সিনেমা দেখলাম। সিনেমার গুণ বিচারে পরে যাই। কারণ সিনেমার হিসেবে বলার কিছুই নাই। যথেষ্ট এনজয়েবল সিনেমা।
“জাহাজী”মানব জাতির একটা প্রজাতি। এদের মন থাকে না। এদের যা থাকে তা হলো দেহ, যাদের সম্পর্কে কাউকে কিছু জিজ্ঞাসা করলেই সবার আগে 3W ফরমুলার কথা যে কারো মাথায় চইলা আসবে। ক্যান জানিনা। ১) ওয়েলথ, ২) উইমেন, ৩)ওয়াইন/হুইস্কি (যার যেইটা কইতে ইচ্ছা হয়)। সাধারণ মানুষের দৃষ্টিসীমার বাইরে আমরা চিন্তা করতে পারি না। চিন্তা করলেই সেইখানে নেগেটিভিটিই বেশি। এই কারণে হইতে পারে। তবে সকল ক্ষেত্রেই মানুষ ভুল টা বলব না। কারণ ইয়োরোপিয়ানদের ব্যাপারে তো বলার কিছুই নাই। এদের লাইফস্টাইল সবারই জানা। কর্মসূত্রে এদের সাথে বেশ ভাল ভাবেই মেশার সুযোগ হয়।
এর বাইরে আরো অনেক কিছুই আছে যা কিনা মানুষের মাথায় আসেই না। মাথায় আসে না এরা দিনের পর দিন সাগরের পানি দেখতে দেখতে বিরক্ত। তারপরেও সাগরের মায়া ত্যাগ করতে পারে না। মাথায় আসে না এদের অনেকেই হয়তো চায়ই না এই ধরণের জীবন। কিন্তু তারপরেও জীবিকার তাগিতেই চলে যাচ্ছে যে ভাবে জীবন চলে। জাহাজীদের আসলেই একটা ভালবাসাহীন নির্মম জীবনে প্রবেশ করা, উদ্দেশ্যের বলয়ে প্রবেশ করা, একটা নির্দিষ্ট সময় পর হাঁপিয়ে ওঠা। কিন্তু থেমে থাকা নামক কোন শব্দ এদের অভিধানে নেই। থেমে থাকে তখনই যখন ডাঙ্গায় উঠে আসে।
সিনামার কথাতেই ফিরে আসি। সিনেমা বানানো হয় মানুষের মনে কোন কিছু গেথে দেওয়ার জন্যে। যেমন করে “ডেভিলস্ ডাবল” বানানো হয়েছিল। “ক্যাপ্টেন ফিলিপ” ও তার ধারাবাহিকতা রক্ষা করলো। আমেরিকা এক আজব জায়গা। আসলে আমেরিকা একটা গালির নাম। যারা যেইভাবে চায় সেইভাবেই দেখায়। আমরা দেখি। কিছুই করার নাই। একটা জাহাজ জলদস্যু দিয়ে আক্রান্ত হলে সাথে সাথে যেইভাবে আপনারা দেখবেন আমেরিকান নেভি দৌড়াইয়া আসছে ব্যাপারটা আসলে ওইরকম না। এইটা আমেরিকান ফ্ল্যাগ ভেসেল ছিল। এই কারণে এই অবস্থা। অন্য দেশী পতাকাবাহী জাহাজ হইলে “নোবডি গিভ এ শিট অন দ্যাট”। আমার এক খুব কাছের বন্ধুই প্রায় ৩ মাসেরও বেশি সোমালিয়াতেই আটকিয়ে ছিল। তখন মানুষের আসল রূপ দেখা গেছে। দরকারের সময়ে কাউরে খুইজা পাওয়া যায় না। এইটাই দুনিয়ার রীতি। জাহাজের মালিক ট্যাকা দিবে না। কোন মানুষ (আত্মীয়-স্বজন ব্যাতীত) এই ব্যাপার নিয়া মাথা ঘামাবে না। ইভেন তখন একটা মানব বন্ধনের ব্যাপার রেডী ছিল। যেখানে মাত্র ৩ জন মানুষ ৩ টা প্ল্যাকার্ড নিয়া মানব বন্ধন করছিল। এই ব্যাপারে আমার একটা মহান ডায়লগের কথা মনে পরে। আমাদের এডজুডেন্ট একদিন সবাইকে ডাইকা উপদেশ দিচ্ছিল। মাঝে হঠাত অমর এক উক্তি করে বসে “সেইভ ইয়োর ওউন এস(SAVE YOUR OWN ASS)”।
যেইদিন ওদের জাহাজ ধরা পরে, আমি নিজেও “গাল্ফ অফ এডেন” এই ছিলাম। ঠিক কেন যেন আমি বাসায় ফোন দিয়া আম্মুরে বলছিলাম, “আমার কেন যেন ভাল লাগতেছে না। ধরা পরলে আর আমি ফিরা না আসলে কিছু মনে কইরো না।” ব্যাপারটা ঘটছে শেষ পর্যন্ত। আমার সাথে না, আমারই এক খুব কাছের মানুষের সাথেই। আমার এই ধরণের ফিলিং হইলেই সাধারণত আমার বন্ধুরা এর শিকার হয় (এইটা পরীক্ষিত, আমি ওইদিনের পরে অপরাধবোধে ভুগতাম। এইকথা কখনোই কইনাই ওই বন্ধুটারে। হয়তো বলবও না কোনদিন)। তারপরে কি আর প্রতিদিনই চিন্তা করতাম দেশের কি অবস্থা? মানুষ নিশ্চয়ই কিছু না কিছু করবে। সবচেয়ে অবাক হওয়ার বিষয় হলো সব স্বাভাবিক ভাবেই চলতেছিল। কারোই এসব নিয়ে কোন মাথা ব্যাথা থাকে না। ২০-২৫ জন মানুষ হারিয়ে গেলে কারো কিছুই যায় আসে না। তাদের কপাল ভাল ছিল। আমাদের দেশী জাহাজ আর দেশী পতাকাবাহী বলেই ফিরা আসতে পেরেছিল সৃষ্টিকর্তার কৃপায়। তাই এই বিষয়টা বেশ সেনসিটিভ আমর কাছে।
এইক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি যেটা হয় টা হল মেন্টাল ব্রেকডাউন। মানুষের মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটে হরদম। এই রকম অনেক ঘটনা আছে। শাহরিয়ার রাব্বি নামক বন্ধুটার মানসিক শক্তি বোধকরি বেশিই ছিল। সে এখনো তার ৪র্থ তম সমুদ্র যাত্রার জন্যে প্রস্তুতি নিচ্ছে। তবে এইধরণের উদাহরণই বেশি যেখানে জাহাজের মালিকেরা ধরা পরা জাহাজের উদ্ধারের জন্যে টাকা দিতে নারাজ এবং সব শেষে কি হয় সবারই জানা। আমি এইবার আসার আগে পর্যন্ত ২ জন বাংলাদেশী সোমালিয়ায় আটকা আছে শুনে আসছি। ছাড়া পায়না প্রায় ২ বছর যাবত।এইখানে যে শুধুই টাকার খেলা তাই না। এই টাকা আদান প্রদানের ক্ষেত্রেও বেশ কিছু ফর্মালিটি আছে। এক নির্দিষ্ট এজেন্টের মাধ্যমে টাকার আদান প্রদান ঘটে। এই এজেন্টদের মাঝেও ভুয়া এজেন্ট আছে। একবার এদের হাতে গেলে ওই টাকা নিয়ে এরা পগার পার। তাই সঠিক এজেন্ট খুজে টাকা হস্তান্তর না করতে পারলেও ওই জাহাজের বাসিন্দাদের জীবনের হুমকি এতটুকুও কমেনা।
সকল কিছুর পিছেই লুকিয়ে থাকা মানুষ গুলা আড়ালেই থেকে যায়। এরা বাইরে আসে না সাধারণত। জাহাজীদের বেশিরভাগই বিশ্বাস করে এখনো এইটা আমেরিকার এক বিশাল রাজনীতি। এক একটা জাহাজের থেকে কয়েক মিলিওন ডলার করে এদের ইনকাম। কিন্তু জলদস্যুরা এর সিকিভাগও পায় না। সব চলে যায় উপরওয়ালাদের কাছেই। কিন্তু খুব বেশি মানুষ এইখান থেকে পাইরেসি নির্মূলে কাজ করে না। তাদের মূল কাজ কিবভাবে পাইরেসি থেকে জাহাজ বাচানো যায়। সে ক্ষেত্রে আর্ম গার্ড দেয় সাথে। যাতে প্রায় প্রতি আর্ম গার্ডের পিছনে একটা বড় অংকের ব্যয় হয়। আর্ম গার্ড থাকলে জলদস্যু সেই জাহাজের দিকে আগায় না। যদিও ভুলে আগায়, পরে সেইটার পিছু আর নেয় না।
যত কিছুই করুক এদের নির্মূল করবে না। এটা আয় করার এক উৎস। কিন্তু সিনেমার কোন অংশেই এইধরণের কিছুই দেখায় নাই। সত্যি ঘটনা অবলম্বনে তৈরী। কারণ এইটা আমেরিকার দায়িত্ব ছিল, সেইটা মানুষকে দেখাতে পেরেছে সুন্দর করেই। কিন্তু তারা দেখায় নি যে অংশটা টা হল কিভাবে মানুষ দিনের পর দিন মাসের পর মাস না খেয়ে বেচে থাকে। খুব ভাল ভাগ্য হলেই কিছু খেতে মিলে। খাবার পানি মেলে কিছুটা। সবাইকে এক জায়গায় বন্দী করে রাখাহয়। নিজের অতিপরিচিত জাহাজেও নিজের ইচ্ছায় চলাফেরা করা সম্ভব না।
আরেকটা দিকও কেউ বুঝতেই পারবে না। সেটা হল এই জলদস্যুরা কিভাবে জলদস্যুতে পরিণত হয়। কে এদের জলদস্যু বানায়। কাদের জন্যে তারা কাজ করে। তাদের উপরওয়ালারা কারা? এত এত টাকা কাদের কাছে যায়, কিভাবে যায়?
অনেক ভ্যাজর ভ্যাজর করলাম। আসলে এইসবই নির্মম সত্য। সত্য সবাই সহ্য করতে পারে না, তাই মিথ্যার মাঝে আশ্রয় খোজে। মিথ্যা দিয়ে সত্যকে ঢেকে রাখতে চায়। অথবা নির্মমতাকে পাশ কাটিয়ে যায়। নির্মমতা সহ্য করতে হয় আমাদেরই।
সিনেমার দিক দিয়ে দেখলে ১০ এ ৯ এর কম দেয়া যাবে না। অসাধারণ অভিনয়ে টম হ্যাংক্স আবারো সবার দৃষ্টি নন্দিত করবে। পুরোটুকুই ছিল “ওয়ান ম্যান শো”। ক্যাপ্টেন সাধারণত এইরকমই হয়। সব দিকে সতর্ক নজর থাকে। মাথায় চুলচেরা বিশ্লেষণ ক্ষমতা থাকে। সকলের প্রতি সন্তানের মতন খেয়াল করে। নিজের কষ্টের মূল্যে হলেও অন্যদের রক্ষা করার চেষ্টা করে (ব্যাতীক্রমতাও কম নয়)। আর বাকী সব আপনাদের বলে দিলে সিনেমার আকর্ষণ খুজে পাবেন না।
সিনেমাটোগ্রাফি সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করেছে আমাকে। আর সাথে পরিচালকের পরিচালনা বেশ সবটুকু সময়েই আপনাকে সাসপেন্সে রাখবে।
দেখে ফেলুন প্রতিটা মিনিট, প্রতিটা সেকেন্ড উত্তেজনায় থাকবেন আমার মতন।
Captain Phillip (2013)
Director: Paul Greengrass
Writers: Billy Ray (screenplay), Richard Phillips (based upon the book "A Captain's Duty: Somali Pirates, Navy SEALS, and Dangerous Days at Sea" by)
Stars: Tom Hanks, Barkhad Abdi, Barkhad Abdirahman
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই জানুয়ারি, ২০১৪ ভোর ৬:১৫