রুহুল, অর্থাভাবে দাখিল পরীক্ষা দিতে না পারা এক হতভাগা বেকার কিশোর। মা-বাবা, বোন, ও বুড়ো দাদাকে নিয়ে রুহুলদের সংসার। জীবনের ঘাত-প্রতিঘাতে একরকম বিরক্ত হয়েই বসতভিটা বিক্রি করে বিদেশ যায় রুহুলের বাবা। রুহুলদের আশ্রয় হয় ঢাকা বিমানবন্দরের রানওয়ের কাছাকাছি এক খুপড়িঘরে। যেখানে প্রতিটি বিমান উড্ডয়ন ও অবতরণের সাথে সাথে রুহুলদের ঘরে ভূমিকম্প অনুভূত হয়।
রুহুলের বোন গার্মেন্টসে কাজ করে। মা সমিতি থেকে ঋণ নিয়ে দুটি দুধেল গরু কিনে দিনরাত হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে। রুহুল অনেক খোঁজাখুঁজি করেও কোন কাজ জুটাতে পারে না। ছোটবোন গার্মেন্টস এ কাজ করে পরিবারের ভরণপোষণ চালায় অথচ সে বড় ভাই হয়ে বসে বসে বেকার খাচ্ছে। বিষয়টা তাকে খুব পীড়া দেয়। এ নিয়ে মাঝে মাঝে তাকে দু’একটু টিকা টিপ্পনীও শুনতে হয়।অবশেষে বাধ্য হয়ে দুঃসম্পর্কের এক মামার কম্পিটারের দোকানে কম্পিউটারে টাইপিং ও ইন্টারনেটের কাজ শিখতে শুরু করে।
আলিয়া মাদ্রাসায় পড়া রুহুলের মন খুবই সরল। অন্যায়ের প্রতিবাদ সে সবসময়ই করার চেষ্টা করে। আলীয়া মাদ্রাসায় পড়লেও ধর্মীয় গোড়ামী থেকে সে অনেকটা মুক্ত। তবে তার ধর্মের প্রতি অগাধ আস্থা ও বিশ্বাস আছে। যতটুকু সম্ভব ধর্মীয় বিধান পালন করার চেষ্টা সে করে।এভাবেই কষ্টে দিনাতিপাত করতেছিল রুহুল ও তার পরিবার।
কম্পিউটারে কাজ শিখতে গিয়ে রুহুলের সাথে পরিচয় হয় আরিফের। আরিফও রুহুলের মামার দোকানে কম্পিউটারের কাজ শিখে। আরিফ ইন্টারনেটের কাজে রুহুলের চেয়ে এক্সপার্ট। রুহুলের সমস্যা সমাধান করতে গিয়েই দুজনের কথা, পরিচয় ও বন্ধুত্ব হয়। নেটে নানা ইসলামিক বিষয়াদির সাথে পরিচয় করিয়ে দেয় মৃদুভাষী রুহুল। একসময় তারা খুব অন্তরঙ্গ হয়। আরিফ একটি গোপন ইসলামিক সংঘের সাথে জড়িত। রুহুলকে প্রকৃত ইসলামের পথ দেখানোর কথা বলে আরিফ তাকে তার লিডারদের কাছে নিয়ে যায়। গেলে দেখা যায়, আরিফ জঙ্গীগ্রুপের সাথে জড়িত। রুহুলকেও একইপথের সাথী করে নেয়।
আস্তে আস্তে রুহুলের মধ্যে অস্বাভাবিক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। সে পরিবারে এসে ধর্মের বিধিবিধান নিয়ে বাড়াবাড়ি শুরু করে। শুরু হয় তার সাথে তার মা-বোন ও পরিবারের সাথে দ্বন্দ্ব। সে ঘর ছাড়ে। আরিফ ও জঙ্গীগ্রুপের সাথে দূরবর্তী স্থানে জঙ্গী প্রশিক্ষণ নিতে যায়। পরিবার-পরিজন, ঘর-সংসার ছেড়ে সে এক অজানা ভয়ংকর পথে পা বাড়ায়। একে একে আরিফ ও জঙ্গী গ্রুপ দেশের সিনেমা হল, আদালত প্রাঙ্গন ও বিভিন্ন স্থানে বোমাহামলা ও আত্মঘাতী হামলা চালাতে থাকে। আত্মঘাতী হামলা চালাতে গিয়ে আরিফ মারাত্বকভাবে আহত হয়ে ধরা পড়ে পুলিশের হাতে। যে খবর দেখে প্রায় মুষড়ে পড়ে রুহুল। সাথে সাথে তাদের গ্রুপের বিলুপ্তি ঘটে। যে যার মতো পালিয়ে যায়। রুহুল ফিরে আসে তার বাড়িতে। সে বুঝতে পারে সে সঠিক পথে ছিল না। সে অনুতপ্ত হয়। নতুন করে বাঁচার স্বপ্নে বিভোর হয় সে।
হ্যাঁ বলছিলাম তারেক মাসুদের সর্বশেষ ছবি রানওয়ের কাহিনী।ছবিটির কাহিনীর সাথে আমার ব্যক্তিগত জীবনের কাহিনীরও কিছুটা মিল আছ। আমিও হতে পারতাম রুহুলের মতো! সে গল্প আরেকদিন। একটি সাধারণ ছেলে কিভাবে জঙ্গীগ্রুপের সক্রিয় সদস্য হয়ে ওঠে সেটা এবং সেটার প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যেই তারেক মাসুদ নির্মান করেছিলেন ছবিটি। যেমনটি করেছিলেন মাটির ময়না ছবিটিতেও। আমরা অনেকেই ধর্মান্ধতা, ধর্মীয় গোড়ামী সম্পর্কে লেখালিখি করি। কিন্তু সেটা ম্যাস পিপলের কাছে খুব একটা পৌছায় না। সেক্ষেত্রে চলচিত্র ম্যাস পিপলের কাছে পৌছানোর এক অন্যতম সুন্দর এবং সঠিক মাধ্যম। তারেক মাসুদ সেই মাধ্যমটিই বেছে নিয়েছিলেন নিঃশঙ্কচিত্তে।
তবে তারেক মাসুদের স্বপ্ন পুরোপুরি সার্থক হয় নি। মাটির ময়না ছবিটি মুক্তি পাওয়ার পরপরই দেশজুরে প্রতিক্রিয়াশীলদের বিক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। ফলে ছবিটি তিনি গ্রামগঞ্জে ঢালাওভাবে প্রচার করতে পারেননি। তবে রানওয়ে ছবিটি করার সময় তিনি দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিলেন যে, ছবিটি যেভাবেই হোক সারাদেশে প্রচারের ব্যবস্থা তিনি করবেন। কিন্তু ভাগ্যের নির্মমতার বলী হয়ে তিনিই আমাদেরকে ছেড়ে চলে গেছেন।
ছবিটি যে সময়ের প্রেক্ষাপটে তৈরী সে সময়ের কথা চিন্তা করুন। সিনেমা হলগুলোতে বোমাহামলা, সারাদেশে একযোগে বোমাহামলা, আদালতে-বিচারকদের ওপরে বোমা হামলা, ২১ আগষ্টের গ্রেনেড হামলা, রমনায় বোমা হামলা, কোটালিপাড়ায় শেখ হাসিনাকে মারতে বোমাস্থাপনসহ বাংলাভাই, জ়েএমবিসহ বিভিন্ন জঙ্গীগোষ্ঠীর উথান। ভাবা যায়!
যে সিনেমার ওপর ভিত্তি করে সিনেমা হলগুলোতে হামলা করা হল, সে সিনেমাগুলো কাদের অধীনে মুক্তি পেয়েছিল? স্মরণ করে দেখুন, বাংলাদেশের ইতিহাসের স্মরণকালের সেরা অশ্লীল ছি!নেমাগুলি তৈরী হয়েছে ২০০১-০৬ শাসনামলে। আবার তারাই জঙ্গীগোষ্টীকে মদদ দিয়েছে বোমা হামলা চালানোর। আজ আবার তারাই সেজেছে ধর্মের সোল এজেন্ট!
যাইহোক, ক্ষমতাসীন দলের উচিত ছিল, তারেক মাসুদ মারা যাবার পরপরই এসব ছবিগুলোকে হাইলাইট করা। ঢালাওভাবে দেশজুরে প্রচারের ব্যবস্থা করা। সরকারের থিঙ্ক-ট্যাংকরা কিভাবে কি ভাবেন, চিন্তা করেন তা তারাই ভালো জানেন। আশা করছি আপনারা সবাই ছবিটি দেখবেন এনং অন্যদের মাঝে ছবিটি ছড়িয়ে দিতে সচেষ্ট হবেন। ধর্মান্ধতা নিপাত যাক, মানবতা মুক্তি পাক!