তারিখঃ ১৮ই ফেব্রুয়ারী, ২০১৬ সময় বিকেল ৫টা
ইঞ্জিনরুম থেকে সব ইঞ্জিনিয়াররা একে একে উপরে উঠে আসছে। সবার সাথে চীফ ইঞ্জিনিয়ার ফেরদৌসও উঠে আসে। উপরে এসে সাগরের দিকে তাকিয়েই কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে যায়। জাহাজের এক পাশের রেলিং এর সামনে দাঁড়িয়ে হারিয়ে যায় কোথায় যেন। চোখের সামনে ভেসে ওঠে প্রায় দুই বছর আগের কিছু স্মৃতি।
২০১৩ সালের ঠিক এই দিনেই সে তার স্ত্রী আর দুই সন্তানকে নিয়ে বাসা থেকে বেরিয়েছিল কোন নির্দিষ্ট গন্তব্যে নয়। ইচ্ছা মতন যেদিকে দু চোখ যায়। কিছুক্ষণ সময় দেয়া। দুদিনের মাঝেই আবার তাকে চলে যেতে হবে সাগরে। সাগরের ডাক শুনতে পাচ্ছে। শেষ সময়টা যাতে আনন্দে কাতে সেই উদ্দেশ্যে। সবাই মিলে ঘোরাফেরা খাওয়া দাওয়া শেষে মাঝরাতে বাড়ি ফেরে। ফেশ হয়ে সবাই ঘুমোতে যায়। ফেরদৌসের চোখে ঘুম আসে না তখনো। আসলে সবসময়েই এই একই রকমের অনুভূতি হয়। সাগরে চলে যাবার আগে বেশ কয়েকদিন সবাইকে নিয়ে চিন্তিত থাকে। পরের চার মাস সবাই ঠিক ঠাক মতন থাকতে পারবে কিনা। তার স্ত্রী ঠিক মতন পিচ্চি দুটোকে সামলাতে পারবে কিনা এমন নানান চিন্তা। এই বিষয়টা স্বাভাবিক ভাবেই ঘটে। প্রায় ভোর রাতে ঘুম আসে।
সকাল সকাল উঠে সব গোছগাছ করতে করতেই দিন শেষ। আগামী চার মাসের জন্যে বাসায় শেষ রাত। এইবার শুধু তার চোখেই যে ঘুম নেই তা নয়। ঘুম নেই তার স্ত্রী মায়ার চোখেও। দুজনে কুটকুট করে কিছু গল্প করে তারপর এক জন আরেকজনের দিকে শুধুই তাকিয়ে থাকে নিস্তব্ধ নীরব রাতে শুধুই নিঃশ্বাসের শব্দ ছাড়া আর কিছুই শোনা যায় না।
নীরবতা ভাঙ্গে মায়া। বলে, “তুমি এমন করে না গেলে হয় না? আর কতদিন এভাবে চলবে?”
মুচকি হেসে ওঠে ফেরদৌস। কিছুই বলে না। সাধারণত এইসকল ব্যাপারে চুপ চাপ থাকাই ভাল। যার কোন উত্তর নেই সেই ধরণের প্রশ্ন গুলো চুপচাপ পাশ কাটিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কি ই বা করার আছে। আবারও দুজন নীরব। একে অপরের দিকে তাকিয়ে তাকিয়েই রাত পার করে দেয়। সকালে ফ্লাইট থাকায় সকাল সকাল এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পরে। এইবার তার জাহাজের পথ আগেরবারের চেয়ে বেশ খানিকটা ভিন্ন। আগের বার পুরো ইয়োরোপ জুরে থাকায় প্রতিদিনই কোননা কোন পোর্ট থাকতো। তাই সবসময়েই বাসায় যোগাযোগ করা হত। এমনকি প্রতিদিনই প্রায়। কিন্তু এবার বোধহয় সেই সুযোগ হবে না। ইমিগ্রেশনের কাছে এসে সবার থেকে বিদায় নিয়ে স্ত্রীর দিকে একবার তাকিয়ে মুচকি হেসেই উলটো ঘুরে হাটতে থাকে। দুঃখী মানুষের চোখের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না। নিজেই বিষাদগ্রস্থ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। সামনে এগিয়ে যায় পেছনে রয়ে যায় তার সকল ভালবাসা আর স্নেহ।
লং বিচ, ইউএসের লসএঞ্জেলেসের পোর্ট। পৌছেই বাসায় সবাইকে জানিয়ে দিল ফেরদৌস ঠিক ঠাক মতন পৌছেছে। এখ শুধুই জাহাজ পোর্ট ছাড়ার অপেক্ষা। এখান থেকে জাপান যাওয়ার কথা। প্রায় ১৫ দিন কারো সাথে কোন যোগাযোগের সুযোগ নেই। যেটুকু আছে তাও না থাকার মতই। মন্দের মাঝে ভাল জাহাজে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ইন্টারনেট এর সংযোগ আছে। তাতেই কোনমতে যোগাযোগ করা যায়।
দেখতে দেখতে ৩ মাস কেটে গেল জাহাজে। শেষ মাসে সব গোছ গাছের চিন্তায় ফেরদৌস নিজের কেবিন আস্তে আস্তে সাজাতে থাকে। সাধারণত এই কাজটা নিজেই করে। নিজের জিনিষ পত্রের অন্য কেউ হাত দেবে এইটা সহ্য হয়না তার। আজ রবিবার তাই হাতে কিছুটা সময় আছে। হাতের কাজ গুলো শেষ করে একটু ঢু মারতেই ফেসবুক খোলে। মেসেজ ২ টা চোখে পরে। মেসেজ খুলেই যেন তার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পরে। তার স্ত্রীর ছোট ভাইয়ের মেসেজ। স্ত্রী মায়া হাসপাতালে। হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পরায় তাকে হাসপাতালে নেয়া হয়েছে। রক্তের শ্বেত রক্ত কণিকার অভাব। কি করবে কিছুই বুঝে উঠতে পারে না ফেরদৌস। এখন সে চাইলেও ফিরে যাওয়া প্রায় অসম্ভব তার পক্ষে। মাঝ প্রশান্ত মহাসাগর পাড়ি দিচ্ছে। এখনো প্রায় ৭-৮ দিন বাকী পরের ডাঙ্গার দেখা পেতে। ফেসবুকেই রক্তের জন্যে পোস্ট করে। সারাও পায়। যারা যে ভাবে সম্ভব এগিয়ে আসে। কিছুটা হলেও নিশ্চন্ত হয়।
দ্রুত ক্যাপ্টেনের সাথে দেখা করে ফেরদৌস। পরের পোর্ট থেকেই তার সাইন অফ এর জন্যে মেসেজ পাঠায়। স্ত্রীর অসুস্থতার কথা শুনে সবাই বেশ সান্তনা আর সাহস দেবার চেষ্টা করছে। কিন্তু অবুঝ মনরে বোঝায় কে? যাওয়ার জন্যে গোছগাছটা কাজেই লেগে গেল শেষমেশ।
পরের দুইদিন ইঞ্জিনের কি একটা সমস্যা হওয়ায় খুব ব্যাস্ত থাকতে হল তাকে, সাথে জাহাজের স্যাটেলাইটেরও কি এক সমস্যা তার কারণে ঠিক করে খোজ করতেও পারলো না। কিন্তু কাজের মাঝেও মনের মাঝে এক ভয় ঘুরঘুর করছে। কে কি করছে এখন?? ছোট বাচ্চা দুটোরই বা দেখাশোনা কে করছে? তারপরেও কাজ ফেলে বসে থাকা সম্ভব নয়। তৃতীয় দিন হাতে কিছুটা সময় পেয়ে স্যাটেলাইট ফোন দিয়ে ফোন দিল বাসায়। তার ফোন রিসিভ করেই কান্নায় ভেঙ্গে পরে তার স্ত্রীর ছোট ভাই। আজ সকালেই তার স্ত্রীর অবস্থা খুব খারাপ হয়ে যায়। ডাক্তারের পরামর্শে ইনিটেনসিভ কেয়ারে নেয়া হয়। কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ। তার মুখ দিয়ে আর কিছুই বের হয় না। ওভাবেই ফোনটা রেখে দেয়। মনেহচ্ছে ঠিক মতন দাড়াতেও পারছে না সে।
পরের পোর্টেই সে বাড়ি ফিরে যায়। শেষবারের মতন স্ত্রীর মুখটা দেখার জন্যেই তাকে শীতল করে রাখা হয়েছিল। শীতলতা তাকেও স্পর্শ করে যেন।
হঠাত করে ব্রীজ থেকে ক্যাপ্টেনের ডাকে সম্বিৎ ফিরে পায় ফেরদৌস। “Chief Already Dinner Time, Let’s Hav together” বর্তমানে ফিরে আসে সে। উত্তর দেয় “Yeh, Comming...”
উৎসর্গঃ মেরিণ একাডেমীর ৩২ ব্যাচের ফেরদৌস জামান স্যার আর ভাবী
(যাদের কাউকেই আমি কোনদিন দেখিনি, পরিচয়ও নেই। যখন ভাবী অসুস্থ ছিলেন তখন দুইবার স্যারকে ফেসবুকে নক করেছিলাম ঠিকানার জন্যে। তার প্রায় ৩ সপ্তাহ পরে আমার নতুন ক্যাপ্টেনের কাছে জানতে পাই ভাবীর সেই অসুস্থতার হাত থেকে আর রেহাই হয় নি। গল্প লেখার সৌভাগ্য আমার নাই। মাঝে মাঝে রংচঙ লাগিয়ে উপস্থাপন করি কিছু ঘটনা। এইখানে যাদের কথা বলেছি এবং তুলে ধরেছি পুরোটাই আমার মন গড়া। শুধু সম্পর্ক আর মানুষগুলো সত্যি। কাউকে কষ্ট দেবার উদ্দেশ্যে লেখা হয় নি।)
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ রাত ৮:৫৪