কবি রফিক আজাদ রচিত কবিতা ‘ভাত দে হারামজাদা’ নিয়ে দেশ বিদেশের অনেকের অনেক লেখা পড়ছি কবি চলে যাওয়ার পরে। তাঁর লেখা কবিতা নিয়ে আমিও আজ লিখতে বসেছি কিছু কথা। মনে হচ্ছে এই লেখা যদি তিনি দেখে যেতে পারতেন! কেউ চলে যাওয়ার চলে পরেই আমরা তাঁর গুণগান গাই অথবা তাঁর মহাশ্মশান বানাই, এটাই আমাদের স্বভাব!
কবি রফিক আজাদ যখন ‘ভাত দে হারামজাদা’ লিখেছিলেন তখন তাঁকে ঘিরে কি কি হয়েছিলো আমার জানার কথা নয় কিন্তু যখন বেড়ে উঠেছি তখন এই কবিতাটি আমার অনেক ভালো লাগা কবিতা’দের মধ্যে একটা হয়ে যায় এবং এই কারণেই কবি রফিক আজাদের ছবি এবং কবিতাটি আমার ‘নীরবে হৃদয়ে’ এ্যালবামে জায়গা করে নেয়।
সেদিন এক স্বজনের কথায় একজন প্রবাসীর লেখায় পড়লাম-(সামাজিক মাধ্যম, ১২ই মার্চ ২০১৬)
‘‘একমাত্র একজনই (চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ, বাসন্তির জালপরা ছবি, সেই টালমাতাল অস্থির সময়ে) বঙ্গবন্ধুকে 'হারামজাদা' গালি দিয়েছেন; লিখেছেন- 'ভাত দে হারামজাদা’...।’’
আরো অনেক প্রত্যাশিত কথা। এধরণের মন্তব্য করার মন মানসিকতার মানুষ পৃথিবীতে এখনো আছে যাদের কথা নতুন প্রজন্মকে কবি রফিক আজাদ ও এই কবিতার ভুল ব্যাখ্যা ও মূল্যায়নে উদ্বুদ্ধ করতে পারে।
অগ্রজ কবি ও মুক্তিযোদ্ধা রফিক আজাদের কবিতা নিয়ে কিছু বলার আগে কবিতাটি সম্পর্কে কবি’র নিজের উক্তি তুলে ধরছি - (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ১৮ই মার্চ ২০১৬)
‘‘: আপনি ‘ভাত দে হারামজাদা...’ কবিতাটি কোন পরিপ্রেক্ষিতে লিখেছিলেন?
: ‘ভাত দে হারামজাদা...’ কবিতাটি এক ধরনের প্রতারিত হয়ে লেখা বলে মনে করি। মুক্তিযুদ্ধ কোনো দিনই এ দেশের বহু লোক মেনে নিতে পারেনি। যুদ্ধে জয়ী হওয়ার পরও বাংলাদেশ নিয়ে দেশি বিদেশি ষড়যন্ত্র চলছিল। যাতে ভাঙাচোরা এ দেশটি শক্ত করে দাঁড়াতে না পারে। তখন রংপুর অঞ্চলে মঙ্গা হলো। এরমধ্যে রংপুরের মানুষের জন্য সাহায্য এনে চাল বোঝাই জাহাজ ফেরত নিয়ে গেল আমেরিকা। সেটা নিয়ে দেশের কিছু পত্রপত্রিকাও ষড়যন্ত্র শুরু করল। তার অংশ হিসেবে বাসন্তীকে জাল পরিয়ে একটি ছবি পত্রিকায় ছেপে দিল। জাল পরিয়ে আব্রু রক্ষা হয়! আমরা দেশের মানুষ এতটাই বেকুব ছিলাম। আরেকটি ছবি আমাকে মারাত্মকভাবে আহত করেছিল। রংপুর ইস্টিশনে এক লোক বদ হজম হয়ে বমি করেছিল। এক ‘হারামজাদা’ ফটোগ্রাফার দুর্ভিক্ষ দেখানোর জন্য একটা বুভুক্ষ লোককে একশ টাকা দিয়ে ওই বমি খাওয়ার ভঙ্গি পত্রিকায় প্রচার করে। কাগজে এসব দেখে ‘ভাত দে হারামজাদা...’ কবিতা লিখেছিলাম।’’
নিজে লেখালেখির সাথে জড়িত আছি বলেই বুঝতে পারি একজন প্রকৃত কবি বা লেখক কখনো ব্যক্তি মানুষকে নিয়ে লেখেন না, তাঁদের লেখা সার্বজনীন আর যারা ব্যক্তি মানুষকে নিয়ে লেখেন তাঁরা আমার দৃষ্টিতে কবি বা লেখক নন। কবি রফিক আজাদের মতো একজন মুক্তিযোদ্ধা বঙ্গবন্ধুকে গালি দিয়ে কবিতা লিখতে পারে বিষয়টি আমার নিজের কাছে অবিশ্বাস্য মনে হয়। এই কারণে আমি এখানে ওখানে বিষয়টি নিয়ে ঘাটাঘাটি শুরু করি এবং ১৭ মার্চ ২০১৬ সালে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী’র একটি লেখা পাই যা থেকে কিছু কথা উদ্ধৃতি দিচ্ছি কারণ আগামী প্রজন্মের জন্য এই কবি ও কবিতার ইতিহাস জানা অত্যন্ত গুরুত্ত্বপূর্ণ বলে মনে করি।
বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম -(বাংলাদেশ প্রতিদিন, ১৭ই মার্চ ২০১৬)
‘‘১২ মার্চ আমার প্রিয় কবি রফিক আজাদ পরলোকে চলে গেছেন। ৭৫ বছর বয়সে তার পরলোকগমন আমি স্বাভাবিকভাবেই বিবেচনা করতাম। কিন্তু একজন মুক্তিযোদ্ধা কবি হিসেবে, প্রত্যক্ষ রণাঙ্গনের কবি হিসেবে তার যতটুকু স্বাধীন দেশে জায়গা পাওয়ার কথা ছিল তা তিনি পাননি...মুক্তিযুদ্ধে এক শনিবারে সখিপুরের মহানন্দপুরে কবির সঙ্গে আমার দেখা। টাঙ্গাইলের মানুষ হিসেবে অনেক আগে থেকেই তাকে জানতাম চিনতাম...মুক্তিযুদ্ধে অনেক কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক জড়িত ছিলেন। কিন্তু কবি রফিক আজাদের মতো প্রত্যক্ষ রণাঙ্গনে কামানের গর্জন শুনে এক হাতে রাইফেল নিয়ে অন্য হাতে কলম কেউ চালাননি...একদিন এক রাজনৈতিক সভা করে দুপুরে কাঞ্চনপুর হয়ে ফিরছিলাম...সেদিন এক বাড়ির দেউড়ি বেড়ায় কয়েকজন ছেলেমেয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। একটা ছোট্ট উদাম বেশ নাদুসনুদুস বাচ্চা তার মাকে ঠেলা দিচ্ছিল, ‘ওই মা, মা, ভাত দিলি না? পেটে যে আগুন ধরছে। পুইড়া গেল। মা ভাত দে।’ বাচ্চার আপন মনে মায়ের কাপড় টেনে বারবার বলা কথা আমার কানে লাগে। সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ছিল ’৭৩ এ কবি রফিক আজাদের ‘ভাত দে হারামজাদা’ কবিতার কথা...স্বাধীনতার পর কবি রফিক আজাদ আমার প্রাণ ছুঁয়ে ছিলেন। রফিক আজাদ মুক্তিযুদ্ধের কবি, স্বাধীনতার কবি, খেটে খাওয়া মানুষের ভালোবাসার কবি। তিনি রণাঙ্গনে যেমন কলম ধরেছেন, তেমনি রাইফেলও ধরেছেন...‘ভাত দে হারামজাদা’ লেখার জন্য কবি রফিক আজাদের জেল হয়েছে, হুলিয়া জারি হয়েছে...এক সকালে উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটে এসে...বলেন...আমার যে জেল হয়ে গেছে। জেলখানা আমার ভালো লাগবে না। আমি কবি মানুষ জেলখানায় বসে বসে কী করব?...কবির নাস্তা খাওয়া শেষ হলে তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘সত্যিই আপনি বঙ্গবন্ধুকে এত বড় গালি দিলেন? আমাকেও কি দিতে পারবেন?’ মনে হয় কবি যেন জ্বলে উঠলেন। জ্বলবারই কথা, পেটে দানা পানি পড়লে, নিজেকে নিরাপদবোধ করলে তখন আর কবিদের হীনমন্যতা থাকে না। স্বরূপে তারা বেরিয়ে আসে। কবি বললেন, কোথায় বঙ্গবন্ধুকে গালি দিলাম? আমি শুধু আমার ক্ষুধার জ্বালার কথা বলেছি, মানুষের কথা বলেছি। গ্রামগঞ্জের বাচ্চারা মায়ের কাছে কীভাবে খাবার চায়। খুব ক্ষুধা লাগলে বলে না, মাগো ভাত দে, ভাত দিলি না, ভাত না দিলে তোরে খামু কিন্তু, বলে না?’ ...কবি রফিক আজাদের ‘ভাত দে হারামজাদা’ শুনে আমি উত্তর পেয়ে গিয়েছিলাম। মনে হচ্ছিল কবি তো মোটেই সরকারকে গালি দেয়নি, বঙ্গবন্ধুকে তো নয়ই। বরং বঙ্গবন্ধুকে কৃষ্ণ গহ্বরের দিকে যাওয়া থেকে ফেরানোর চেষ্টা করেছেন...কবিকে বাড়িতে রেখে বিকালে গণভবন সুগন্ধায় গিয়েছিলাম। বঙ্গবন্ধু আমাকে দেখেই বলছিলেন, ‘কি রে কাদের! তোর কবি রফিক আজাদ আমাকে অমন গালাগাল করছে কেন? সত্যিই কি আমি অমন কাজ করছি?’ বঙ্গবন্ধুর কথায় আমার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠেছিল। কতটা আঘাত পেলে কেউ অমন বলে। আমি বললাম, না। কবি আপনাকে গালাগাল করেনি। আপনাকে যথার্থ পিতার জায়গা দিয়ে বিপদ থেকে সতর্ক করতে চেয়েছে। ‘কী বলিস? অমনভাবে এই দুঃসময়ে আমাকে উদ্দেশ্য করে ভাত দে হারামজাদা বললো। তারপরও তুই বলছিস ও খারাপ বলেনি। কী বলিস?’ কবি আমায় যেভাবে যা বুঝিয়েছিলেন আমিও নেতাকে সেভাবে বুঝানোর চেষ্টা করলাম।এখন খেয়াল নেই হয় মোহাম্মদ আলী, না হয় ফরাসউদ্দিন কেউ একজন ছিলেন। কবিতাটি আনতে বললেন।আমি ২-৩টি জায়গা কয়েকবার পড়ে শুনালাম। পিতা তার আসন থেকে দাঁড়িয়ে গিয়ে আমার পিঠ চাপড়ে বললেন, ‘ঠিকই তো, তোর কবি ঠিক বলেছে, ঠিক লিখেছে। ওকে এখনই নিয়ে আয়।’ কবি আমার বাসাতেই ছিল। তাকে বঙ্গবন্ধুর কাছে নেওয়া কোনো কঠিন ছিল না। কিছুক্ষণ পরেই তাকে নিয়ে গেলাম পিতার কাছে। গিয়ে সালাম করার সঙ্গে সঙ্গে মাথার চুল ধরে টেনে তুলতে গিয়ে পিতা বললেন, ‘এই হারামজাদা, কবি হলেই এমন লেখে?’ কবি রফিক আজাদ বেশ মুখোর ছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন, ‘এই যে আমার মাথার চুল ধরে টেনে তুলতে হারামজাদা বললেন— এটা কী? এটা কি ক্ষুব্ধ হয়ে, নাকি ভালোবেসে বলেছেন?’ বঙ্গবন্ধু তব্দা ধরে বসে পড়লেন। কবি তার ‘ভাত দে হারামজাদা’ শুনালো ৪-৫ বার। পিতা অভিভূত হলেন। বুকে নিয়ে বারবার আদর করে বললেন, ‘তুই আরও লিখবি। এটাই তো কবিতা। মানুষের কথা তোরা না বললে কে বলবে?’ আমাকে বললেন, ‘কাদের, ওকে মাঝে মাঝে নিয়ে আসবি। ও আমাকে কবিতা শুনাবে। কবিতা শুনলে মন পরিষ্কার হয়...সঙ্গে সঙ্গে...বললেন ‘ওর মামলা আমি তুলে নিলাম। আমি বেঁচে থাকতে ওর নামে যেন কোনো মামলা না হয়’... ১২ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের কেবিন ব্লকে কবি রফিক আজাদের প্রাণহীন মুখ দেখে যখন ফিরছিলাম, কবির পরিবার-পরিজন বারবার বলছিল, ‘কবির তো কোনো মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট নেই...কবি রফিক আজাদ নেই। আর কোনোদিন কাউকে জ্বালাতে আসবে না। গত সোমবার মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়েছে।’’
স্বাধীনতা যুদ্ধ জীবন্ত ইতিহাস বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী কথা বলার পরে আর কিছু থাকে না। সূর্য্যকে যেমন হাত দিয়ে ঢেকে রাখা যায় না তেমনি মুক্তিযুদ্ধের এক সূর্য্য বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী। তিনি কবি রফিক আজাদকে কাছে থেকে দেখেছেন, কখনো কখনো তাঁকে কবি নজরুলের সাথে তুলনা করেছেন। আগামি প্রজন্ম তাঁর লেখা থেকে জানতে ও দেখতে পারবে মুক্তিযুদ্ধের সত্য ও বাস্তব চিত্র।
কবি রফিক আজাদকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা হয়েছে।
কবি ও লেখকদের লেখা শব্দাবলীর ভুল ব্যখ্যা যুগে যুগে হয়েছে। আদর্শ পৃথিবীতে কবি বা লেখক তাঁদের কথা বা লেখার কৈফিয়ত দিতে বাধ্য নন কোনক্রমেই কিন্তু আমরা তো আর আদর্শ পৃথিবীতে বাস করি না তাই বলতে হয়, লিখতে হয়! কবি নজরুল কখনোই ভগবানের বুকে পদচিহ্ন এঁকে দিতে চান নি ওটা ছিলো তাঁর কাব্যিক প্রকাশ, বিদ্রোহের অনল। ‘বিদ্রোহী’ লিখে কবি নজরুল যন্ত্রণা সয়েছেন। ‘ভাত দে হারামজাদা’ লিখে শাস্তি পেতে হয়েছে কবি রফিক আজাদকে। অসায়ত্ত্বের যাতনায় কলম দিয়ে তাঁকে সাজাতে হয়েছে কাপুরুষের শব্দাবলী।
‘‘হে আমার অবাধ্য কলম, ক্রোধ সংবরণ করো,
ভদ্রলোকের মতো লেখো, ভদ্রলোকদের দ্বারে ধর্না দিও-
শিখে নাও সাজানো-গোছানো প্রভুপ্রিয় বাক্যাবলি…
হে কলম, এইবার নত হও, নতজানু হও...’’
কবি নজরুল তাঁর লেখায় দৃশ্যমান করেছিলেন বিদ্রোহকে, দরিদ্রতাকে।
কবি রফিক আজাদ দৃশ্যমান করেছিলেন ‘ক্ষুধা’ কে। ‘ক্ষুধা’ মানুষ চেনে না, ভাষা জানে না। ক্ষুধার কাছে সব তুচ্ছ। ক্ষুধা জানে শুধু ক্ষুধার জ্বালা। কবি এবং লেখকদের লেখার আলোচনা বা সমালোচনা হতেই পারে কিন্তু সময় অসময়ে তাঁদেরকে ভুল ভাবে চিত্রায়িত করা হয় যা কখনোই সঠিক নয়।
যুগে যুগে কবি নজরুল’রা লাঞ্ছিত হবে, যুগে যুগে কবি রফিক আজাদেরা কলঙ্কিত হবে এবং যুগে যুগে তাঁরাই নমস্য হবে। কলম কখনো থেমে থাকবে না।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে মার্চ, ২০১৬ রাত ৮:১২