গুরুমুখি বিদ্যা “বাউল”। বাউল শুধু বিশেষ্য নয়, একটি বিশেষণের নাম। ফকিরি ভাষায় সাধারণ মানুষ হলো আউ। আউলরা গুরুদীক্ষা পেয়ে বাউল হয়। বাউলের কোনো গ্রন্থ নেই, বাউল সর্বকেশী; তারা সন্ধানে চলেন—হাওয়ার সন্ধান। বাও হলো বাতাস আর উল মানে সন্ধান।
বাউলরা বাতাসেরই সন্ধান করেন। কারণ বাতাসের মধ্যে অনেক মহৎ আবিষ্কার যেমন আছে তেমন মহৎ আত্মাগুলো বাতাসেই বিদ্যমান। যারা কল্যাণ চিন্তা করেছেন তারা সবাই বাতাসের মধ্যেই বিরাজিত আছেন।
সাধনার চার স্তর-স্থূল, প্রবর্ত, সাধক ও সিদ্ধি। চাল-পানি দিয়ে পাঠ শুরু আর খেলাফতে শেষ। খেলাফত গ্রহণকে সাধুরা ভেক নেয়া বলেন। চাল-পানি নিয়ে শিষ্য গুরুকার্যে মনোযোগী হন এবং গুরুর বাতলে দেয়া পথে পরম ভক্তি সহকারে চলতে শুরু করেন।
এইরকম এক-দুই কথায় বাউলকে সংজ্ঞায়িত করা কষ্টকরই বটে।
বাউলদের মূল তত্ত্ব হল মানব ভজন। “মানুষের মাঝেই স্বর্গ নরক, মানুষেতেই সুরাসুর” জাত, ধর্ম, বর্ণ নির্বিষেশে সকল মানুষের প্রতি ভালবাসা।
মানব জনম খুবই অল্প সময়ের। এরই মাঝে ত্বরায় গুরুর দর্শনে নিজেকে সমর্পন করাই বাউলের প্রধান বৈশিষ্ট্য।
সাধু জনমটা শিষ্যের কাছে সৌভাগ্যের ব্যাপার। পূর্ব সুকৃতির পাওনা না থাকলে সাধু হওয়া যায় না। সাধু হওয়া তাই এক জনমের কাজ নয়-
“থাকিলে পূর্ব সুকৃতি দেখিতে শুনিতে হয় গুরুপদে মতি”
যারা বস্তুরক্ষায় মনোযোগী এবং ইন্দ্রিয় নিয়ন্ত্রণে সমর্থ হন কেবল তারাই এগিয়ে যান। এরপর সিদ্ধের চার উপস্তরে রসরতির যোগে চলে প্রেমসাধনা। খেলাফত বা ভেক গ্রহণ এসব সাধনপথ্যাদির উচ্চপর্যায়ের দীক্ষানুষ্ঠান। এ পর্যায়ে গুরু শিষ্যকে বীজমন্ত্র দেন এবং সাধুবৃত্তির রীতিনীতি ও শারীরবৃত্তীয় নানা কৌশলাদি সম্পর্কে প্র্যাকটিক্যাল জ্ঞান দান করেন—যা তারা কখনোই প্রকাশ করেন না। দীক্ষাশিক্ষার সেকশনে এসব মন্ত্রাদি শিষ্যের কাছে সারাজীবনের জন্য অমূল্যবাণী হয়ে থাকে।
সাধক হতে গেলে চাতকস্বভাব থাকতে হবে। কবে অমৃত পাওয়া যাবে, সেই আশায় বসে থাকতে হবে। আর গুরুর কাছেই জানা যায় চাতকস্বভাব।এই স্বভাবের কথাও বার বার লালনের গানে উঠে এসেছে
“চাতক বাচে কেমনে মেঘের বরিষণ বিনে”
অর্থাৎ গুরুর দয়া বিনে চাতকের জীবন বৃথা।
চাল-পানি নেয়ার কত বছর পর ভেক নিতে হবে, তা গুরুই ঠিক করে দেন সাধারণত। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই সময়কাল ১২ বছরের কম নয়। চাল-পানি নেয়ার পর গুরু শিষ্যকে ৫ কলেমা ও ওজিফা দেন। ওজিফা মানে-
বিসমিল্লাহ
মুর্শিদ আল্লাহ
লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ
অন্যদিকে হিন্দুশিষ্যের ক্ষেত্রে গুরু কলেমার পরিবর্তে ৩২ অক্ষরের কৃষ্ণমন্ত্র দেন।
হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ, কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে।
হরে রাম হরে রাম, রাম রাম হরে হরে।।
চাল-পানি কেন নিতে হয় জানা যায়নি, তবে তারা মানেন গুরুর নির্দেশ-গুরু জানে।
দেহের মধ্যে দেল কোরআন আছে -
“চক্ষু আঁধার দেলের ধোঁকায় কেশের আড়ে পাহাড় লুকায়
কি রঙ্গ সাঁই দেখছে সদাই বসে নিগম ঠাঁই”
নফি এজবাদের মাধ্যমে দেলকে তাজা করতে হয়। নফি এজবাদ যে জানে না, তার পড়াশোনা মিছে। এ হলো নামের সঙ্গে জিকির। লা ইলাহার কোথায় উত্পত্তি, ইল্লাল্লার কোথায় বসতি; লা ইলাহার কী আকৃতি, ইল্লাল্লাহর কী আকার ধরে—ইত্যাদি জানতে হবে। নামের সঙ্গে রূপ ধ্যানে রেখে নিশানা করে নফি এজবাদ করতে হবে। কাপড় ময়লা হলে যেমন সাবান দিতে হয়, দেহ পরিষ্কারের সাবান হলো জিকির। কাল্ব পরিষ্কার থাকলে সিদ্ধি লাভ হবে। তখন আমার সাঁই চাইলে মানুষ কোন্ জন, সে কোন্ জন জানা যাবে। লালন মতে বস্ত্র ধোয়া কিংবা স্নানাদি হলো—অঙ্গে ছাপা জপমালার মতো। তিনি এসব বাহ্যিক পরিষ্কারাদিকে লোকদেখানো ছেলেখেলা বলে মন্তব্য করার পাশাপাশি মনের ময়লা ঘুচিয়ে এবেলা ভবনদী পাড়ের সওদা জোগাড় করতে বলেছেন—
মন পরিষ্কার কর আগে
অন্তর বাহির হবে খোলা
তবে যত্ন হলে রত্ন পাবে
এড়াবে সংসার জ্বালা।।
অপরদিকে, হিন্দু শিষ্যরা নফি এজবাদের মতোই ৪ অক্ষরের জপমালা জপেন।লালন বলেন “১৬ নাম ৩২ অক্ষর-২৮ অক্ষর দাওনা ছেড়ে দাওনা”
সাধনমতে ৪ অক্ষর বলতে রাধাকৃষ্ণ’ কিংবা ‘গুরুশিষ্য’ বোঝানো হলেও হিন্দু সাধুদের কেউ কেউ রহস্যজনক উত্তর দেন। তাদের ভাষায়-অজপা নাম সাধু জপে, জীবে জানে না।
নফি এজবাদ করতে হয় কারণ —এ জিকিরের কার্যকরণ হলো এটা আত্মা শান্ত থাকে অর্থাৎ এ জিকির আত্মার যে নিজস্ব একটা শক্তি আছে সেটাকে শান্ত রাখে। অনেকে বাউলই বিশ্বাস করেন, কুপি জিকির করলে কাল্ব পরিষ্কার হয়। কাল্ব পরিষ্কারের পদ্ধতি নিয়ে লালনের গানের উপমা তানা যায়,
“পাখি কখন যেন উড়ে যায়
বদ হাওয়া লেগেছে খাঁচায়”
খাঁচায় যাতে বদ হাওয়া না লাগে এ জন্য প্রভুর নাম নিয়ে শ্বাস নেন এবং কাল্ব পরিষ্কার রাখার জন্য দমে দমে হরদম আল্লাহ্র নামে জিকির করেন। শিষ্যভেদে কলেমা বা মন্ত্র যাই হোক, গুরু শিষ্যকে মানবধর্মের নানা কর্মকরণ পালন করতে বলেন এবং শিষ্যের কার্যধারা পর্যবেক্ষণ করে সময়ে সময়ে আদেশ উপদেশ দিয়ে থাকেন। ফকিরি ভাষায় এ হলো ‘চক্ষুদান’।
“একটা পাগলামী করে
জাত দেয় সে অজাতেরে দৌড়ে গিয়ে
দেখ হরি বলে পরছে ঢুলে ধুলার মাঝে
হাওয়ার সাধনায় নারীর অবদান অপরিহার্য। সাধিকা ছাড়া সাধকের সাধনা পূর্ণ হয় না-
মূলত সাধুসঙ্গিনী তথা সেবাদাসীকে নিয়েই শুরু হয় যুগলসাধনা। সেবাদাসীরা সাধনার ব্যাপারে সর্বদা চেতন থাকেন বলে তারা চেতনগুরু। লালনের বিভিন্ন গানে বার বার ঘুরে ফিরে এসেছে চেতন গুরুর কথা।
“চেতনগুরুর সঙ্গ লয়ে খবর কর ভাই
কোথা আছে রে সেই দিন দরদী সাঁই”
সাধুরা সন্তান উত্পাদন থেকে বিরত থাকেন। তাদের বিশ্বাস সন্তানের মাধ্যমে বাবার পুনর্জন্ম হয় এবং তার আত্মা পৃথিবীতেই রয়ে যাওয়ায় আত্মার মুক্তি হয় না। তাছাড়া সন্তান উত্পাদনকে তারা বেদনাদায়ক বোঝা হিসেবেও বিবেচিত করেন। জীব হলো টল তাই জীবের এই কারণ হতে বিরত থেকে সুটল থাকতে হয়। টল অটলের নিয়ন্ত্রণই ছিল লালনের সাধনকর্ম। লালন নিজেও নিঃসন্তান ছিলেন। খেলাফত নেয়ার আগে কোনো কারণে সন্তান হলেও খেলাফত গ্রহণের পর তারা কেউ আর সন্তান নেন না। এরকম জন্ম নিয়ন্ত্রণের বৈজ্ঞানিক কারণ হলো—তাদের শারীরবৃত্তীয় আচার পদ্ধতিগতভাবেই ভিন্নতর। দীক্ষাগ্রহণকালে গুরু শিষ্যকে গুরুমন্ত্রের সঙ্গে সঙ্গে কিভাবে রতিযোগসাধন করে রতিকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় বা দেহের ভেতরে পুনঃশোধন করা যায় তা শিখিয়ে দেন। রতিসাধনের এ গুপ্ত কলাকৌশল পরে কেবল গুরুশিষ্য পরম্পরায় প্রবাহিত হতে থাকে। বিশেষ গোপনীয়তা এবং পরম্পরা বিষয়টি থাকার ফলে অনুসারী ছাড়া অন্যরা কেউ এ বিষয়ে পরিষ্কারভাবে জানতে পারেন না।
বাংলাদেশের বাউলদের ভাল করে লক্ষ করলে সহজেই দুইটি ভাগে ভাগ করে ফেলতে পারবেন। একদল ভাটী অঞ্চলের। যারা কিনা শুধুই রোম্যান্টিকতাপূর্ন। যাদের গানের কথায় বারে বারে ঘুরে ফিরে এসেছে সঙ্গিনীর বা প্রেমিকার প্রতি ভালবাসার কথা। (প্রেমিকা শব্দটা বোধকরি সস্তা টাইপের কিছু মনে হচ্ছে। তবে এই মুহুর্তে অন্য সমার্থক শব্দ মাথায় আসছে না)। আরেকটি দল হল শুধুই দেহতত্ত্ব আর মানবধর্মী।
এবার গানের কথায় আসি। বাউল গান গেয়ে অনেক শিল্পী নামী দামী হয়ে উঠছেন। কিন্তু তারা কি সবাই ঠিক কথা সুরে গান গাচ্ছেন?? যারা গান গাচ্ছেন তাদের বেশিরভাগই অর্থ না জেনেই গাইছেন। যেই কারণে বেশিরভাগই গানের কথা ও সুরে পরিবর্তন আসছে। আসলে বাউল জাতি এইসকল বিষয়ে মাথা ঘামায় না। আর তাদের কোন পরিমার্জিত মানুষের সাপোর্টও নেই যে তারা সেইটা নিয়ে কাউকে কিছু বলবে। এই কারণেই যে যার মতন গেয়ে যাচ্ছে। গাওয়ার আগে একটুও অর্থ বোঝার চেষ্টা করা উচিৎ। সুযোগ হলে একটা একটা করে গান নিজেই যতটুকু বুঝি তার বর্ণনা দিতাম। সময়ের বড়ই অভাব। বাউল না বলেই আমরা ভব মায়ায়
মজে আছি আর সময় অতিবাহিত করছি।
অনেক অজানা কথা লিখে ফেললাম যার বেশিরভাগই বিভিন্ন স্থান থেকে যোগার করা। বাউল প্রক্রিয়ার কথা শুধু জানালাম। আমরা বাউলদের গান শুনতে পছন্দ করি, কিন্তু আদতে বাউল পছন্দ করিনা। নোংড়া কাপড় চালচুলো হীন মানুষ, এছাড়াও তাদের বিভিন্ন মিথ্যে অপবাদ দিতেও পিছপা হই না। কিন্তু তাদের কথা বোঝার সামর্থ্য কয়জনের আছে?? কয়জন মানুষ তাদের প্রচারিত কথা গুলো একটু বোঝার চেষ্টা করে? যদি সব মানুষের ১ অংশও বুঝার চেষ্টা করতো তবে হয়তো আমাদের সমাজ ব্যাবস্থা আরো সুন্দর হয়ে উঠতো।
মাঝে মাঝে নিজেকে বাউল কল্পনা করি। বাউল হতে ইচ্ছা হয়। সাহস যোগার করতে পারিনা। মানুষ হিসেবে এখনো ভীতু রয়ে গেলাম। ভবসাগরে ডুবে রইলাম। আশাকরি কোন একদিন সাহস সঞ্চয় মনের মানুষের সন্ধানে বের হব।
এই রকমের আরো কয়টা অখ্যাদ্য আছে। ইচ্ছা হইলে দেখতে পারেন।
অচিন পাখি (The Unknown Bird) – STORY OF OKIR LALON SHAH {আবারো ক্ষুদ্র মস্তিষ্কে বিশ্লেষণের অপচেষ্টা}
লালন (২০০৪) ~বনাম~ মনের মানুষ (২০১০)
~ভাটির পুরুষ {বাউল সম্রাট শাহ্ আব্দুল করিম}~ A documentary By Shakur Mazid
বাউলা গান (শুনলেও পস্তাইবেন, না শুনলেও পস্তইবেন)