারে। বাসায় ডিম পেরে ডিমে তা দিয়ে বাচ্চা ফুটায়। সাধারণত ২৮ দিনে ডিম ফুটে বাঁচ্চা বের হয়। বাঁচ্চাগুলি মুরগির বাঁচ্চার মতই মায়ের সাথে ঘুরে ঘুরে খাবার খায়। ময়ূর কিন্তু জন্ম থেকেই এমন সুন্দর পেখম পায় না। ছোট অবস্থায় ময়ূর এবং ময়ূরী দেখতে একই রকম থাকে। তাদের বয়স যখন ৬ মাস হয় তখন তাদের পালকের রং বদলাতে থাকে। পুরুষ ময়ূরের বয়স যখন প্রায় ৩ বছর হয় তখন তার পেখম জন্মায়। প্রতি বছর প্রজনন শেষে ময়ূর তাঁদের পেখম বদলায়। তাঁদের লেজের বর্ণিল পাখাগুলো দেহ থেকে ঝরে পড়ে। ঝরেপরা সেই পালকগুলিই সংগ্রহ করে বিক্রি করা হয়। পুরুষ ময়ূর দেখতে খুব সুন্দর হলেও এদের ডাক কিন্তু কর্কশ।





রিম ঝিম ঘন ঘন রে বরষে।
গগনে ঘনঘটা, শিহরে তরুলতা–
ময়ূর ময়ূরী নাচিছে হরষে।
দিশি দিশি সচকিত, দামিনী চমকিত–
চমকি উঠিছে হরিণী তরাসে।।
-----রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর -----




নীল ময়ূর ভারতের জাতীয় পাখি, ১৯৬৩ সালে ময়ূরকে ভারতের জাতীয় পাখি হিসাবে ঘোষণা করা হয়। একসময় সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশে এদের দেখতে পাওয়া যেতো । তবে বর্তমানে বাংলাদেশের বনে ময়ূর বিলুপ্ত হয়ে গেছে। কাঠ ময়ূর নামে একপ্রকার ময়ূর এখনো বনে পাওয়া যায় অল্প সংখ্যক । তাই বাংলাদেশের ১৯৭৪ ও ২০১২ সালের বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইনে ময়ূর সংরক্ষিত হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।





কথিত আছে প্রাচীন যুগে একসময় ময়ূরের পেখম রং হীন নিষ্প্রভ ছিল। রাবন এবং ইন্দ্রের যুদ্ধের সময় ময়ূর তার পেখম মেলে দেবরাজ ইন্দ্র লুকাতে সাহায্য করেছিলো। এরপর থেকে ময়ূরের পেখমে বর্ণিল কারুকাজ দেখা দেয় এবং তার পেখমের পালককে মঙ্গলময় মানা হয়। ভগবান কৃষ্ণকে তার মুকুটে ময়ূরের পালক ধারণ করতে দেখা যায়।


নাচত নন্দদুলাল
শ্যামল সুন্দর মদন মনোহর
নওল কিশোর কানাইয়া গোপাল।
নাচত গিরিধারী ময়ূর মুকুট পরি
দিকে দিকে ছন্দ আনন্দ পড়িছে ঝরি
নাচে গোপী সখা বংশীওয়ালা হরি
রুনুঝুনু বাজওত ঘুঙ্গুর তাল।
----- কাজী নজরুল ইসলাম -----







গগনে কৃষ্ণ মেঘ দোলে – কিশোর কৃষ্ণ দোলে বৃন্দাবনে।
থির সৌদামিনী রাধিকা দোলে নবীন ঘনশ্যাম সনে;
দোলে রাধা শ্যাম ঝুলন-দোলায় দোলে আজি শাওনে।।
পরি’ ধানি রঙ ঘাঘরি, মেঘ রঙ ওড়না
গাহে গান, দেয় দোল গোপীকা চল-চরণা,
ময়ূর নাচে পেখম খুলি’ বন-ভবনে।।
----- কাজী নজরুল ইসলাম -----



ময়ূর সর্বভূক পাখি। চারা গাছের কচি পাতা-ডগা, কীটপতঙ্গ, বীজ, বীজের খোসা, ফুলের পাপড়ি, ছোট ছোট অমেরুদণ্ডী প্রাণি, এই সবই তার খাদ্য তালিকায় আছে।





দুলিবি কে আয় মেঘের দোলায়।
কুসুম দোলে পাতার কোলে পুবালি হাওয়ায়।।
অলকা-পরী অলক খু’লে
কাজরি নাচে গগন-কূলে,
বলাকা-মালার ঝুলন ঝুলায়।।
দাদুরি বোলে, ডাহুকী ডাকে
ময়ূরী নাচে তমাল শাখে,
ময়ূর দোলে কদম-তলায়।।
তটিনী দুলে ঢেউয়ের তালে,
নিবিড় আঁধার ঝাউয়ের ডালে,
বেণুর ছায়া ঘনায় মায়া পরান ভোলায়।।
----- কাজী নজরুল ইসলাম -----



ছবি তোলার স্থান : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্ক, গাজীপুর, বাংলাদেশ।
ছবি তোলার তারিখ : ১৩/০৩/২০১৯ ইং






=================================================================
সিরিজের পুরনো পর্বগুলি দেখতে -
পাক-পাখালি - ০১
পাক-পাখালি - ০২
পাক-পাখালি - ০৩
পাক-পাখালি - ০৪
পাক-পাখালি - ০৫ : পায়রা
পাক-পাখালি - ০৬
পাক-পাখালি - ০৭ : চড়াই
পাক-পাখালি - ০৮ : ফিঙ্গে
পাক-পাখালি - ০৯ : সবুজ বাঁশপাতি
পাক-পাখালি - ১০ : চড়াই
পাক-পাখালি - ১১ : বন বাটান
পাক-পাখালি - ১২
পাক-পাখালি - ১৩
পাক-পাখালি - ১৪
পাক-পাখালি - ১৫ : পায়রা
পাক-পাখালি - ১৬ : চড়াই
পাক-পাখালি - ১৭ : গাংচিল
পাক-পাখালি - ১৮ : সাদা ময়ূর
পাক-পাখালি - ১৯
পাক-পাখালি - ২০ : কাক
পাক-পাখালি - ২১

=================================================================
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই মে, ২০২২ রাত ৮:০৯
৮টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জুম্মাবার

লিখেছেন সাইফুলসাইফসাই, ০৭ ই মে, ২০২৫ বিকাল ৪:৪০

জুম্মাবার
সাইফুল ইসলাম সাঈফ

প্রতি শুক্রবার ইমাম এর নেতৃত্ব
মেনে নিয়ে আমরা মুসলিমরা
হই একত্রিত, হই সম্মিলিত
ভুলে যাই সবাই হৃদয় ক্ষত!
খুতবা শুনি আমরা একাগ্রচিত্তে
চলে আসি সকলে একই বৃত্তে।
কানায় কানায় পরিপূর্ণ প্রতিটি মসজিদ
ঐক্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমরা শান্তিপ্রিয় মানুষেরা একজোট হতে চাই

লিখেছেন সত্যপথিক শাইয়্যান, ০৭ ই মে, ২০২৫ সন্ধ্যা ৬:৫১



ভারত - পাকিস্তান যুদ্ধ বন্ধে কি করতে পারি আমরা? একজন নীতিবান, যুদ্ধবিরোধী ও মানবতাবাদী মানুষ হিসেবে একক এবং সঙ্ঘবদ্ধ ভাবে আমরা অনেক কিছু করতে পারি। চলুন নিচে দেখা যাক... ...বাকিটুকু পড়ুন

অপারেশন সিদুঁর বনাম অপারেশন নারায়ে তাকবীরের নেপথ্যে !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৭ ই মে, ২০২৫ রাত ৯:২৮


বলতে না বলতেই যুদ্ধটা শুরু হয়ে গেল। না, যুদ্ধ না বলাই ভালো—রাষ্ট্রীয় অভিনয় বলা ভালো। ভারত ও পাকিস্তান আবার সীমান্তে একে অপরকে চেঁচিয়ে বলছে, "তুই গো-মূত্রখোর ", "তোর দেশ জঙ্গি"।... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেই পুরোনো সিনেমা

লিখেছেন প্রফেসর সাহেব, ০৮ ই মে, ২০২৫ রাত ১:০৮



ঘটনা হইতেছে, পাকিস্তান জ*গী পাঠাইয়া আক্রমণ করাইছে।

ভারত বলছে 'কাম কি করলি? তোর সাথে যুদ্ধ'। পাকিস্তান বলছে 'মাইরেন না মাইরেন না আমরা মারিনাই, ওই কুলাংগার জ*গীরা মারছে'

'আমরা আপনাগরে ওদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

শেষমেষ লুইচ্চা হামিদও পালিয়ে গেলো!

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৮ ই মে, ২০২৫ বিকাল ৩:০৩



৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে পতন হয় ফেসিস্ট হাসিনা ও তার দল আম্লিগের। এরপর থেকেই আত্মগোপনে রয়েছে দলটির চোরচোট্টা নেতাকর্মীরা। অনেক চোরচোট্টা দেশ ছাড়লেও এতদিন দেশেই ছিলো আম্লিগ সরকারের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×