বিস্তারিত লেখার আগে বলতে চাই কেন আমার এই লেখা।
২৬শে ফেব্রুয়ারি ২০১৫। ফেসবুকে এসেই দেখলাম অভিজিৎ রায় নামের একজন লেখককে বই মেলা থেকে ফেরার পথে টিএসসি’র সামনে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। তিনি একজন বাংলাদেশি আমেরিকান। হ্যাঁ, আমি বাংলাদেশি আমেরিকানই বলবো কারণ আজও আমি আরো অনেকের মত নিজেকে ব্রিটিশ বাংলাদেশি বলতে পারি না, বলি বাংলাদেশি ব্রিটিশ। অন লাইনে খবরটি দেখে আমি ভাষা হারিয়ে ফেলি। তিনি লেখক ছিলেন, ‘মুক্তমনা’ নামক ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা সবই পত্রিকায় দেখলাম। আমি তাঁর লেখা কখনো পড়েছি বলে মনে হয় না। ব্লগ বলতে আমার কাছে সামহোয়্যারইন ব্লগ, অবশ্য অল্প কিছুদিন WordPress এ লিখেছিলাম। সময় পেলে সামহোয়্যারইন এ এসে উঁকি দিয়ে যাই, অন্য ব্লগ নিয়ে ঘাটাঘাটি করার সময় পাই না।
ফিরে আসছি অভিজিৎ রায়ের কথায়--
এক ব্লগারের হত্যাকাণ্ডের সংবাদটি পেয়ে একেবারে মূক হয়ে যাই। সারা রাত ঘুমাতে পারি নাই। কোন্ দোষে তাঁকে অকালে জীবন দিতে হয়েছে সেটা আমার কাছে চিন্তার মুখ্য বিষয় ছিলো না। সকালে বাসা থেকে আমাকে বলা হলো, ‘বলয় থেকে বেরিয়ে আসো, খবর পড়া বাদ দাও...’ আমি বুঝতে পারছি আমার নির্ঘুম রাত দেখে শঙ্কিত হয়েছে কারণ যে কোনো দুঃসংবাদ আমাকে আক্রান্ত করে আর নিজের পাশের মানুষের হয় ঘুম নষ্ট।
কিছুতেই মাথা থেকে দেখে অভিজিৎ এর ঘটনাটি দূর করতে পারছি না।
কিছুক্ষণ পরে পরে ‘কী ভাবছো?’ প্রশ্ন শুনে চোরের মত ধরা পড়ে যাচ্ছি।
মনে হচ্ছে অভিজিৎ আমার কে? যার একটা লেখাও আমি পড়ি নাই!
অভিজিৎ এর সাথে আমার সম্পর্কই বা কী?
লেখালেখি?
পরবাসী বাংলাদেশি?
অভিজিৎ এর বাবার ছবি দেখে আঁতকে উঠি, দেখি পুত্রহারা বড় ভাই বুকে মাথা রেখে কাঁদছে।
অভিজিৎ এর মায়ের কথা ভাবলে দেখি, বড় বোন মাটিতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে।
অভিজিৎ এর ভাইয়ের কথা ভাবলে দেখি, এক ভাই মাঝ রাতে ঘুম ভেঙ্গে বসে আছে হারানো ভাইয়ের সমাধির পাশে।
এরকম আরো অনেক সাদৃশ্য আছে অনেক কষ্টের সাথে।
প্রতিদিনই তো দেশে মানুষ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে। তাঁদের কথা নিয়ে এত কথা নয় কেন? তাঁদের কথা নিয়ে শোক নয় কেন? এমন প্রশ্ন আগে কেউ কখনো করে নাই কারণ যারা আমাকে জানে তাঁরা এও জানে প্রত্যেকটি মৃত্যু সংবাদ আমাকে শুধু আহতই নয় শয্যাশায়ী করে, তথাপিও অভিজিৎ রায়ের হত্যাকাণ্ড আমার কাছে আলাদা। অভিজিৎ রায়ের লেখা আমি পড়ি নাই আর পড়লেও তাঁর বিচার আমি করতে যেতাম না কারণ আমার সৃষ্টিকর্তারই আদেশ, বিচার করার আমি কেউ নই। পাপ পুণ্যের সবকিছুর বিচার ভার সৃষ্টিকর্তারই।
অভিজিৎ কে ধর্মীয় উগ্রবাদীরা হত্যা করলো নাকি তাঁকে হত্যা করে পশ্চিমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলো এ নিয়ে আমার মাথা ব্যথা নাই। অভিজিৎ আমেরিকা থেকে দেশে কবে গেলো, কখন কোথায় বই মেলায় যাচ্ছে, তাঁকে সন্তর্পণে ফলো করা হয়েছিলো সে সব ভাবনার দায়িত্ব তদন্ত কমিটির, আমার নয়।
আমার কথা--
জীবনের জন্য, নিরাপত্তার জন্য আমরা যারা দেশ ছেড়ে পরবাসে আসি বা আসতে বাধ্য হই তাঁদের কিন্তু খুব একটা দেশে যাওয়ার প্রয়োজন নাই। আমাদের পাসপোর্টে দেশের নাম তো দূরে থাক বাবা’র নামেরও প্রয়োজন থাকে না। আত্মীয় স্বজনদের আমরা আশেপাশের দেশে গিয়েও দেখে আসতে পারি তবুও কেন দেশে যাই? দেশে জন্ম নিয়ে বাংলাদেশী হয়েছি এর জন্য আমাদের ওথ নিতে হয় নাই কিন্তু বিদেশে এসে বিদেশী হতে আমাদের ওথ নিতে হয়েছে। সেই ওথের ওয়াদা ভঙ্গ করে আমরা ব্রিটেন-বাংলাদেশের খেলায় কিন্তু বাংলাদেশকেই সাপোর্ট করি, কেন? বিদেশের প্রকাশনা থেকেও বই প্রকাশ করা যায়, এমনকি বিদেশে বসেও দেশ থেকে বই প্রকাশ করা যায় তবুও আমরা দেশ থেকে এ কাজটি করাতে ভালোবাসি, বই মেলায় দেশে ছুটে যাই, কিন্তু কেন? দিনের পর দিন নিজেদের কষ্টার্জিত অর্থ দেশে পাঠায় প্রায় প্রতিটি অভিবাসী, যা ভোগ করে স্বজনেরা আর লাভবান হয় দেশ, কেন এই প্রয়াস? এমন অসংখ্য ত্যাগ তিতিক্ষার কথা আমার মত অনেক অভিবাসী বলতে পারেন। এত কিছুর পরেও আমি/আমরা বার বার দেশে ফিরে যাই, সংসার, সন্তানের চেয়ে অনেক সময় দেশে যাওয়াকে প্রাধান্য দেই। আমরা দেশকে ভালোবাসি, দেশের মানুষকে ভালোবাসি এটাই আমাদের একমাত্র অপরাধ। আমরা নিশ্চিন্ত মনে ভাবি দেশের মানুষ আমাদের গায়ে হাত দেবে এটা হতেই পারে না, হয়তো এটাই আমাদের পাপ।
অভিজিৎ রায়ের এর সাথে আমার পার্থক্য পরিবারের বারণ শুনে এবার আমি দেশে যাই নাই আর সে পরিবারের বারণ না শুনে দেশে গিয়েছে। তাঁকে হত্যা করা হয়েছে লেখালেখি বা অন্য কারণে আমাকে হয়তো হত্যা করা হতে পারতো ছিনতাই করার সময় অথবা লাল পাসপোর্টের জন্য। অভিজিৎ এর ঘটনা ঘটেছে, অন্য কারো ঘটনা হয়তো আগামিতে ঘটার অপেক্ষায় আছে। ২০০৪ অথবা ২০১২ তে বই মেলায় এত নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিলো না কিন্তু ২০১৫তে তো ছিলো।
দেশের মানুষকে প্রতিদিন মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়া হচ্ছে মসনদ পাওয়ার লোভে। এসবে দুঃখ, ঘৃণা, সান্ত্বনা সবই আছে। অভিজিৎ রায়’রা মসনদ পাওয়ার লোভ নিয়ে দেশে যায় না। একজন পরবাসীর হত্যাকাণ্ডে দুঃখ, ঘৃণা আছে কিন্তু সান্ত্বনা নাই। অভিজিৎ রায় এবং আমি, হয়তো আমরা সকল অভিবাসী এক এবং অবিচ্ছেদ্য। আমরা লজ্জিত আমাদের আগামি প্রজন্মের কাছে, আমরা লজ্জিত আমাদের জন্মভূমির পরিচয়ে, আমরা সর্বস্বান্ত হয়েছি আমাদের সন্তানদের কাছে, গর্ব করার মত কিছু আর আমাদের অবশিষ্ট রইলো না।
খবরটি পাওয়ার পরে আমার ফেসবুক স্ট্যাটাসগুলো যেমন ছিলো --
ভাষা হারিয়ে ফেলেছি... (১)
26.02.2015
বলেছিলে চিঠি লিখো--চিঠি লিখো -- (২)
লিখবো বলে কত কথা যে সাজিয়েছিলাম গতকাল
আজ সকালে লিখতে গিয়ে দেখি
কলমে কালি নয় টকটকে তাজা রক্ত ...
ভয়ংকর এক দুঃস্বপ্ন (৩)
চারিদিকে সব কেমন অচেনা
'দেশ প্রেম' শব্দটি কে (৪)
ধীরে ধীরে
গ্রাস করছে
সন্দেহ আর অবিশ্বাস
অভিবাসীর অভিশাপ (৫)
প্রতিটি অভিবাসী যেন
‘দেশপ্রেম’ শব্দটি ভুলে যায়
প্রতিটি অভিবাসী যেন
ঘামের মত মুছে ফেলে
‘জন্মভূমি’ নামক কাতরতা
তাঁদের কলম থেকে
‘ভালোবাসা’র বদলে
‘ভুলে যাও’
কথাটির স্ফুলিঙ্গ
ছড়িয়ে যাক।
27.02.2015
গতকাল ফোন ধরে একাধিক বার মা বললো, (৬)
‘শোনো, লেখালেখি বন্ধ করো...’
কয়জনই বা মা-বাবার কথা শুনি!
মাকে বলি নাই—
মা, আমরা যা দেখি অনেক সময় সেটা আসল ঘটনা নাও হতে পারে।
আমি লেখক বা কবি নই (৭)
আমার কথায় ছন্দ নাই
নাই ধারাবাহিকতা
চোখের সামনে যখন যা আসে
সে কথাই বলি
বলে যাবো শেষ পর্যন্ত
শুধু এই আশায়
কারো না কারো জীবনের সাথে
এসব কথা মিলে যাবেই।
খালি চোখে দেখলে অভিজিৎ আমার কেউ নয় (৮)
তাঁর লেখাও আমি পড়ি নাই
মায়ের চোখে দেখলে সে আমার সন্তান যে নাড়ীর টানে
ছুটে এসেছিলো সুদূর আমেরিকা থেকে
মায়ের সব সন্তান এক মত নিয়ে বড় হয় না
তবুও মা ভালোবাসে সন্তানকে
আমার নেটওয়ার্কে নানা মতের মানুষ আছে
যাদের কথা আমার ভালো লাগে না
আন-ফ্রেন্ড করতে গিয়ে ফিরে আসি বার বার
শুধু এই ভেবে সবার মত এক হবে এমন তো কথা নেই...
আমাদেরও একদিন হুমকি দেয়া হয়েছিলো (৯)
‘এবার ঢাকা থেকে আসলে, ওকে ফিরে যেতে দেয়া হবে না...’
ওকে ফিরে যেতে দেয়া হয় নাই
টাকা খেয়ে বুকে গুলি চালিয়েছিলো
ওরই ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা...
প্রাতিষ্ঠানিক বিচার থেকে রক্ষা পেলেও
প্রাকৃতিক বিচার থেকে রক্ষা পায় নি কেউ ই
পাবে না কেউ কোনোদিন ই ...
সময় মত মাকে বলতেও বারণ করেছেন বাবা (১০)
তাঁর কথা ছিলো --
‘দেশে আসার কথা শুনলে তোমার মায়ের
আনন্দ উত্তেজনা দেখে মানুষ জেনে যাবে তুমি দেশে আসছো...’
বাবা’র ভয় ছিলো চোর ডাকাতের
এখন ডিজিটাল যুগ, সব খবর মানুষ নিজেরাই জানিয়ে দেয়
‘আমি ফ্লাই করছি...আমি বই মেলায় থাকছি...’
নিরাপত্তা নিয়ে যাঁদের ভয় আছে তাঁদের সতর্ক থাকা আবশ্যক।
28.02.2015
আমার এই লেখার উৎস আমার দেয়া ৮ নং স্ট্যাটাস, অন্য স্ট্যাটাসের কমেন্টগুলো ভিন্ন রকম ছিলো কারণ খুব কাছের মানুষ ছাড়া আমার স্ট্যাটাসের কারণ কেউ হয়তো বুঝতে পারে নাই।
৮ নং স্ট্যাটাসে ‘অভিজিৎ’ শব্দটি উল্লেখ থাকায় আমাকে যে সব প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে তা এরকম --
কমেন্ট:
“যদি তাই হয়, প্রতিদিন অনেক অভিজিৎ রায়ের মৃত্যু হচ্ছে বাংলাদেশে তাদের নিয়ে তো কখনো তেমন করে ভাবতে দেখিনি। আজ যারা এক অভিজিৎ রায়ের জন্য এত ভাবছে। এক অভিজিৎ রায়ের ভাবনা দেখে অনেক প্রশ্ন মাথায় আসে।”
রিপ্লাই:
একটা মৃত্যুকে আরেকটা মৃত্যুর সাথে তুলনা করি না বা করতে পারি না। সব মৃত্যুই কষ্টের,...। এই কষ্ট নিয়ে ভাবে অনেকেই হয়তো আপনি আমি দেখি না, হয়তো মিডিয়াতে আসে না এই যা। আশা করছি এর তদন্তের ভার আমেরিকা নেবে মানুষ দেখতে পাবে প্রকৃত ঘটনা।
কমেন্ট:
“প্রতিদিন একইভাবে অনেকে মারা যাচ্ছে। কেউ মারা যাচ্ছে পুলিশের ৫৭ টি বুলেটের আঘাতে, কাউকে ধরে নিয়ে শরীর থেকে অঙ্গ আলাদা করে কষ্ট দিয়ে মারা হচ্ছে। ম্যাডাম আজকের পত্রিকায়ও এমন কয়েটা আছে, গত কালকের পত্রিকায়ও আছে আর আগের পত্রিকায়ও আছে। আপনারা আসলে তাদের দেখেন না, দেখেন নাম আর নাম কে। এর চেয়ে বেশি কিছু আপনাদের দিয়ে হয় না। আপনাদের মানে যারা শুধু একজনের মৃত্যু তে দুই দিন থেকে ক্রন্দনরত। আপনারাও পারেন বৈকি।”
রিপ্লাই:
আমি আমার কথা বলে দিয়েছি, ...। আপনি যে আমাকে জিজ্ঞাসা করছেন না তাও বুঝতে পেরেছি...আমাদের প্রত্যেকের চোখ এবং দেখা আলাদা।
কমেন্ট:
“রাজীবকেও একইভাবে হত্যা করা হয়েছিল, তার মৃত্যুর পরে সে লাশের উপর জাতীয় খেতাবও পেয়েছিল। যারা সেই খেতাব দিয়েছিলেন আবার তারাই সেই খেতাব তার উপর থেকে উঠিয়ে নিয়েছিলেন। রাজীব হত্যার মধ্য দিয়ে কিছুদিন আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল (কিছু মানুষের বিকৃত মস্তিষ্কের ব্যবসা স্বরূপ) তারপর ব্যবসা শেষ, রাজীব সাবজেক্টও ক্লোজ। আশা করি অভিজিত রায় এর মৃত্যু নিয়েও ব্যবসা শুরু হয়ে যাবে। কিছুদিন চলবে তারপর স্বার্থ ফুরলেই অভিজিত রায়ও ক্লোজ সাবজেক্টে স্থান পাবে।
অভিজিত রায় ছিলেন একজন মানুষ, একজন বাংলাদেশী। ঠিক তেমনি অন্যরাও একজন মানুষ, একজন বাংলাদেশী। আমিও একজন মানুষ, আমিও একজন বাংলাদেশী। আমিও আর সবার মতন স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই। কিন্তু কে দেবে? এইটুকু আমার দাবি। এর চেয়ে বেশি না। সবার বাঁচার অধিকার আছে। সবাই বাঁচতে চায়। শুধু একজন না।”
রিপ্লাই:
আমি কিছু বুঝতে চাই না, শুধু চাই একটা মাও যেন তার সন্তান না হারায়...
কমেন্ট:
“আরেকটা কথাও সবার মনে থাকা উচিত- সব লেখকই মুক্ত-মনা হয় কিন্তু যারা অপরের ধর্মীয় চেতনাকে সম্মান দিতে জানেনা তারা হয় সংকীর্ণ-মনা। যাইহোক, সবাই বাঁচার অধিকার আছে, সবাই বাঁচুক। সকলে মিলে পৃথিবীটাকে সুন্দর করে গড়ে তুলুন।”
কমেন্ট:
“Sobai ke niyei to aamra, amader porimondol”
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা মার্চ, ২০১৫ সকাল ৭:৩৩