সরকার কি মহাজোট সরকার নাকি মহাজট সরকার, ডিজিটাল নাকি ডিফিকাল্ট, দিন বদলের সরকার নাকি বলদের সরকার, বংশীয়করণ নাকি অন্যের বংশ ধ্বংসযজ্ঞের সরকার, সর্বশেষ গত ৫ অক্টোবর সাবেক প্রধান বিচারপতি হাবিবুর রহমানের দেয়া খেতাব ‘বাজিকরী সরকার'? এ সরকার তাদের ক্ষমতার দুই বছর অতিবাহিত করছে খুব খোশ আমোদে! দেশের ভয়াবহ পরিস্থিতিতে জনগণের যৌক্তিক প্রশ্ন- সরকার খোশ আমোদে আছেন কি করে? এ যেন উধার (ঋণ) করে হলেও সশব্দে বায়ু ত্যাগ করার মতো। তবে অন্য কারণটি হতে পারে- তোষামোদি চামচাদের জন্যই হয়তো সরকার এত খুশি। সরকারের নাকের ডগায় অপরাধের সব ভয়াল চিত্র চিত্রিত হলেও তা না দেখার ভান করছেন- ‘নাকের ডগাতো আর চোখে দেখা যায় না বলে।' (...) সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পূর্বে তাদের নির্বাচনী মেনোফেস্টোতে দু'ধরনের অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছিল। ব্যক্ত অঙ্গীকারের একটি ছিল দলীয় বা দলের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট অন্যটি জনগণের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট। অবস্থাদৃষ্টে উল্লেখপূর্বক জনগণের স্বার্থসংশ্লিষ্ট অঙ্গীকারকে সরকার কিভাবে ব্যঙ্গ বা উপহাস করেছে তা মিলিয়ে নেয়া যাক-
১. নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কমানো।
[ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) দৈনন্দিন বাজার পর্যবেক্ষণ রিপোর্ট, গত এক বছরে পণ্যমূল্য বেড়েছে ২৮ শতাংশেরও বেশি। আর এক মাসে দাম বেড়েছে নয় শতাংশ। ৩০টি খাদ্যপণ্যের মূল্য পর্যালোচনায় দেখানো হয়েছে, গত এক বছরে দাম বেড়েছে ২০টির। আর এক মাসে দাম বেড়েছে ২৫টির। এই রূপ লুকোবে কোথায় সরকার?]
২. চালের দাম কেজি প্রতি ১০ টাকায় নামিয়ে আনা।
[এখনও চালের দাম মোটা ৩৫-৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। দুই বছর অতিবাহিত করছে সরকার। জানি না, তাদের আলাদীনের চেরাগটি কখন হাতে নেবেন, ঘষা দেবেন আর আমাদেরকে ১০ টাকায় চাল খাওয়াবেন।]
৩. বিদ্যুৎ সঙ্কটের সমাধান।
[সরকারের আজ দুই বছরের পার হওয়া সময়ের মধ্যেও দেশের বিদ্যুতের চাহিদার সাথে উৎপাদনের পার্থক্যই থেকে গেছে ১৫০০-২০০০ মেগাওয়াট। আবার এখানে দুর্নীতি ও সিস্টেম লসের পরিমাণই ২২ শতাংশ। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী এনামুল হক এই নিরেট সত্যটিই স্বীকার করে নিয়েছেন তার জবানীতে- ‘দেশে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির ঘাটতি চরমভাবে বিরাজ করিতেছে...।' আর জনগণ বলছে, এখন নাকি বিদ্যুৎ যায় না, মাঝে মাঝেই আসে। বিদ্যুতে আর কতদিন তা' দিতে হবে- যেখান থেকে মেগাওয়াট মেগাওয়াট বাচ্চা বের করে আনতে পারবেন আমাদের সরকার।]
৪. প্রশাসনকে দলীয় প্রভাবমুক্ত করা।
[অন্ধকার প্রশাসনের এমনই এক নীতি আজ আমাদের দেখতে হচ্ছে, বিরোধীদলের যতজন প্রশাসনে থাকছে তাদের প্রত্যেকের পিঠে পড়ে যাচ্ছে কিংবা গেছে অমোচনীয় কালির সীল-ছাপ্পড়। বর্তমান সরকার অতীতের সব ওএসডি রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। প্রশাসনকে দলীয়করণ করতে দু'বছরের মাথায় তারা ওএসডি করেছে ৪৪৬ জনকে। এত বেশিসংখ্যক ওএসডি আর কোন সরকারের আমলে ইতোপূর্বে দেখা যায়নি। এমনকি এক সঙ্গে একাধিক সচিবকে ওএসডি করে রাখার উদাহরণ এটাই প্রথম। বিরোধীদলের সঙ্গে থাকা চিহ্নিত ও প্রতীয়মান এমন সব কর্মকর্তা-কর্মচারী ও আমলাদের সরকার দিনের পর দিন ‘বিশ্রামে বিশ্রামে বিধ্বস্ত' করে দিচ্ছে এখানেই শেষ নয়, তারা ক্ষমতায় আসার পর বিচার বিভাগে বিভিন্নভাবে বিভিন্ন ধরনের নিয়োগের ক্ষেত্রে দলীয়করণের নজিরবিহীন স্বাক্ষর রেখে চলেছে অত্যন্ত বীরদর্পে। এর পরিচ্ছন্ন উদাহরণ- ঢাকা জেলা দায়রা জজ নিয়োগ। এখানেও অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করে ২০৫ জেলা জজকে ডিঙ্গিয়ে একজনকে ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ হিসেবে নিয়োগ প্রস্তাব দেয় আমাদেরই আইন মন্ত্রণালয়।
অপরদিকে জনগণের সেবক, সেবাই যাদের আদর্শ সেই পুলিশ বাহিনীতেও সরকার চরম দলীয়করণ ও বাণিজ্যিকীকরণ করে। বছরের শুরুতেই পুলিশের এসআই এবং এএসআই নিয়োগ দেন কট্টর দলীয় পরিচয়ের সিলমোহর অঙ্কিতদেরকে। কনস্টেবলদেরকে তো তাদের ঘরানার না হলে ঘরই করতে দিবে না- এমন অবস্থা। ইশতিহারে এক কাজে আরেক এমন দু'মুখো সরকার আর কতদিন জনগণের সাথে জায়গায় জায়গায় ডিগবাজি খেলবে?
এবার মিলিয়ে নেয়া যাক- তাদের দলীয় স্বার্থ সংশ্লিষ্ট অঙ্গীকারগুলো।
১. মুজিব হত্যার বিচার।এরই মধ্যে মুজিব হত্যার বিচার হয়ে গেল। ফাঁসিও হল অভিযুক্তদের।প্রধানমন্ত্রী তার বাবার হত্যাকারীদের বিচার করলেন- ফাঁসি দিলেন। কিন্তু শেখ মুজিবের শাসনামলে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসীদের দিয়ে ৬৪ হাজার দেশপ্রেমিক মানুষের খুনের বিচার তাদের সন্তানেরা কি পেতে পারে না? ওরাওতো কারো না কারো বাবা ছিলেন।
২. যুদ্ধাপরাধীদের বিচার।সরকার আজ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে খুবই ব্যতিব্যস্ত। যুদ্ধাপরাধী কারা এ প্রশ্নটি আজ তারা নির্দিষ্ট করে দিয়েছে।সরকার যদি সত্যিই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাইতো তাহলে তাদের বিতর্কিত আইন প্রতিমন্ত্রী ও সংসদ উপনেতা সাজেদা চৌধুরী নিজ নিজ অবস্থান থেকে এতক্ষণে বলতেন-এখন আমার কি হবে? আমার দেশ ও সাপ্তাহিক এখন পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্যের বরাতে- ১৯৭১ সালের ৭ আগস্ট ইসলামাবাদে এক সাংবাদিক সম্মেলনে পূর্ব পাকিস্তান থেকে নির্বাচিত ৮৮ জন আ'লীগ নেতাকে এমএনএ নিশ্চিত করা হয়, যারা পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর আস্থা অর্জন করেছিলেন। এই ৮৮ জনের তালিকায় আজকের সংসদ উপনেতা মিসেস সাজেদা চৌধুরীর নাম রয়েছে ৮৪ নম্বরে। আর আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসই স্বাধীনতা বিরোধী কাজে বড় ভাইকে (নেজামে ইসলাম পার্টির তৎকালীন প্রচার সম্পাদক) সার্বিক সহযোগিতা করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় ঢাকায় তার রাজাকার ভাইয়ের মালিকানাধীন প্রিন্টিং প্রেসে তিনি ম্যানেজার হিসেবেও চাকরি করেন বলে কথিত আছে। অবশ্য তিনি এসব কীর্তির কথা অস্বীকারই করছেন। তিনি আজকাল মিডিয়াতে প্রায়ই ‘আবহমানকাল' শব্দদ্বয় উচ্চারণ করে থাকেন। তার এই আবহমানকালের সূত্র ধরে বলছি, তিনি আর কত আবহমানকাল ধরে ‘সহযোগী রাজাকার' তকমা নিয়ে থাকবেন? এখন আ'লীগ করছেন না! সব ধুয়ে মুছে একদম সাফ হয়ে গেছে।
আমাদের আ'ম জনতার বুদ্ধিতে জিলাপির আড়াই প্যাঁচ হয়তো আসে না, তবে একেবারে সরল চিন্তা আমাদের চিন্তার রাজ্যে উঁকিও দেয় না এমনটিও নয়।
ইতোমধ্যে আমাদের প্রধানমন্ত্রী রাজাকার ও যুদ্ধাপরাধীদের অদ্ভুত এক সংজ্ঞা দিয়েছেন। ফরিদপুরের একটি সভায় তিনি বলেছিলেন, ‘তার বেয়াই (প্রধানমন্ত্রীর মেয়ে পুতুলের শ্বশুর শ্রম ও জনশক্তি প্রতিমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশারফ হোসেন) রাজাকার ছিলেন, যুদ্ধাপরাধী ছিলেন না।' আজকে তারা ক্ষমতার মসনদে রাজার হালতেই আছেন। প্রধানমন্ত্রীর বেয়াই তো সেই রাজারই মন্ত্রী। সুতরাং রাজার ন্যায় যার আকার তিনিই তো রাজাকার হবেন। যুদ্ধাপরাধী হতে যাবেন কোন দুঃখে। এসব থেকেই কি বুঝা যায় না-আসলে তিনি/তারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চান নাকি খেল-তামাশার পসরা সাজিয়ে ব্যবসা করতে চান? প্রধানমন্ত্রীর রাজাকারের সংজ্ঞা এমনটি হলেও .... শা কবির বলেছেন ভিন্ন কথা। ... অভিযোগ প্রমাণিত না হলে তো রাজাকার খেতাব থেকে তাদের মুক্তি মিলবে। আবার (বিতর্কিত) সাজেদা চৌধুরীর মতে, যুদ্ধাপরাধী রাজাকারদের বিচারের ব্যাপারে যারা ভিন্নমত পোষণ করবে তাদেরকেও খপ করে ধরে ফেলতে হবে এবং বলতে হবে তুইও রাজাকার।আদর্শিক দিক দিয়ে বাঁধতে না পেরে রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা করে রাখার সবচেয়ে মোক্ষম ও শক্তিশালী অস্ত্র (অপবাদ) হিসেবে ‘রাজাকার' শব্দটি ব্যবহার করে আসছে দীর্ঘদিন থেকে আ'লীগ। এখনতো আবার তাদের ঘরেও রাজাকার বাস করে, পাল্টে যায় রাজাকারের সংজ্ঞাও। মনে হয় না, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের নামে প্রহসন করে তাদের সর্বশেষ অস্ত্রটি (অপবাদ) ব্যবহার করে ফেলবেন এত সহজেই। তবে দেখার বিষয়-জনগণ আর কত বোকা বনবেন, বোকা বানাবেন কিংবা শূন্য হাঁড়িতে আর কতকাল এভাবে উনুন জ্বালাবেন?
৩. বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে যাওয়া।
এর বাইরে তাদের মনের ভিতর কি এক জঘন্য অঙ্গীকারই না তারা করে রেখেছিলেন- বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে এক কাপড়ে বাড়ি থেকে উচ্ছেদ এবং স্বাধীনতার ঘোষক শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে অবৈধ শাসক বলে রায় দেয়া একইসাথে অবৈধ শাসকের নামে দেশে কোন স্থাপনার নাম থাকতে পারে না বলে দিন বদলের নামে নাম বদলের নোংরা সংস্কৃতি চালু করা।
কাজী সাইফুল হক