ছোট বেলায় শুনতাম, কাউকে খুন করার শাস্তি হচ্ছে দুটি। ফাঁসি ও যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। খুনী তার অপরাধের কথা স্বীকার করলেই নাকি বিজ্ঞ বিচারক সাহেব দয়াপরবশ হয়ে খুনীর যাবজ্জীবন জেলের রায় দিতেন। তখন ভাবতাম, যাবজ্জীবন জেল মানে কি যতদিন বেঁচে থাকে ততদিন! তার চেয়ে তো ফাঁসি দেয়াই ভাল। পরে অবশ্য শুনেছিলাম, যাবজ্জীবন জেল মানে ১৪ বছরের সাজা। মানে কেউ কাউকে খুন করে খুনের কথা আদালতে স্বীকার করে মাফ চাইলেই তার ১৪ বছরের জেল নিশ্চিত।
সময় পাল্টেছে। সেই ছোট আমি এখন অনেক বড় হয়েছি। বদলেছিও অনেক। দেশের আইন-কানুনও বদলেছে। আইনের পরিবর্তন-পরিবর্ধন হয়েছে, হচ্ছে। এখন আপনাকে যাবজ্জীবন জেল খাটতে কাউকে খুন করতে হবে না। একটা স্ট্যাটাসই হবে আপনার যাবজ্জীবন বা ১৪ বছরের জেলের কারণ।
//আপনি যদি কোন দাঙ্গা বা রায়টে যোগ দিয়ে সরাসরি কোন সহিংসতায় অংশগ্রহণ করেন, তাহলে আমাদের পেনালকোডের ১৪৭ ধারা অনুসারে আপনার সর্বোচ্চ শাস্তি হবে ২ বছরের জেল। এই দাঙ্গায় আপনি যদি এমন কোন মরণাস্ত্র নিয়ে বের হন যা দ্বারা কাউকে হত্যা করা সম্ভব, তাহলে পেনালকোডের ১৪৮ ধারা অনুসারে আপনার সর্বোচ্চ শাস্তি হবে ৩ বছরের জেল (সর্বনিম্ন শাস্তি বিজ্ঞ আদালত নির্ধারণ করবেন)।
কিন্তু আপনি যদি (আইসিটি আইন অনুসারে) ‘ওয়েব সাইটে বা অন্য কোন ইলেক্ট্রনিক বিন্যাসে’ এমন কিছু প্রকাশ করেন যা থেকে আইন শৃঙ্খলার অবনতি ঘটার ‘সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়’, তাহলে আইসিটি আইন অনুসারে আপনার শাস্তি হবে সর্বোনিম্ন ৭ বছর থেকে সর্বোচ্চ ১৪ বছরের জেল এবং অনধিক এক কোটি টাকা জরিমানা!
অনলাইনে লেখাকেখি সংক্রান্ত অভিযোগ সমূহকে ‘আমলযোগ্য’ ও ‘অ-জামিনযোগ্য’ করায় এ অপরাধে কাউকে গেফতারের জন্য আদালতের কোন ওয়ারেন্টের প্রয়োজন হবে না। নিরাপরাধ প্রমাণিত হওয়ার আগ পর্যন্ত কোন জামিনও মিলবে না, এবং লেখালেখি সংক্রান্ত অভযোগ যতই ক্ষুদ্র হোক, প্রমাণিত হলে এর সর্বনিম্ন শাস্তি হবে ৭ বছরের জেল এবং অনধিক ১ কোটি টাকা জরিমানা।//
একটু খেয়াল করুন। দেখুন আইনে উল্লেখ আছে ‘অজামিনযোগ্য’। তার মানে অন্যান্য বড় বড় (উপরে উল্লেখিত) অপরাধের চেয়েও আপনার অপরাধ অধিক মারাত্বক বলে গণ্য হবে। সাথে সাজার উল্লেখ আছে সর্বনিম্ন ৭ বছর থেকে সর্বোচ্চ ১৪ বছেরর জেল, এবং ক্ষেত্র বিশেষে ১ কোটি টাকা পর্যন্ত জরিমানা। তার মানে এক লাইনের একটি স্ট্যাটাসই আপনার জীবন ধ্বংস হওয়ার জন্য যথেষ্ট হবে।
একটু চিন্তা করুন। আপনি অনলাইনে সক্রিয়। সরকারের বিভিন্ন অ-দূরদর্শী সিদ্ধান্ত ও ভুল কাজের সমালোচনা করে লিখেন। বিভিন্ন আমলা-মন্ত্রীদের হাস্যকর কীর্তিকলাপ নিয়ে স্যাটায়ার লিখেন। আপনি আপনার মতাদর্শ, আইডিয়া, চিন্তা-চেতনা প্রকাশ করে প্রায়ই লেখালেখি করেন। এখন লেখালেখির সময় আপনি জেলের ভয়ে অস্থির থাকবেন নাকি লেখায় আপনার চিন্তার প্রতিফলন ঘটাবেন? এর সাথে আরেকটি ব্যাপারও আছে। অনলাইনে বিভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শ ও ভিন্নমতাদর্শ নিয়ে লিখেন তাদের শত্রুওসংখ্যাও নেহায়েত কম থাকে না। আর অনলাইনে লিখে দিনকে রাত এবং রাতকে দিন বানানো মোটেই কঠিন কিছু নয়। পরে অবশ্য দিনকে দিনের জায়গায় এবং রাতকে রাতের জায়গায় ফেরত পাঠানো বা প্রমাণ করা যায়। কিন্তু সেটা বেশ কষ্টসাধ্য ও সময়সাপেক্ষ। কিন্তু এই আইন অনুসারে সে সুযোগই দেয়া হবে না। আপনি জামিন না পেয়ে জেলের ভিতরে থেকে কিভাবে আপনার বিরুদ্ধে করা মিথ্যে ষড়যন্ত্রের অসারতা প্রমাণ করবেন? আর নির্দোষ প্রমাণিত হলেও তার আগে কয়েকমাস আপনার জেল জীবন অলরেডি অতিবাহিত হয়ে যাবে।
ফলে আপনার ছবি, নাম, ঠিকানা সংগ্রহ করে আপনার নামে লিখে আপনাকে মামলায় ফেলতে খুব একটা কষ্ট আপনার শত্রুদের হবে না। আর আপনিও এই সর্বনেশে আইনের চিপায় পিষ্ট হবেন কোনরকম অন্যায়-অপরাধ, এমনকি আপনার অপরাধ সম্পর্কে কিছু না জেনে-শুনেই! ভেবে দেখুন কি ভয়ঙ্কর একটি সময় অপেক্ষা করছে আপনার জন্য। এখন আপনি এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হবেন নাকি ভবিষ্যত জেল জীবনের আশংকায় বেঁহুশ থাকবেন সেই সিদ্ধান্ত একান্তই আপনার।
//-// অংশটুকু সংগৃহিত।