[সতর্কতা : পুর লেকায় ২৮টি ছবি দেয়া হয়েছে, যার মোট সাইজ ৭.৭৯ এমবি, তাই লোড হতে একটু সময় নিবে।]
এটা খাগড়াছড়ি ভ্রমণ সম্পর্কিত চতুর্থ পোষ্ট।
প্রথম পর্বে ছিল ঢাকা থেকে খাগড়াছড়ি পর্যন্ত যাওয়ার কথা – “খাগড়াছড়ির পথে”।
দ্বিতীয় পর্বে লিখে ছিলাম খাগড়াছড়িতে বেরাতে বেরবার প্রথম অংশ – “খাগড়াছড়ি ভ্রমণ – প্রথম পর্ব]”।
তৃতীয় পর্বটা ছিল আলুটিলা গুহার উপরে লেখা, শিরনাম – “খাগড়াছড়ি ভ্রমণ – আলুটিলা গুহা”।
আজ এই পর্বে লিখবো রিছাং ঝর্ণার কথা, তাই আজকের শিরনাম “খাগড়াছড়ি ভ্রমণ – রিছাং ঝর্ণা”।
আলুটিলা গুহা থেকে বেরিয়ে আবার শুরু হয় আমাদের মাহেন্দারে চরে রিছাং ঝর্ণার দিকে যাত্রা। আলুটিলা থেকে মাত্র ৪ কিলোমিটার সামনেই এই ঝর্ণা। আপনারা শুনে অবাক হবেন যে এই ঝর্ণাটা ব্যক্তি মালিকানাধীন। আকা-বাঁকা চমৎকার পাহাড়ি পথ ধরে ধীর গতিতে এগিয়ে চলে আমাদের বাহন। পথের চারপাশে ছড়িয়ে আছে রুক্ষ সৌন্দর্য। মাঝে মাঝেই চোখে পরে পাহাড়ি ঝুম চাষের ফসলহীন জমি।
{ ঝুম চাষ শেষ হয়েছে, কোন পাহাড়ি আদিবাসী নতুন বাড়ি তৈরির প্রস্তুতি নিয়েছে।}
এক সময় পৌঁছে যাই রিছাং ঝর্ণার গেইটের সামনে। ভেবেছিলাম এখান থেকেই হাঁটতে হবে, কিন্তু না ভেতরে গাড়ি যায়। ইটা বিছান রাস্তা ধরে এগিয়ে যেতে হয় আর কিছুটা পথ। এই পথটুকু পুরটাই পাহাড়ের চূড়ার উপর দিয়ে গিয়েছে। কিছু দূর এগবার পর রাস্তা নেমে গেছে অনেক ঢালু হয়ে, আবার উঠে গেছে চূড়ার দিকে। এই রাস্তাগুলিতে আমাদের ২ / ৩ জনকে কিছুক্ষণ পরপরই হেঁটে যেতে হয়েছে।
{দূরে ঝুমঘর}
যারা গাড়িতে বসা ছিল তারা মজা পেয়েছে রোলার কোস্টারের। একটা সময় রাস্তার একটা বাকের কাছে এসে গাড়ি থেমে গেলো। আর সামনে এগুবে না, এখান থেকে নিজের পায়ের উপরেই ভরসা রাখতে হবে, হাঁটতে হবে ঝর্ণা পর্যন্ত।
রাস্তাটা এতটাই খাড়া ভাবে নেমে গেছে যে উল্টো দিক থেকে কোন গাড়িই উঠে আসতে পারবে না। তাই কোনো গাড়ি আর নিচে নামে না। আমরা সবাই গাড়ি থেকে নেমে হাঁটা ধরলাম। পাহাড় থেকে নামা সব সময়ই সহজ, কিন্তু এই রাস্তাটার ক্ষেত্রে তা বলা যাবে না। একটু অসতর্ক হলে নামার গতি এতটাই বেড়ে যাবে যে তা থামানো সম্ভব হবে না। তাই আস্তে ধীরে দেখে শুনে নামতে হবে। তাছাড়া আমাদের সাথে আছে দুটি পিচ্চি। ওরা চাচ্ছে দ্রুত নেমে যেতে, আমরা হাত ধরে নিয়ে নামাচ্ছি।
পথ খুব বেশি নয় সর্বচ্চ মিনিট আটেক হাঁটলেই আপনি দেখতে পাবেন পাহাড় থেকে নিচে নেমে যাওয়ার সিঁড়ি আছে। পাহাড়ের ধার কেটে তৈরি করেছে এই পাকা সিঁড়ি।
{সবার আগে সিঁড়ির কাছে পৌছে গেছে ইস্রাফীল ও সাইয়ার।}
এই সিঁড়ির শেষ মাথাতেই রিছাং ঝর্ণার জল গড়িয়ে যাচ্ছে। সিঁড়িতে দাঁড়িয়েই দূরে ছোট্ট একটি চিকন জলধারা দেখা যায়, সেটাই আমাদের গন্তব্য – “রিছাং ঝর্ণা”। বুসরা দূর থেকে ঝর্ণা দেখে বলে উঠলো – “দেখ আকাশ থেকে পানি পড়তেছে”।
{ সিঁড়ির শেষ দেখা না গেলেও ঝর্ণাটাকে কিন্তু দেখা যাচ্ছে।}
মনে হবে অসংখ্য সিঁড়ি নেমে গেছে নিচের দিকে, এই সিঁড়ি আর শেষ হবে না। ছবি তুলতে তুলতে আর চার পাশ দেখতে দেখতে ধীরে সুস্থে নেমে যাওয়া যায়, সময় পাঁচ মিনিটের বেশি লাগে না।
সিঁড়ি বেয়ে যতই নিচে নামবেন ততই আপনার চোখের সামনে উৎভাসিত হতে থাকবে রিছাং ঝর্ণা তার রূপ-শুধা আর স্বচ্ছ জল নিয়ে।
{এটা কিন্তু কাশ ফুল নয়, ফুলের ঝাড়ু তৈরি হয় এই ফুল থেকে।}
ঝর্ণাটি আসলেই চমৎকার, বর্ষার সময় এর সৌন্দর্য নিশ্চয় আকাশ ছোঁয়া হয়। এই শীতের খটখটে শুকনোর সময়েও ঝর্ণাটি তার আকর্ষণীয় ক্ষমতা অটুট রেখেছে। পাহাড়ের উপর থেকে ছোট্ট একটা অংশ দিয়ে চিকন ধারায় পরছে জল ঝর্ণা হয়ে।
সেখান থেকে ঝর্ণার জল গড়িয়ে পরছে পাহাড়ের ঢালু কিনারায়। আসলে বলে বা ছবিতে কিছুতেই এই ঢালু অংশের বর্ণনা দেয়া সম্ভব না। ঢালুটার অনেকটা মিল আছে আমাদের মুনাজাত ধরার সময় দুই তালু যেখানে মিলে সেই অংশের সাথে।
যাইহোক এই ঢুলু অংশ দিয়ে ঝর্ণার জল বিশাল এক প্রাকৃতিক ওয়াটার স্লিপারে মত তৈরি করেছে। এখান থেকে জল গড়িয়ে গিয়ে স্লিপারের শেষ অংশে একটি স্বচ্ছ জলাধারে জমা হচ্ছে। এই অংশটা টলটলে বরফ শীতল জলে পরিপূর্ণ। খুব বেশি গর্ত না এখানে। আপনার যদি জলে ভিজতে আপত্তি না থাকে তাহলে ঝর্ণার গোড়া থেকে প্রাকৃতিক স্লিপারে চরে সাই করে নেমে আসতে পারবেন এই নিচের জলা ধারে। তারপর জল ডিঙ্গিয়ে উঠে আসবেন সিঁড়ির দিকের শুকনো ভূমিতে।
এই জলাধার থেকে চিকন একটা নালার মত হয়ে জল পাহাড়ের নিচের দিকে গড়িয়ে যেতে থাকে। জলাধারের পাশে ছোট্ট একটা পাথুরে যায়গা রয়েছে। প্রকৃতি তার সৌন্দর্য উপভোগের জন্য নিজ হাতে তৈরি করে রেখেছে বসার যায়গা। কিন্তু হায় মানুষের সেই সৌন্দর্যের মাঝে নিজেদের অসুন্দর মনের পরিচয় দিতে সামান্য কষ্ট হয় না। কোন একদল সৌন্দর্য পিপাষু পর্যটক তাদের সৌন্দর্য উপভোগের সাথে সাথে সেখানে বসে হয়তো দুপুরের খাবার খেয়েছিল। তাতে কোন দোষ নেই, কিন্তু খাওয়া শেষে খাবারের প্যাকেট, পানির বোতল, প্লাস্টিকের ব্যাগ ইত্যাদি ফেলে রেখে গেছে সেখানেই। কবে আমরা আর একটু সচেতন হব!!
ঝর্ণার কাছে যেতে হলে আপনি দুটি পথ ব্যবহার করতে পারেন। প্রথমটি হচ্ছে - আপনার ভিজার ইচ্ছে থাকলে জলাধার পার হয়ে ঢালু অংশটা ধরে উঠে যাবেন। আমরা এই পথে যাইনি, কারণ আমাদের ভেজার কোন প্রোগ্রাম ছিলনা। তাই আমরা ধরলাম বিকল্প পথ, পাহাড়ের গাঁ বেয়ে উঠা। বাচ্চা আর তাদের মায়েদের নিয়ে উঠতে সামান্য বেগ পেতে হয়েছে সেটা অস্বীকার করছি না। তবুও সব কষ্ট সার্থক হয়ে যায় উপরের ভয়ঙ্কর সৌন্দর্যের কাছে।
ভয়ঙ্কর সৌন্দর্য আখ্যায়িত করার কারণ হচ্ছে, ঝর্ণা যে সুন্দর তাত বলার অপেক্ষা রাখে না, আর ভয়ঙ্কর হচ্ছে উপরের বিশাল ঢালু অংশটা। একটু অসাবধান হলেই পা পিছলে চলে যেতে হবে প্রাকৃতিক স্লিপার ধেরে একে বারে নিচের জলা ধারে, আপনার পানিতে ভেজার পরিকল্পনা থাক আর নাই থাকে, ভিজতে আপনাকে হবেই। হাঁটু কুনোই ছুলবে সেটা বোনাস, তাই সাবধান। শীতকাল হওয়াতে আমরা কিছুটা সুবিধা পেয়েছি, উপরটা ভেজা থাকলে আর দেখতে হতো না। এখানে আমাদের সবচেয়ে বেশি ভয় ছিল বুসরাকে নিয়ে। কিছুতেই স্থির থাকতে চাইছিল না।
{বসির ফ্যামেলী}
{ইস্রাফীল ফ্যামেলী}
{দস্যু পরিবার}
{স্বপন}
ঐখানে বসে কিছুক্ষণ ফটোশেসান চলল।
তারপর আবার সবাইকে হাত ধরে ধরে নামানোর পালা। নিচে নেমে শিশুরা তাদের শিশুতোষ খেলায় মেতে উঠে, ছোট লাঠি নিয়ে জলার জলে জলের নকশা তৈরির খেলায়।
প্রকৃতির স্নিগ্ধতায় আর কিছুটা সময় কাটিয়ে আস্তে ধীরে উপরে উঠতে শুরু করি।
অনেকগুলি সিঁড়ি টপকাতে হবে আবার। সিঁড়ি টপকিয়েই শেষ না, নামার সময় যেটা ছিল ঢালু পথ এবার সেটা হবে খাড়া চরাই। তাই হাঁটতে থাকো। অবশ্য এই পথে বিশ্রাম নেয়ার যায়গার কোন কমতি নেই। ইচ্ছে করলেই বসে পরতে পারেন সিঁড়িতে, আর যদি একবারে সিঁড়ি টপকাতে চান তাহলে সিঁড়ি শেষ হলেই পাবেন বসে বিশ্রাম নেয়ার বিশ্রামাগার।
{কাঁচা হলুদ সংগ্রহ করছে}
দেখতে দেখতে একসময় সিঁড়ি টপকে চলে আসি পায়ে চলা রাস্তা, সেটাও শেষ হয়ে যায় একসময়।
{ঢালু পথে এবার ফিরে আসা}
এসে পৌছাই আমাদের গাড়ির সামনে। এখানে একটা টং দোকানের মত আছে। রিছাং ঝর্ণার মালিক এই দোকানের স্বত্বাধিকারী।
{রিছাং ঝর্ণার স্বত্বাধিকারী।}
{সবশেষে বলেন এটা কি জিনিস?}
=================================================================
সিরিজের পুরনো পর্বগুলি দেখতে -
খাগড়াছড়ির পথে
খাগড়াছড়ি ভ্রমণ - প্রথম পর্ব
খাগড়াছড়ি ভ্রমণ - আলুটিলা গুহা
খাগড়াছড়ি ভ্রমণ - রিছাং ঝর্ণা
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০২০ রাত ১০:১৪