২৫ জানুয়ারি রওনা হয়ে ২৬ তারিখে সকালে পৌছাই খাগড়াছড়ি। একটি মাহেন্দ্রা গাড়ি রিজার্ভ করে নিয়ে সারা দিনের জন্য বেরিয়ে পড়ি খাগড়াছড়ি ভ্রমণে। একে একে দেখে ফেলি আলুটিলা গুহা, রিছাং ঝর্ণা, শতবর্ষী বটবৃক্ষ আর ঝুলন্ত সেতু।
রাতের খাবার খেয়ে হোটেলে ফিরে ঘুমের জন্য প্রস্তুতি। ঘুমতে যাওয়ার আগে আমাদের সিঙ্গেল মেম্বার স্বপনের রুমে জমে আড্ডা। যদিও স্বপন একা রুম কিন্তু ওর ডবল, খাটের উপর আয়েস করে বসে আগামী কালের পগ্রাম নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। হোটেলের সামনেই দেখেছি একটা লোক সামুদ্রিক ছোট মাছ তেলে ভাজছে, সেগুলি নিয়ে এসেছিলাম..............
আগামীকাল যাবো খাগড়াছড়ি থেকে রাঙ্গামাটি। দুই ভাবে যাওয়া যাবে, এক খাগড়াছড়ি থেকে বাসে যাওয়া যাবে রাঙ্গামাটি, দুই চান্দের গাড়ি রিজার্ভ করে যাওয়া যাবে। আর একটি পথ আছে দীঘিনালা হয়ে লঞ্চে করে যাওয়ার যাবে কাপ্তাই ভ্রমণ করতে করতে। এই পথটাই আমার বেশি পছন্দের। সিদ্ধান্ত হল শেষের পথটাই ধরার চেষ্টা করা হবে, সেটা যদি না হয় তাহলে দ্বিতীয় পথ চান্দের গাড়ি নেয়া। বাসের পথটা সর্বসম্মত ক্রমে বাদ দেয়া হল।
২৭ তারিখ সকাল, আস্তে ধীরে একে-একে সবাই উঠছে ঘুম থেকে। কিছুক্ষণ পরেই বেরিয়ে যাব হোটেল ছেড়ে। যাওয়ার ইচ্ছে ছিল “হাজাছড়া ঝর্ণাতে” শেষ পর্যন্ত যাওয়া হয়নি, কারণ গতকালের ড্রাইভার জানিয়েছে ঝর্ণাতে পানি নেই। “দেবতা পুকুরেও” যাওয়া হবে না, অনেকটা পাহাড়ি পথ হেঁটে উঠতে হবে, প্রথম দিনের ধকলের পর মেয়ে আর শিশুদের কথা বিবেচনা করে সেটাও বাদ দিয়ে দিলাম। আর জানতে পারলাম (হোটেলের ম্যানেজারের কাছ থেকে) দীঘীনালা থেকে লঞ্চে যাওয়ার ব্যবস্থাটা ঠিক হবে না। কারণ এই সময় নাকি কয়েক যায়গায় পানি এতো কম থাকে যে তখন নৌককেই টেনে নিয়ে যেতে হয়। তাই স্বপনকে পাঠিয়ে দিলাম চান্দের গাড়ির রাঙ্গামাটি পর্যন্ত ভাড়া কত নিবে সেটা জেনে আসতে, ও খবর নিয়ে এসেছে ৬০০০ টাকা চায় রিজার্ভ ভাড়া।
সকালের নাস্তা সেরে আমরা প্রথমে চেষ্টা করলাম শাপলা চত্তরের সামনে থেকে চান্দের গাড়ি ভাড়া করতে। ড্রাইভাররা একজোট হয়ে দাম হাকাতে লাগল তাই আমরা সেখান থেকে চলে গেলাম বাস ষ্টেশনে। সেখানেও ড্রাইভাররা সব একজোট হয়ে গেলো, ভাড়া হাঁকাতে লাগলো মনের মত। বাধ্য হয়ে আমরা বাস কাউন্টারে গেলাম, বাসের অবস্থা দেখে দমে গেলাম। তখনই পেছন থেকে একজন বললো -
“০০০০ টাকায় আমি নিয়ে যাব কিন্তু এইখান থেকে উঠাতে পারব না, আপনাদের হোটেলের সামনে থেকে উঠাব। কাউকে বলা যাবেনা আমি এই ভাড়ায় যাইতেছি।“
আমরা এক বাক্যে রাজি। ড্রাইভারের মোবাইল নাম্বার নিয়ে ফিরতে শুরু করলাম হোটেলের দিকে। হোটেলের সামনে এসে দেখি চান্দের গাড়ি হাজির হয়ে গেছে।
{খাগড়াছড়ি গেট}
{আজ পর্যন্ত আমার দেখা সবচেয়ে অদভূত ডাস্টবিন যা খাগড়াছড়ির শহরে অনেকগুলি আছে।}
{যদিও দেখে মনে হয় না তবুও এটা নাকি রাষ্ট্রপতি জিয়ার মূর্তি}
হোটেলের লেনদেন চুকিয়ে সবাই ব্যাগ-ব্যাগেজ নিয়ে উঠলাম চান্দের গাড়িতে। উপর নিচ মিলিয়ে জনা ২৫ লোক নিয়ে চলে এই চান্দের গাড়ি, সেখানা আমরা মাত্র কজন। গাড়ি চলতে শুরু করলো বিশাল ঝাঁকুনির সাথে। লোড বেশি হলে ঝাঁকুনি কিছুটা কম লাগতো হয়তো। আমার মাথা ৪-৫ বার গাড়ির ছাদের সাথে বাড়ি লেগে খুব ব্যথা পেয়ে ছিলাম।
{চেঙ্গী নদী}
অল্প কয়েক মিনিটে শহরের ভেতর থেকে বেরিয়ে চেঙ্গী নদী পেরিয়ে “চেঙ্গী এপার্টমেন্ট এলাকা”-তে অবস্থিত “অপরাজিতা বৌদ্ধ বিহার” এর সামনে এসে দাঁড়ায় আমাদের গাড়ি। বিহারে ভিতরে বিশাল এক বৌদ্ধ মূর্তি রয়েছে, মূলত সেটাই দেখতে এসেছি আমরা। গেটের বাইরে জুতা রেখে ভেতরে প্রবেশ করতে হয়। আমরা শুধু এই মূর্তিটার সামনেই গিয়েছি, মন্দিরের ভেতরে যাই নি, তাই ভেতরের কথা তেমন কিছুই জানি না। তবে মূর্তিটা সুন্দর, বিশাল মূর্তিটার গায়ে অসংখ্য ক্ষুদে বৌদ্ধ মূর্তি দিয়ে গায়ের জামা হিসেবে কারুকাজ করা হয়েছে।
শহরের কাছেই এই যায়গায় চলার পথে ঢুমেরে যেতে পারেন, খারাপ লাগবে না। এখানে কিছুক্ষণ ফটশেসানের পরে আবার রওনা হই, অনেক দূরের পথ যেতে হবে। এবারের গন্তব্য রাঙ্গামাটি।
ছবির মত সুন্দর পাহাড়ি পথে চলার শুরু হল আমাদের। চার পাশে ছড়িয়ে আছে পাহাড়ি সৌন্দর্য। শীতের সময় বলে পাহার কিছুটা রুক্ষ, তার পরও দেখার আছে নয়ন জুড়ানো দৃশ্য।
পাহাড়ি একে-বেকে চলা পথ আর খাঁদ, বেইলি ব্রিজ আর বিপদজনক বাক।
{বিজিতলা আর্মি ক্যাম্প, এখানে আপনাকে নামতে হবে না শুধু ড্রাইভার নেমে দেখা করে আসে।}
এক সময় পৌছে যাই রাঙ্গামাটি। আমাদের টার্গেট রাঙ্গামাটির রিজার্ভ বাজারে কোন একটা হোটেলে উঠার। প্রথমে একটা হোটেলের সামনে থামতেই সাথে এক ফেউ (দালাল) লেগে গেলো। ও আমার সাথে সাথে গেলো হোটেলের রিসিপশানে, হোটেলটি আধা আধি পছন্দ হল। নিচে নেমে আসতেই ফেউটা বলল সমনে ভালো হোটেল আছে ওর পরিচিত, আর ও হোটেলের দাদাল না। ওর একটা বোট আছে তাই আমাদের সাথে সাথে ঘুরতেছে বোট ভাড়ার জন্য, হোটেল থেকে কোন কমিশন ও নেয় না।
ওর দেখান “হোটেল লেক সিটি”-তে গেলাম। এখনও কাজ কম্পিলিট হয়নি হোটেলের, কিন্তু এর ভিউটা অতি মনোরম। রুমের সামনে খোলা যায়গা, একটা দোলনা আছে, দুটি খরগোশ দৌড়ে বেড়াচ্ছে (বাচ্চারা মহা খুশি) । এখান থেকেই চোখের সামনে বিছানো কাক-চক্ষু জলের সুবিশাল জলরাশি “কাপ্তাই লেক”দেখা যায়। কাপ্তায়ের জল এসে ছুঁয়ে যায় হোটেলের নিচে বর্ষার সময়।
ফাস্ট ফ্লোরে পাওয়া গেলো তিনটি কাঁপল রুম, আর সেকেন্ড ফ্লোরে পাওয়া গেলো একটি টিপল বেডের রুম, কোন সিঙ্গেল রুম নেই, । উপরের রুমটার ভাড়া অনেক বেশি কিন্তু অতি চমৎকার। বিশাল রুম রুমের সাথে বারান্দা, আরা বারান্দাটা ঝুলে আছে লেকের উপরে। এই বারান্দায় বসে সারা রাত কাটিয়ে দেয়া যাবে। যদিও স্বপন একা তারপরেও ওকেই এই বড় রুমটা দেয়া হল, কারণ আধা রাত পর্যন্ত এই রুম আমরাই দখল করে রাখবো.............
=================================================================
সিরিজের পুরনো পর্বগুলি দেখতে -
খাগড়াছড়ির পথে
খাগড়াছড়ি ভ্রমণ - প্রথম পর্ব
খাগড়াছড়ি ভ্রমণ - আলুটিলা গুহা
খাগড়াছড়ি ভ্রমণ - রিছাং ঝর্ণা
খাগড়াছড়ি ভ্রমণ – শতবর্ষী বটবৃক্ষ
খাগড়াছড়ি ভ্রমণ – ঝুলন্ত সেতু
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০২০ রাত ১০:৩৭