প্রথম পর্বের সারসংক্ষেপ : হযরত মোহাম্মাদ (সাঃ) এর নবুয়ত প্রাপ্তির পূর্বেই তার প্রথম কন্যা হযরত জয়নব (রাঃ) এর জন্ম হয় ও ছোট বেলাতেই তার খালাত ভাই আবুল আস ইবনে রাবীর সাথে বিয়ে হয়। হযরত মোহাম্মাদ (সাঃ) এর নবুয়ত প্রাপ্তির পরে ইসলাম প্রচার শুরু করলে হযরত জয়নব (রাঃ) ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন কিন্তু তার স্বামী ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন না। নবুয়তের ১৩ বর্ষে হযরত মোহাম্মাদ (সাঃ) মক্কা ছেড়ে মদিনায় হিজরত করলে পরে তার পরিবারের বাকি সদস্যরা মদিনায় হিজরত করেন, কিন্তু হযরত জয়নব (রাঃ) তার অমুসলিম স্বামীর সাথে মক্কাতেই থেকে যান। এর পর........
হযরত মোহাম্মাদ (সাঃ) মদিনায় হিজরতের পরে মুসলিমদের শক্তি আরও বাড়তে থাকে দেখে মদিনার কুরাইশরা হযরত মোহাম্মাদ (সাঃ) এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য প্রস্তুত হতে থাকে। হযরত জয়নব (রাঃ) এর স্বামী আবুল আস ইবনে রাবীও হযরত মোহাম্মাদ (সাঃ) এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য তৈরি হয়। হিজরি দ্বিতীয় সনে বদরের সেই যুদ্ধে মাত্র তিন শতাধিক সৈন্য নিয়ে যুদ্ধ করে মুসলিমরা বিশাল কুরাইশ বাহিনীকে যুদ্ধে হারিয়ে দেয়। অনেক কুরাইশ নেতা নিহত হয় আর বন্দীও হয় অনেকে। বন্দীদের মাঝে ছিল হযরত জয়নব (রাঃ) এর স্বামী আবুল আস ইবনে রাবীও। যুদ্ধ শেষে বন্দীদের মদিনায় নিয়ে আসা হলে হযরত মোহাম্মাদ (সাঃ) তার সাহাবীদের সাথে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিলেন মুক্তিপণ নিয়ে যুদ্ধবন্দীদের মুক্তি দিবেন।
হযরত মোহাম্মাদ (সাঃ) এর কন্যা হযরত জয়নব (রাঃ) তার স্বামীর মুক্তিপণের অর্থ জোগাড় করতে না পেরে তার গলার হার মুক্তিপণ হিসেবে মদিনায় পাঠিয়ে দেন। এই হারটি হযরত জয়নব (রাঃ) এর বিয়ের সময় তার মা হযরত খাদিজা (রাঃ) তাকে উপহার দেন। হারটি দেখেই হযরত মোহাম্মাদ (সাঃ) চিনতে পারেন। সাহাবিদের ডেকে বলেন সম্ভব হলে এই হার না রেখে হযরত জয়নব (রাঃ)কে ফিরিয়ে দিতে। হযরত মোহাম্মাদ (সাঃ) এর কথা শুনে সাহাবীরা মুক্তিপণ ছাড়াই আবুল আস ইবনে রাবী মুক্তি দেন। তবে হযরত মোহাম্মাদ (সাঃ) আবুল আস ইবনে রাবীকে শর্ত দেন মক্কায় পৌঁছেই হযরত জয়নব (রাঃ)কে মদিনায় পাঠিয়ে দিতে হবে। কথা হয় আবুল আস ইবনে রাবী মক্কায় গিয়ে হযরত জয়নব (রাঃ) কে মদিনার দিকে নিয়ে আসবেন, পথে হযরত মোহাম্মাদ (সাঃ) এর পালক পুত্র জায়েদ ইবনে হারিস বাতনি ইয়াজুজ নামক স্থানে হযরত জয়নব (রাঃ) এর জন্য অপেক্ষা করবে। সেখান থেকে জায়েদ ইবনে হারিস হযরত জয়নব (রাঃ) কে মদিনা পর্যন্ত নিয়ে আসবে।
আবুল আস ইবনে রাবী মক্কায় পৌঁছে তার ছোট ভাই কেনানার সাথে হযরত জয়নব (রাঃ)কে পাঠিয়ে দেন। কিন্তু কিছুদূর গেলে পরে কুরাইশরা তাদের আক্রমণ করে। অন্তঃসত্ত্বা হযরত জয়নব (রাঃ) তখন উটের পিঠ থেকে পরে গিয়ে তার গর্ভপাত হয়ে যায়। কুরাইশরা রক্তাক্ত হযরত জয়নব (রাঃ) আর কেনানাকে আক্রমণ করতে এলে কেনানা রুখে দাঁড়ায়। তখন আবু সুফিয়ান সেখানে উপস্থিত হলে তার পরামর্শে আক্রমণকারীরা ফিরে যায় আর হযরত জয়নব (রাঃ)ও মক্কায় ফিরে আসে। পরে কিছুটা সুস্থ হলে আবার কেনানা হযরত জয়নব (রাঃ)কে নিয়ে বাতনি ইয়াজুজে অপেক্ষারত জায়েদ ইবনে হারিসের কাছে তুলে দেয়। জায়েদ ইবনে হারিস হযরত জয়নব (রাঃ) কে নিয়ে মদিনায় হযরত মোহাম্মাদ (সাঃ) এর কাছে পৌঁছে দেয়। তখন থেকে হযরত মোহাম্মাদ (সাঃ) এর বড় কন্যা হযরত জয়নব (রাঃ) পিতার কাছে মদিনাতেই অবস্থান করতে থাকে।
এদিকে প্রায় ৬ বছর পেরিয়ে গেলে ব্যবসায়ী আবুল আস ইবনে রাবী গেলেন সিরিয়ায় ব্যবসা করতে। সেখান থেকে ফেরার সময় হযরত মোহাম্মাদ (সাঃ) এর প্রেরিত শতাধিক সৈন্যের একটা দল আবুল আস ইবনে রাবীর ব্যবসায়ী দলটিকে আক্রমণ করে তাদের মালামাল ছিনিয়ে নেয় আর লোকদের বন্দী করে। কিন্তু আবুল আস ইবনে রাবী কৌশলে পালিয়ে গিয়ে হযরত জয়নব (রাঃ) এর ঘরে আশ্রয় নেয়। ভোরে হযরত মোহাম্মাদ (সাঃ) যখন মুসুল্লিদের নিয়ে নামাজ আদায় করছেন তখন হযরত জয়নব (রাঃ) হযরত মোহাম্মাদ (সাঃ)কে জানায় যে সে আবুল আস ইবনে রাবীকে আশ্রয় দিয়েছে। হযরত মোহাম্মাদ (সাঃ) এর কাছে আবদার করে যাতে আবুল আস ইবনে রাবীকে সমস্ত মালামাল সহ মুক্তি দেয়া হয়। হযরত মোহাম্মাদ (সাঃ) তার সাহাবীদের বিষয়টি বললে মালামাল সহ আবুল আস ইবনে রাবী মুক্তি পায়। আবুল আস ইবনে রাবী মক্কায় পৌঁছে তার কাছে মক্কাবাসীর গচ্ছিত সম্পদ সবাইকে ফিরিয়ে দিয়ে সাথে সাথে নিজেকে মুসলিম হিসেবে ঘোষণা দেয়। এরপরেই সে মক্কা থেকে হিজরত করে মদিনায় চলে আসে নিজরে স্ত্রীর কাছে।
৬ বছর পরে আবার স্বামী স্ত্রীর মিলন ঘটে। আলাদা বাড়ি নিয়ে তারা বসবাস শুরু করেন। যতদূর জানায় যায় হযরত জয়নব (রাঃ) এর তখন দুই অথবা তিনটি সন্তান ছিল। তাদের একটি সন্তান হযরত মোহাম্মাদ (সাঃ) এর কোলেই শিশু অবস্থায় মারা যায়। স্বামী স্ত্রীর পুনর্মিলনের পরে খুব বেশি দিন তারা একসাথে থাকতে পারে না। মাত্র বছর খানিক সময় পরেই হিজরি ৮ সালে হযরত জয়নব (রাঃ) ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুকালে হযরত জয়নব (রাঃ) এর বয়েস হয়েছিল মাত্র ৩১ বছর বয়সে। হযরত জয়নব (রাঃ) এর ইন্তেকালের মাত্র ৪ বছর পরেই তার স্বামী আবুল আস ইবনে রাবীও ইন্তেকাল করেন।
হযরত জয়নব (রাঃ) এর মৃতদেহ হযরত মোহাম্মাদ (সাঃ) এর নির্দেশ মত গোছল করানো হয়। পরে কাফন পরানোর সময় আর্থিক অসংগতির কারণে কাপড় কম পরলে হযরত মোহাম্মাদ (সাঃ) তার নিজের কাপড় দিয়ে দেন কাফন হিসেবে ব্যবহার করার জন্য। মৃত্যুকালে হযরত জয়নব (রাঃ) এর এক ছেলে আলী ও এক মেয়ে উমামাহ জীবিত ছিল। মাতৃহারা এই সন্তানদের হযরত মোহাম্মাদ (সাঃ) খুবই ভালোবাসতেন। আলীকে অনেক সময় হযরত মোহাম্মাদ (সাঃ) নিজের সাথে নিয়েই সফরে বের হতেন। মক্কা বিজয়ের সময় আলী তার নানার সাথেই ছিল। আলীর মৃত্যুকাল নিয়েও কিছুটা দ্বিমত আছে। কারও কারও মতে আলী তার বাবার জীব্বদশাতেই যৌবনপ্রাপ্তির আগে মারা যান। আবার কেউ কেউ বলে আলী আবু বকরের খিলাফত কালে ইয়ারমুকের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে শাহাদাত বরণ করেন।
হিজরি ১১ সালে হযরত জয়নব (রাঃ) কন্যা উমামাহ বয়ঃপ্রাপ্ত হয়। তার পিতা আবুল আস ইবনে রাবী মৃত্যুকালে যুবাইর ইবনে আওয়ামকে বলে যান সৎ পাত্র দেখে উমামাহকে বিয়ে দিতে। আবার তখন হযরত মোহাম্মাদ (সাঃ) এর ছোট কন্যা ফাতেমা মারা যাওয়ার সময় হযরত আলী (রাঃ)কে বলে যান আলী যেন তার বড়বোনের কন্যা উমামাহকে বিয়ে করেন। ফলে হযরত ফাতেমা (রাঃ) এর ইন্তেকালের পরে হযরত আলী (রাঃ) উমামাহকে বিয়ে করেন। আলীর ঔরসে উমামাহর গর্ভে কোন সন্তান জন্মের তথ্য পাওয়া যায় না। আলী মৃত্যুর সময় অসিয়ত করে যান যেন তার মৃত্যুর পর উমামাহ বিশিষ্ট সাহাবি মুগীরা ইবনে নাওফালকে বিয়ে করেন। ফলে হযরত আলী (রাঃ) এর ইন্তেকালের পরে উমামাহ মুগীরা ইবনে নাওফালকে বিয়ে করেন। মুগীরার সাথে বিয়ের পরে মুগীরার ঔরসে উমামাহর গর্ভে ইয়াহহিয়া নামে এক পুত্র জন্ম নেয়। তবে ইয়াহহিয়া শৈশবেই ইন্তেকাল করেন।
সমাপ্ত
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা আগস্ট, ২০১৫ সকাল ৯:৪৪