আমরা জানি, হযরত মোহাম্মাদ (সাঃ) এর ঔরসে সর্বমোট সন্তান ছিল ৭ জন। এদের মধ্যে ৬ জন জন্ম নিয়ে ছিলেন হযরত খাদিজা (রাঃ) এর গর্ভে আর বাকি একজন জন্মে ছিল হযরত মারিয়া কিবতিয়্যা এর গর্ভে। হযরত মোহাম্মাদ (সাঃ) এর ৭ সন্তানের মধ্যে ৩ জন ছিল পুত্র যারা শৈশবেই ইন্তেকাল করেন। এই ৩ পুত্র হচ্ছেন –
১ম পুত্র : আবুল কাসেম। যখন সবেমাত্র হাঁটতে শিখেছেন তখনই তাঁর ইন্তেকাল হয়।
২য় পুত্র : আব্দুল্লাহ। আব্দুল্লাহকে তৈয়াব ও তাহের নামেও ডাকা হতো। কথা বলতে শুরু করেছেন এমনি সময়ে তিনি ইন্তেকাল করেন।
৩য় পুত্র : ইব্রাহীম। মাত্র ১৮ মাস বয়সে ইব্রাহীম ইন্তেকাল করেন।
কন্যা:
১ম কন্যা : হযরত জয়নব (রাঃ)।
২য় কন্যা : হযরত রুকাইয়া (রাঃ)।
৩য় কন্যা : হযরত উম্মে কুলসুম (রাঃ)।
৪র্থ কন্যা : হযরত ফাতেমা (রাঃ)।
আজকে আমরা আলোচনা করার চেষ্টা করব হযরত মোহাম্মাদ (সাঃ) এর তৃতীয়া কন্যা হযরত উম্মে কুলসুম (রাঃ)। সম্পর্কে।
হযরত উম্মে কুলসুম (রাঃ)
হযরত উম্মে কুলসুম (রাঃ) ছিল হযরত খাদিজার (রাঃ) গর্ভে হযরত মোহাম্মাদ (সাঃ) এর ঔরসে তৃতীয়া কন্যা। হযরত উম্মে কুলসুম (রাঃ) এর আসল নাম ছিল উমাইয়া। ধারনা করা হয় হযরত মোহাম্মাদ (সাঃ) নবুয়ত লাভের ছয় বছর পূর্বে হযরত উম্মে কুলসুম (রাঃ) এর জন্ম হয়। হযরত উম্মে কুলসুম (রাঃ) এর শৈশবের তেমন কোন তথ্য পাওয়া যায় না। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে হযরত উম্মে কুলসুম (রাঃ) এর বিয়ে হয় অতি শৈশবে তার চাচাত ভাই উতাইবার (আবু লাহাবের পুত্র) সাথে। হযরত মোহাম্মাদ (সাঃ) ইসলাম ধর্ম প্রচার শুরু করলে প্রথম দিকেই হযরত উম্মে কুলসুম (রাঃ) ইসলাম গ্রহণ করেন। হযরত উম্মে কুলসুম (রাঃ) এর শ্বশুর আবু লাহাব আর তার স্ত্রী উম্মে জামীলা হযরত মোহাম্মাদ (সাঃ) ও মুসলিমদের সবচেয়ে বড় শত্রু হয়ে উঠে। অথচ আবু লাহাব ও তার স্ত্রী উম্মে জামীলা হযরত মোহাম্মাদ (সাঃ) চাচা চাচী ছিল। তারা হযরত মোহাম্মাদ (সাঃ) এর উপরে অকথ্য অত্যাচার শুরু করে। আবু লাহাবের স্ত্রী উম্মে জামীলা রাতে বন থেকে কাটা গাছ নিয়ে এসে হযরত মোহাম্মাদ (সাঃ) এর চলার পথে ছিটিয়ে রাখত। সকালে সেই কাটায় হযরত মোহাম্মাদ (সাঃ) এর পা কেটে রক্তাক্ত হত। অত্যাচার আরও বেড়ে গেলে সুরা লাহাব নাজেল হয়।
সুরা লাহাব
শুরু করছি আল্লাহর নামে যিনি পরম করুণাময়, অতি দয়ালু।
আবু লাহাবের হস্তদ্বয় ধ্বংস হোক এবং ধ্বংস হোক সে নিজে,
কোন কাজে আসেনি তার ধন-সম্পদ ও যা সে উপার্জন করেছে।
সত্বরই সে প্রবেশ করবে লেলিহান অগ্নিতে
এবং তার স্ত্রীও-যে ইন্ধন বহন করে,
তার গলদেশে খর্জুরের রশি নিয়ে।
এই সুরা নাজিল হওয়ার পরে আবু লাহাব আর তার স্ত্রী সুরাটি শোনার পরে প্রচণ্ড রেগে গিয়ে তাদের দুই ছেলেকে ডেকে বলে হযরত মোহাম্মাদ (সাঃ) এর বাড়ীতে গিয়ে তার দুই কন্যাকে তালাক দিয়ে আসতে। বাবা মার কথা শুনে দুই ভাই তখনই হযরত মোহাম্মাদ (সাঃ) এর বাড়িতে ছুটে গিয়ে হযরত রুকাইয়া (রাঃ) ও হযরত উম্মে কুলসুম (রাঃ) কে তালাক দিয়ে আসে। মায়ের নির্দেশে উতাইবা হযরত উম্মে কুলসুম (রাঃ) কে তালাক দেয়। তখনও উম্মে কুলসুম তার বাবা হযরত মোহাম্মাদ (সাঃ) এর বাড়ীতেই ছিল। শিশু অবস্থায় বিয়ে হওয়াতে তাকে স্বামীর বাড়ীতে পাঠান হয়নি। তাই বিয়ে হলেও কুমারী অবস্থায়ই তার তালাক হয়।
উতাইবা শুধু উম্মে কুলসুমকে তালাক দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি বরং হযরত মোহাম্মাদ (সাঃ) কে নানা কটু কথায় জর্জরিত করতে থাকে। এমনকি এক পর্যায়ে সে হযরত মোহাম্মাদ (সাঃ) এর উপরে চরাও হয়লে হযরত মোহাম্মাদ (সাঃ) এর গায়ের জামা ছিরে যায়। উতাইবার কটু কথা আর এহেন আচরণে ব্যথিত হযরত মোহাম্মাদ (সাঃ) উতাইবাকে বদ-দোয়া দেয় যাতে তাকে বাঘ বা সিংহ এসে হত্যা করে। নবীর বদ-দোয়ার কথা শুনে আবু লাহাব ছেলে উতাইবার জন্য চিন্তিত হয়ে পরেন। সব সময় সাবধানে ছেলেকে আগলে রাখেন। একবার সিরিয়ায় বাণিজ্য করতে যাওয়ার সময় আবু লাহাব তার ছেলে উতাইবাকে ঘুমানোর জন্য বাণিজ্যের মাল দিয়ে তৈরি প্রাচীরের ভিতরে রাখেন। লোকজন রাতে পাহারায় থাকে। কিন্তু তবুও রাতে একটি হিংস্র প্রাণী এসে উতাইবার ঘাড় মটকে নিয়ে যায়।
হিজরি ২য় বছরে হযরত উসমান (রাঃ) স্ত্রী (হযরত মোহাম্মাদ (সাঃ) এর দ্বিতীয়া কন্যা) হযরত রুকাইয়া (রাঃ) ইন্তেকাল করলে হযরত উসমান (রাঃ) খুবই মনমরা হয়ে পরে। তখন হযরত ওমর (রাঃ) এর যুবতী বিধবা মেয়ে হযরত হাফসা (রাঃ) এর বিয়ের প্রস্তাব উসমানকে দেয়া হয়। কিন্তু হযরত উসমান (রাঃ) এর কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে হযরত ওমর (রাঃ) মনের দুঃখের কথা হযরত মোহাম্মাদ (সাঃ) কে বলতে আসলে পরে হযরত মোহাম্মাদ (সাঃ) বলে যে ওসমানের চেয়েও ভালো পাত্র সে নিজেই হাফসাকে বিয়ে করবে। আর হাফসার চেয়েও ভালো পাত্রী তার নিজের মেয়ে হযরত উম্মে কুলসুমকে ওসমানের কাছে বিয়ে দিবেন।
এদিকে হযরত রুকাইয়া (রাঃ) ইন্তেকালের পরে হযরত উসমান (রাঃ) খুবই মনমরা হয়ে থাকতেন। একদিন হযরত মোহাম্মাদ (সাঃ) উসমানের এই মনমরা থাকার কারণ জানতে চাইলে হযরত উসমান (রাঃ) বলে রুকাইয়া ইন্তেকাল করাতে নবীর সাথে তার অনাত্মীয়তার সম্পর্ক আগের মত নেই তাই মন খারাপ। তখন হযরত মোহাম্মাদ (সাঃ) এর কাছে জিবরাঈল এসে বলে আল্লাহ হুকুম করেছেন যাতে রুকাইয়ার দেনমহরেই উসমানের সাথে উম্মে কুলসুমের বিয়ে দেয়া হয়। তিনি সাথে সাথেই হযরত উসমান (রাঃ) এই সুখবর জানান। হিজরি ৩য় বছরে হযরত উসমান (রাঃ) আর হযরত উম্মে কুলসুম (রাঃ) বিয়ে হয় হযরত রুকাইয়া (রাঃ) দেনমহরেই। এই বিয়ের পরে হযরত উসমান (রাঃ) জুন নুরাইন খেতাব পান, যার অর্থ দুই নূরের অধিকারী। হযরত মোহাম্মাদ (সাঃ) এর দুই কন্যাই এই দুই নূর। হযরত মোহাম্মাদ (সাঃ) এর দুই কন্যাকে বিয়ে করেছেন বলে উসমানকে এই খেতাব দেয়া হয়।
হিজরি নবম সালে হযরত উম্মে কুলসুম (রাঃ) ইন্তেকাল করেন। হযরত উম্মে কুলসুম (রাঃ) এর কোন সন্তানাদি ছিল না। মদিনার জান্নাতুল বাকীতে তাকে কবর দেয়া হয়। হযরত উম্মে কুলসুম (রাঃ) এর মৃত্যুর পরে নবী বলেছিলেন তার আরও বিয়ের যোগ্য অবিবাহিত মেয়ে থাকলে তিনি একে একে তাদের সবাইকে উসমানের কাছে বিয়ে দিতেন।
সমাপ্ত
সূত্র :
বইয়ের নাম : প্রিয় নবীর কন্যাগণ (রাযিঃ) – লেখক হুসাইন বিন সোহরাব।
বইয়ের নাম : আসহাবে রাসুলের জীবনকথা ১ম খন্ড – লেখক মুহাম্মদ আবদুল মাবুদ।
বইয়ের নাম : আসহাবে রাসুলের জীবনকথা ৬ষ্ঠ খন্ড – লেখক মুহাম্মদ আবদুল মাবুদ।
বইয়ের নাম : বেহেশতের রমণীগণ – লেখক মোঃ নূরুজ্জামান।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই আগস্ট, ২০১৫ রাত ৯:৫৮