দুই ছেলেকেই অকালে হারিয়ে সত্যবতী তাঁর স্বামীর বংশ রক্ষার চিন্তায় পরে গেলেন। তিনি ভীষ্মকে নিজের পিতা রাজা শান্তনুর বংশ রক্ষার জন্য দুই ভ্রাতৃবধূর অম্বিকা ও অম্বালিকার গর্ভে সন্তান উৎপাদন করতে আদেশ দিলেন। কিন্ত ভীষ্ম কিছুতেই তার প্রতিজ্ঞা ভুলে বিয়ে-সংসার-সন্তান বা রাজ্য গ্রহণ করতে রাজি হলেন না। তবে পিতার বংশ রক্ষার একটি উপায় তিনি মাতা সত্যবতীকে জানেলেন-
পুরাকালে জামদগ্ন্য মুনির পুত্র মহাতেজস্বী পরশুরাম পৃথিবীর সমস্ত ক্ষত্রিয় হত্যা করেছিলেন তার কুঠার দিয়ে। তখন ক্ষত্রিয়নারীগণ নিজেদের বংশ রক্ষার জন্য ব্রাহ্মণের সঙ্গে সহবাসে করে সন্তান উৎপাদর্ন করেছিলেন।
দীর্ঘতমা মুনির কাহিনী
একসময় উতথ্য ঋষির পত্নী মমতা যখন গর্ভবতী ছিলেন তখন তাঁর দেবর বৃহস্পতি মমতার নিষেধ না শুনে জোড় করে তাঁর সাথে সংগম করার চেষ্টা করছিল। তখন গর্ভের শিশু তার পা দিয়ে চাচা বৃহস্পতিকে লাথি দিল। বৃহস্পতি গর্ভের শিশুকে অন্ধ হওয়ার অভিশাপ দিলেন। ফলে উতথ্যে-মমতার ছেলে দীর্ঘতমা অন্ধ হয়ে জন্মগ্রহণ করল। তিনি ধার্মিক ও বেদজ্ঞ ছিলেন, কিন্তু পশুর মতো যেখানে সেখানে সংগমে লিপ্ত (গোধর্ম) হতো বলে প্রতিবেশী মুনিগণ ক্রুদ্ধ হয়ে তাঁকে ত্যাগ করে। আর মাতার আদেশে দীর্ঘতমার পুত্রেরা তাঁকে ভেলায় চড়িয়ে গঙ্গায় ভাসিয়ে দেয়।
বলি রাজা দীর্ঘতমাকে দেখতে পেয়ে নিজের স্ত্রী সুদেষ্ণার কাছে নিয়ে যায় সন্তান উৎপাদনের জন্য। কিন্তু অন্ধ বৃদ্ধ দীর্ঘতমাকে দেখে সুদেষ্ণার পছন্দ হল না। তাই দীর্ঘতমার কাছে সুদেষ্ণা নিজে না গিয়ে তাঁর ধাত্রীকন্যাকে পাঠিয়ে দিল। সেই শূদ্রকন্যার গর্ভে এগারজন ঋষি জন্ম নিলোঅ। বিষয়টা জানতে পেরে বলি রাজা তার স্ত্রী সুদেষ্ণাকে বারবার অনুরোধ করে দীর্ঘতমার সাথে মিলনে রাজি করালেন। সুদেষ্ণা দীর্ঘতমা কাছে উপস্থিত হলে দীর্ঘতমা সুদেষ্ণার যৌনাঙ্গ স্পর্শ করে বললেন- "তোমার পাঁচটি তেজস্বী পুত্র হবে - অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, পুন্ড্র ও সুহ্ম। তাদের দেশও এই সকল নামে খ্যাত হবে।"
বলি রাজার বংশ এইভাবে দীর্ঘতমার মাধ্যমে রক্ষা পেয়েছিলো।
উপরের কাহিনী দুটি শুনিয়ে ভীষ্ম তার সৎ মা সত্যবতীকে বলেন বিচিত্রীবীর্যের পত্নীদের গর্ভে সন্তান উৎপাদনের জন্য কোনো ব্রাহ্মণকে অর্থ দিয়ে নিয়োগ করতে। তখন সত্যবতী লজ্জিতভাবে তাঁর পূর্ব ইতিহাস জানালেন। সেই সময় কুমারী অবস্থায় পরাশর মুনির সাথে মিলনে সত্যবতীর যে পুত্র জন্মেছিলো তাঁর নাম দ্বৈপায়ন, তিনি মহাযোগী মহর্ষি, চতুর্বেদ বিভক্ত করে ব্যাস উপাধি পেয়েছেন; তাঁর গায়ের রং কালো, সেজন্য তাঁর অন্য নাম কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন ব্যাস। তিনি তার পিতা পরাশর মুনির সঙ্গে থাকেন। কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন তাঁর মা সত্যবতীকে বলেছিলেন প্রয়োজন হলে তাঁকে ডাকলেই তিনি আসবেন।
তরাষ্ট্র ,পান্ডু ও বিদুরের জন্ম বৃত্তান্ত
সত্যবতী কৃষ্ণ দ্বৈপায়নকে স্মরণ করলো, একটু পরেই সেখানে কৃষ্ণ দ্বৈপায়নের আবিভার হলো। সত্যবতী তাঁকে আলিঙ্গন এবং স্তনদুগ্ধে সিক্ত করলেন। সত্যবতী দ্বৈপায়নকে তাঁর দুই পুত্রের মৃত্যু ও তাঁর স্বামীর বংশ রক্ষার বিষয়ে সব কিছু জানিয়ে অনুরোধ করলেন তার দুই পুত্রবধুর গর্ভে পুত্র উৎপাদন করতে।
দ্বৈপায়ন সব কথা শুনে তাঁর সৎ ভ্রাতৃবধূদের গর্ভে পুত্র উৎপাদনের উদ্দেশ্যে তাঁদের সাথে মিলিতো হতে রাজি হলেন। কিন্তু তিনি দুই ভ্রাতৃবধূকে এক বছর ব্রতপালন করে শুদ্ধ হয়ে নিতে বলনে। তখন সত্যবতী জানালেন রাজহীন রার্জ্যে বৃষ্টি হয় না, দেবতারা প্রসন্ন হন না, অতএব যাত দ্রুত সম্ভব রাণীদের গর্ভবতী করতে হবে। এখন রাণীদের সন্তান হলে ভীষ্ম তাদের লালন পালন করে রাজা হিসেবে তৈরি করে দিতে পারবে। দ্বৈপায়ন তখন তার মাকে বললেন রানীরা যেন তাঁর কুৎসিত রূপ, গন্ধ আর বেশ সহ্য করে নেয়।
সত্যবতী তাঁর পুত্রবধূ অম্বিকাকে অনেক ভাবে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে দ্বৈপায়নের সঙ্গে মিলিতো হতে রাজি করিয়ে দ্বৈপায়নের কাছে পাঠালেন। কিন্তু দ্বৈপায়নের বিকট কালো রূপ, পিঙ্গল চুল আর দাড়ি-গোঁফের জটা দেখে অম্বিকা ভয়ে চোখ বন্ধ করে রইলো। অম্বিকা সাথে মিলিতো হয়ে ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে এসে দ্বৈপায়ন সত্যবতীকে জানালেন এর গর্ভে শতহস্তিতুল্য বলবান ও বুদ্ধিমান পুত্র জন্ম নিবে এবং শতপুত্রের পিতা হবে, কিন্তু মাতার দোষে অন্ধ হবে।
অন্ধ ব্যক্তি রাজা হবার যোগ্য হবে না বুঝে সত্যবতী অনুরোধ করলো তাঁর দ্বিতীয় পুত্রবধূ অম্বালিকার গর্ভে আরেকটি পুত্রের জন্ম দিতে। মায়ের অনুরোধে দ্বৈপায়ন এবার অম্বালিকার শয়নগৃহে গেলেন। কিন্তু দ্বৈপায়নের বিকট কালো রূপ, পিঙ্গল চুল আর দাড়ি-গোঁফের জটা দেখে অম্বালিকা ভয়ে পান্ডু-বর্ণ (ফ্যাকাশে) হয়ে গেলেন। অম্বালিকার সাথে মিলিতো হয়ে ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে এসে দ্বৈপায়ন সত্যবতীকে জানালেন এর গর্ভের পুত্র বিক্রমশালী খ্যাতিমান এবং পঞ্চপুত্রের পিতা হবে, কিন্তু মাতার দোষে পান্ডুবর্ণ হবে।
যথাসময়ে অম্বিকা ধৃতরাষ্ট্র নামে একটি অন্ধ পুত্রের জন্ম দিল, আর অম্বালিকা পান্ডু নামে একটি পান্ডুবর্ণ পুত্র প্রসব করল।
পুত্র প্রসবের পরে অম্বিকা আবার ঋতুমতী হলে সত্যবতী তাঁকে আর একবার দ্বৈপায়ন ব্যাসের কাছে যেতে বললেন, কিন্তু দ্বৈপায়নের রূপ আর গন্ধের কথা মনে করে অম্বিকা নিজে না গিয়ে অপ্সরার মতো রূপবতী এক দাসীকে পাঠিয়ে দিল। সেই দাসীর অভ্যর্থনা, সেবা ও পরিচর্যায় সন্তুষ্ট হয়ে দ্বৈপায়ন ব্যাস বললেন- "তুমি আর দাসী হয়ে থাকবে না, তোমার গর্ভস্থ পুত্র ধর্মাত্মা ও পরম বুদ্ধিমান হবে।" সেই দাসীর গর্ভে বিদুর জন্মগ্রহণ করেন।
অণীমান্ডব্য মুনির কাহিনী
মান্ডব্য নামে এক মৌনব্রতী ঊর্ধ্ববাহু তপস্বী ছিলেন। একদিন কয়েকজন চোর চুরিকরা মালামাল সহ মান্ডব্যের আশ্রমে এসে লুকিয়ে রাইল। রাজার রক্ষীরা আশ্রমে এসে মান্ডব্যের কাছে চোরদের সম্পর্কে জানতে চাইলো কিন্তু তিনি মৌনব্রতের কারণে কোন উত্তর দিলেন না। রক্ষীরা আশ্রমে তল্লাশী করে চোরদের মামামাল সহ ধরে ফেললো। মান্ডব্য মুনি প্রশ্নের জবাবা না দেয়াতে রক্ষীরা চোরদের সঙ্গে মান্ডব্যকেও রাজার কাছে নিয়ে হাজির করলো। রাজা তাঁদের সবাইকে শূলে চড়ানোর আদেশ দিলেন। সবাইকে শূলে চড়ানোর পরে দেখা গেলো মান্ডব্য তপস্যার প্রভাবে জীবিত রইলেন এবং শূলের উপরে বসেই তাপস্য করতে লাগলেন। তাই দেখে রাজা মান্ডব্যের কাছে ক্ষমা চাইলেন এবং তাঁকে শূল থেকে নামালেন, কিন্তু শূলের ভাঙ্গা অগ্রভাগ মান্ডব্যের শরীরের মধ্যে রয়ে গেল। এইকারণে তার নাম হলো অণীমান্ডব্য।
মান্ডব্য ধর্মরাজের কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, কোন কর্মের ফলে তাঁকে এই দন্ড দেয়া হয়েছে।
ধর্মরাজ জানালেন মান্ডব্য মুনি ছোট বেলায় একটি পতঙ্গের পুচ্ছদেশে তৃণ প্রবিষ্ট করেছিলেন, তার জন্যই এই শাস্তি পেয়েছেন।
তাই শুনে মান্ডব্য বললেন- "আপনি লঘু পাপে আমাকে গুরুদন্ড দিয়েছেন। আমার শাপে আপনি শুদ্র হয়ে জন্মগ্রহণ করবেন। আজ আমি এই বিধান দিচ্ছি চতুর্দশ বৎসর রয়সের মধ্যে কেউ কিছু করলে তা পাপ বলে গণ্য হবে না।"
অণীমান্ডব্যের অভিশাপের ফলেই ধর্মরাজ দাসীর গর্ভে বিদুররূপে জন্মেছিলেন।
====================================================================
বিশেষ ঘোষণা : হিন্দুদের ধর্মীয় সাহিত্যের মহাকাব্য মহাভারতের কথা আমরা সকলেই জানি। আমি এটিকে পড়ছি একটি কল্পকাহিনীর সাহিত্য হিসেবে, ধর্মগ্রন্থ হিসেবে নয়। আমি মনে করি "যার যার বিশ্বাস তার তার কাছে। অন্যের বিশ্বাস বা ধর্মানুভূতিতে খোঁচা দেয়ার কোনো ইচ্ছে আমার নেই।" এই গ্রন্থে প্রচুর কল্পকাহিনী রয়েছে। সেগুলিই আমি এই সিরিজে পেশ করবো। যারা মহাভারত পড়েননি তারা এখান থেকে ধারাবাহিক ভাবে সেগুলি জেনে যাবেন। মনে রাখতে হবে আমার এই পোস্ট কোনো ভাবেই ধর্মীয় পোস্ট নয়।
লেখার সূত্র : কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস কৃত মহাভারত : অনুবাদক - রাজশেখর বসু।
ছবির সূত্র : এই সিরিজে ব্যবহৃত সকল ছবি বিভিন্ন সাইট থেকে সংগৃহীত।
====================================================================
সিরিজের পুরনো পর্বগুলি দেখতে -
মহাভারতের গপ্পো - ০০১, মহাভারতের গপ্পো - ০০২, মহাভারতের গপ্পো - ০০৩, মহাভারতের গপ্পো - ০০৪
মহাভারতের গপ্পো - ০০৫, মহাভারতের গপ্পো - ০০৬, মহাভারতের গপ্পো - ০০৭, মহাভারতের গপ্পো - ০০৮
মহাভারতের গপ্পো - ০০৯, মহাভারতের গপ্পো - ০১০, মহাভারতের গপ্পো - ০১১, মহাভারতের গপ্পো - ০১২
মহাভারতের গপ্পো - ০১৩, মহাভারতের গপ্পো - ০১৪, মহাভারতের গপ্পো - ০১৫, মহাভারতের গপ্পো - ০১৬
মহাভারতের গপ্পো - ০১৭
====================================================================
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই সেপ্টেম্বর, ২০২১ রাত ১১:৪৯