চলে গেলাম বাসায়। যেভাবেই হোক ঢাকার কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাকে ভর্তি হতেই হবে। শর্ট হিট লিস্ট তৈরি করলাম। ঢাবি, এমাইএসটি, টেক্সটাইল। ফার্স্ট চয়েজ ঢাবির এপ্লাইড ফিজিক্স। এদিকে বাসায় ধুন্ধুমার অবস্থা। বাসায় রীতিমতো কোর্ট বসে গেল। কাহিনী কি? তুমি চইলা আসলা কেন? উত্তর দিতে দিতে জান খারাপ। তো নানা ভাবে বুঝিয়ে কুয়েটের চোদ্দ গুষ্টি উদ্ধার করে অবশেষে রাজি করালাম "সেকেন্ড টাইম" টেরাই করার জন্য। যারা দ্বিতীয় বার এডমিশনের জন্য টেরাই করে, তাদের ব্র্যান্ড নাম হচ্ছে "সেকেন্ড টাইম"। কুয়েটে পড়াকালীন সময়েই মা মারা যান। আর তাই আশেপাশের জ্ঞানী ব্যক্তিদের ভাষ্য ছিল, ছেলের মাথা পুরা গেছে!!! ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটি ছাইড়া চইলা আসছে!!! এর কোনো ভবিষ্যৎ নাই!!! আমার ভবিষ্যৎ তাদের কাছে খারাপ থেকে খারাপতর হতে থাকে। মোটামোটি জ্ঞানী ব্যক্তিদের যন্ত্রনায় বাসা থেকেই বের হওয়া বন্ধ করে দিলাম। গবেষনা করে বের করলাম এমআইএসটি আর টেক্সটাইলের জন্য আগের বুয়েট কোচিং যথেষ্ট। প্রস্তুতি নিতে হবে ঢাবি'র জন্য। এজন্য দরকার কোচিং। বাসা আমার ময়মনসিংহে। সেখানে বেশিরভাগই মেডিকেল কোচিং করে, আর যারা বাকি থাকে তারা করে বুয়েট কোচিং। বিশ্ববিদ্যালয় কোচিং এর অবস্থা খুবই করুণ। তারপরও ভর্তি হয়ে গেলাম কোচিং এ। কিছুদিন ক্লাস করেই বিরক্ত হয়ে গেলাম, কেননা ক্লাস নেন সেখানকার আনন্দমোহন কলেজের ছাত্ররা যারা কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স না পেয়ে ভর্তি হয়েছেন। তো দেখা গেলো গিয়ে পরীক্ষা দেই, তারপর বেরিয়ে যাই। তবে বেরিয়ে কিন্তু বাসায় যাই না! যাই ময়মনসিংহের ডেটিং প্লেস পার্কে। কিছু বন্ধু বান্ধব ও জুটে গেলো, হাজার হোক হোমগ্রাউন্ড বলে কথা!!! সেখানে বসে তাদের সাথে দিন দুনিয়ার ভূত ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা করি। এক ভাইয়ার কাছে পড়া শুরু করলাম। মূলত তাঁর কাছে পড়াতেই সে যাত্রা বেঁচে গিয়েছিলাম, নয়ত আবার কুয়েটেই ফিরে যেতে হত। ভাইয়ার একটা কথা মাথায় ঢুকে গিয়েছিল, তোমরা কিন্তু সেকেন্ড টাইম না, লাস্ট টাইম! এইবার কিছু না করতে পারলে আর পারবা না। তারপরও যে একেবারে ভালো ছেলে হয়ে গিয়েছিলাম তা না। কুয়েটে ভর্তি হওয়ার সুবাদের কম্পিউটার কিনেছিলাম। তো বাসায় নিয়মিত মুভি ফেস্টিভ্যাল চলত। একদিন দেখা গেলো ভাইয়ার কাছে পরীক্ষা। সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে মুভি দেখছি, কিন্তু সিনেমা শেষে হতে আরো ১৫ মিনিট আবার অন্য দিকে পরিক্ষার সময় হয়ে গেছে। ভাইয়াকে ফোন দিলাম, ভাইয়া আমরা জরুরী কাজে আটকে গেছি, আসতে কিছুক্ষন দেরি হবে। তাই পরীক্ষা একটু দেরী করে শুরু করেন। এই ছিলো অবস্থা। এই সময়ে আমার বন্ধুরা যারা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে তারা বন্ধে বাড়ি এসে তাদের মূল্যবান টিপস দিয়ে আমাকে সাহায্য করেছে । একসময় এইচএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট হলো। শুরু হলো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সার্কুলার দেয়া। আমার পরীক্ষাগুলো পড়লো একেবারে পাশাপাশি। প্রথমে টেক্সটাইল, পরে এমআইএসটি, সবার শেষে ঢাবি। টেক্সটাইল এবং এমআইএসটিতে বন্ধুদের হলে থেকে পরীক্ষা দিলাম। বন্ধুরা যথারীতি বড়ভাই সুলভ গাম্ভির্যে আমাকে পরীক্ষার হলে নিয়ে যাওয়া এবং আসার কাজ করল। টেক্সটাইল একেবারে ধরে রেখেছিলাম হয়ে যাবে। কিন্তু ইতিহাসে প্রথম বারের মতো টেক্সটাইলে অন্য ধাচের প্রশ্ন হওয়ায় হল না। এময়াইএসটি'র রেজাল্ট হল ঢাবি পরীক্ষার আগের দিন। যথারীতি সেখানেও ওয়েটিং। সে সময় মনে হল জীবনেও বোধ হয় কোথাও সরাসরি চান্স পাব না! পরে অবশ্য সেখানে সিএসই'তে হয়েছিল। ঢাবি পরীক্ষার সময় ছিলাম এক বন্ধুর মামার বন্ধুর মেসে ! দিলাম পরীক্ষা, জীববিজ্ঞনে ফেল করতে করতে করি নাই। অথচ ঢাবির প্রথম দিকের জীববিজ্ঞান বিষয়ক বিষয়গুলোতে পেতে হলে জীববিজ্ঞানে অন্তত ১২ এবং বায়োকেমিস্ট্রিতে পেতে হলে ১৫ পেতে হয়। পরীক্ষা দিয়ে সেই মেসে ফিরে দেখি আমার মোবাইল গায়েব। এ যেন মরার উপর খাড়ার ঘা! একে তো পরীক্ষা ভালো হয় নাই, তারপর বাসায় যখন জানাইলাম মোবাইল হারাইছি, আহা সে যে কি আদর সম্ভাষণ, না বলাই ভাল। পরের দিন রাতেই রেজাল্ট হয়ে গেল। মেরিট আসল ৩৬৭, তার মাঝে জীববিজ্ঞানে ১২.৭৫। আবার নতুন ঝামেলা। এই মেরিটে জীবনেও এপ্লাইড ফিফিক্স পাওয়া সম্ভব না, অন্তত অতীত ইতিহাস তাই বলে। এক নিলে আছে সিএসই। আর যারা আমাকে চেনেন তারা বললেন, তোমার যে লাক তুমি এপ্লাইড ফিজিক্সের চিন্তা বাদ দাও। ঠিক করলাম সিএসই নিব। আগে যদিও এপ্লাইড ফিজিক্স নিয়ে বাসায় অনেক গলাবাজি করেছি, রাতারাতি আমার ভাষা চেঞ্জ হয়ে গেল। এপ্লাইড ফিজিক্সের আসলে কোনো ভবিষ্যৎ নাই! দেশের বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সিএসই'র ভবিষ্যৎ সবচেয়ে উজ্জল। কিন্তু দুঃখজনকভাবে তৃতীয় লিস্টেই এপ্লাইড ফিজিক্সে নাম এসে গেলো! বিশ্বাস করতেই কষ্ট হচ্ছিল যে হয়ে গিয়েছে!!! সে সময়টা ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে খুশির কয়েকটা দিন। জ্ঞানী ব্যক্তিদের কাছে আমি রাতারাতি সোনার টুকরা ছেলে হয়ে গেলাম!!! অবশেষে লক্ষে তো পৌছলাম। আমার রেজাল্ট অনেক ভালো থাকায় স্কোর অনেক ভালো ছিল। তাই চান্স পেতে খুব যে কষ্ট হয়েছে তা নয়, তবে সে খারাপ সময়টার কথা না বললেই নয়। শেষে কথা হচ্ছে, ঢাবিতে যারাই ভর্তি পরীক্ষায় পাস করে, তাদেরই রেজাল্ট আসে। সুতরাং সরাসরি কোথাও চান্স পেয়েছি এটা জীবনে বলতে পারলাম না ।
খেরোখাতা : ৩ : হল কথন, সিট যেখানে হতাশার গল্প
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা জুলাই, ২০১০ সকাল ১১:২৯