মেয়েটির নাম যখন সুবর্ণা রাখা হয়েছিল, তখন কে ভেবেছিলো যে, সে বড় হয়ে এত কালো হয়ে যাবে। তার বড় দুবোনের নাম অনন্যা ও সুকন্যা। তাদের নামের সাথে মিলিয়ে পিতা ছোট মেয়েটির নাম সুবর্ণা রাখেন।
বেশ জমকালো অনুষ্ঠান করে বনেদী ঘরে, বড় রূপসী দুমেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। এখন ছোট মেয়েটির বিয়ের নীরব দুশ্চিন্তায়, পিতা-মাতার দু নয়নের ঘুম হারাম হয়ে গেছে।
যে মেয়ে অতি কালো, তার সাথ পরিচিত হতেই সবাই তার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে উদ্বিগ্নতা প্রকাশ করত। সে যে সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি, তার নিজের এতে কোন হাত নেই। তা কেউ বুঝার চেষ্টা করত না। সে যে তার পিতার ঘরের অভিশাপ তা সে ছোটবেলা থেকে বুঝে নিয়েছিল। ফলে, সে সদা সবার চোখ থেকে নিজেকে আড়াল করে রাখত। ভাবত, সবাই আমাকে ভুলে যাক। কিন্তু পিতা-মাতার মনে সে সবসময় জাগ্রত ছিল।
মূলত, সুবর্ণার মাতা তাকে নিজের পেটের দোষরূপে দেখতেন। কারন, মায়েরা নিজের মেয়ের অসম্পূর্ণতাকে নিজের লজ্জার কারন ভাবেন। যা ছেলেটের ক্ষেত্রে তারা কখনই ভাবেন না। বরং, পিতা হিমেল সুবর্ণাকে অন্য মেয়েদের চেয়ে বেশী ভালবাসতেন। কিন্তু, মাতা সুবর্ণাকে নিজের গর্ভের কলঙ্ক ভেবে, তার উপর যথেষ্ট বিরক্ত ছিলেন।
সুবর্ণার বাহ্যিক অবয়বে রূপের লেশমাত্র নেই। তার শরীর ছিল শীর্ণকায়, খাবার গ্রহণের প্রতি তার খুব এক আগ্রহ ছিল না, ওর রং ছিল খুব কালো, চ্যাপ্টা মুখ, নিষ্পাপ ঘোলেটে দু'চোখ, রুক্ষ চুল, গেজ দাত, অবিন্যস্ত শারীরিক গঠন। য কখনও কাউকে বিন্দুমাত্র আকর্ষণ করত না। ওর বাহ্যিক অসৌন্দর্যের জন্য ও কোনভাবেই দায়ী নয়। ওকে সৃষ্টিকর্তা এভাবেই সৃজন করেছেন। এমনকি ওর কন্ঠস্বরও কর্কশ। ফরে ওর মোলায়েম মিষ্টি কথাগুলো কানে তীরের মত এসে বিদ্ধ হত। সুবর্ণার একটা সরল ও সুন্দর মন ছিল। যা কেউ দেখতে পেত না, করত না অনুভব। সুবর্ণার রান্নার হাত পাকা চিল, সূচীকর্মে ওর পারদর্শিতা চোখে পড়ার মত। ভাবনায় সুবর্ণা স্বপ্নের জাল বুনত, একদিন সাদা পৃথিবীর কালো মানুষেরা সমগ্র পৃথিবী পরিচালনা করবে। লেখাপড়া না জানলেও প্রতিটি বিষয়ে ওর ধারন ছিল স্বচ্ছ স্ফটিকের ন্যায়। অসুন্দরী হবার গভীর দুঃখ ওকে সদা বিষন্ন করে রাখত। ওর দু'আখিতে সর্বদা টলটলে জল খেলা করত। সে দেখতে বেশী বিশ্রী বলে কেউ ওর সাথে বন্ধুত্ব করতে চাইত না। বন্ধুহীন অভিশপ্ত প্রহর কাটত সুবর্ণার। ওর সাদা মনটির খবর কেউ নিত না।
গ্রামের নাম মুনিয়া পুকুর। রংপুর জেলার একটি গ্রাম। পাশেই কলকল শব্দে করতোয়া নদী বয়ে চলেছে আপন গতিতে। হিমেলের বাড়ী নদীর সম্পূর্ণ উপরে। চৌচলা বড় ঘর। ঘোয়ালঘর, খরের স্তুপ, পেঁপে, আম, লিচু ও নেপালী সাগরকলার বাগান যে কারো নজর কাড়ে। কিন্তু সুবর্ণা কারো দৃষ্টি কাড়তে সমর্থ হয় না। কর্মে অতি সুনিপুণা সুবর্ণা। ঘরের কাজ শেষে নদীর পাড়ে বসে নদীর নয়নাভিরাম দৃশ্য অবলোকন করে। এক ঝাঁক বকের উড়ে যাওয়া, পাল তোলা সাম্পান, লঞ্চ, ট্রলারের গতিপ্রবাহ এবং উদাস মাঝির কন্ঠে সুরের খেলা দেখে সে নিবিষ্ট চিত্তে। আর এতে এক অদৃশ্য তৃপ্তিতে ভরে উঠে তার মন।
সুবর্ণার যে কিছু বন্ধুরা ছিল না তা সঠিক নয়। গোয়ায়ের দুটি কালো গাড়ী তাদের নাম নিমু ও ঝিমু। তাদের খুব যন্ত নিত। ভালবেসে তাদের কাছে টেনে নিত। তাদের গায়ে আদরে হাত বুলত। তারও তাকে খুব ভালবাসত। তাদের নাম ধরে ডাকলেই তারা ওর কাছে হাজির হত। গোয়ালঘরে যখন-তখন ঢুকত সুবর্ণা। গাড়ীদের সে আদর করত, বকা দিত, প্রয়োজনে মারত। তারও এতে একটুও অসন্তুষ্ট হত না। বরং, ওর দিকে অবাক নেত্রে গাড়ীরা অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে রইত। তাদের সাথে সুবর্ণার ছিল গভীর ভাব। একটি বড় কালো বিড়াল সারাদিন ওর চারপাশে ঘুরে বেড়াত। দুপুরে ও রাসেত সুবর্ণার পাশে ঘুমাত। সেও বিড়ালটির গায়ে পরম আদরে হাত বুলিয়ে দিত। বিড়ালটি ছিল ওর অনুগত। আসলে কালোদের প্রতি অবজ্ঞা, সুবর্ণার মনে কালো জীবনের জন্য আকর্ষণ আরো বাড়িয়ে দিয়েছিল। ওদের ভালেবেস এবং নিজে ওদের ভালবাসায় সিক্ত হয়ৈ, ওর সরলম মনটি পরম তৃপ্তিতে ভরে উঠল।
সুবর্ণার বয়স ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলেছে। যৌবনের পূর্ণতা ওর উপর সম্পূর্ণরূপে ভর করেছিল। যা সে নিজের খুব ভালভাবে বুঝতে পারছিল। নিজেকে এখন তার রহস্যময় লাগছিল। সৃষ্টিকর্তা তাকে ফর্সা ও আকর্ষণীয়া করে তৈরী করলে হয়তো স্বাসীর ঘরে সুখে ঘরকন্না করত। ওর সুখের সংসার নামক বাগান ফুলে ফুলে পূর্ণ থাকত। নিজের বাহ্যিক অসৌন্দর্যের জন্যওর নিজের ওপরই রাগ হচ্ছিল। আর কিছুক্ষণ পর গভীর দুখে সুবর্ণার দু'নয়নে অশ্রুবানে ভেসে যাচ্ছিল।
এদিকে কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা-মাতা মহা চিন্তিত হয়ে উঠেছেন। নানা লোকে নানা কথা বলতে শুরু করেছিল। যা তাদের সহ্যের সীমা পেরিয়ে যাচ্ছিল। হিমেল অবস্থাসম্পন্ন ব্যক্তি, তিন বেলাই ভাল খার খায়। এজন্য চারদিকে তার শত্রুর অভাব ছিল না। হিমেল ও তার স্ত্রী অনেক আলোচনা করে কিছুদিনের জন্য হিমেল রংপুরের বাইরে গিয়ে আবার ফিরে এসে বলল, চল ঢাকায় চল।
খুব দ্রুত তারা সবাই ঢাকা চলে গেল। সুবর্ণাকে জোর করে ঢাকা নিয়ে আসা হল। ঢাকার এক বাসায় সুবর্ণার মা একদিন সুবর্ণাকে চোখ ধাঁধানো সুন্দর শাড়ী খুব পরিপাটি করে পরিয়ে দিলেন। মাথায় টেনে দিলেন লম্বা ঘোমটা। সুবর্ণা কাঁদতে কাঁদতে বুক ভাসাচ্ছিল। মায়ের অজস্র বকুনীতেও সে তার কান্না সংবরণ করতে সমর্থ হলনা।
বর গুরুজন নিয়ে যতাসময়ে উপস্থিত ছিল। কন্যার মা-বাবা দুশ্চিন্তায় ভরাক্রান্ত। যেন তারা কোরবাণীর পশু দেখে এবং বেছে নিতে এসেছেন। মাতা অনেক শাসন করে মেয়ের কান্না থামাতে পারলাম না। কন্যাকে কুব লাজুক প্রকৃতির বলে ঘোমটা খুলতে দিলেন না কন্যার মা। কন্যার অবিরত কান্না শুনে বরপক্ষ কনের সরল মনের পরিচয় পেল। ভাবল, আজ পিতা-মাতার ত্যাগে শোকে কাঁদছে। কাল স্বামীর সায়িক বিচ্ছেদেও কাঁদবে। বরপক্ষের কন্যাকে ভালভাবে পরীক্ষা না করেই পছন্দ হয়ে গেল এবং শুভ দিনে ধুমধাম করে সুবর্ণার বিয়ে সুসম্পন্ন হল। অসুন্দরী মেয়েকে পরের হাতে তুলে দিয়ে পিতা-মাতা হলে নিশ্চিন্ত। এবার তারা রংপুরের মুনিয়া পুকুর গ্রামে ফিরে গেলেন। সমাজে তাদের মুখরক্ষা হল।
বর কন্ট্রাক্টরী করে ভালো আয় করত। সুবর্ণাকে বিয়ে করে ঘোরের মধ্যে কিছু সময় খুব সুখেই কাটছিল সুবর্ণার বরের। সুবর্ণার প্রেমে তখন সে হাবুডুবু খাচ্ছিল। অন্যদিকে সুবর্ণা এত সুখ কোথায় রাখবে ভাবছিল। কিন্তু কপালে তার বেশী দিন সুখ সইল না। বিয়ের একমাস যেতে না যেতেই বরের বাড়ীর সবাই বুঝল নববধূ খুব কালো। তার শরীরে রূপ বলতে কিছুই নেই। কেউ বুঝল না এটা তার দোষ নয়। সৃষ্টিকর্তা-ই তাকে এরূপ করে সৃষ্টি করেছেন। সুবর্ণার পাকা হাতের রান্না, নয়নাভিরাম সূচীকর্ম এবং গৃহকর্মের নৈপুন্য কাউকে মুগ্ধ করতে পারল না। তার সব গুণাবলী তার কুরূপের আড়ালে ঢাকা পড়ে গেল। সুবর্ণার সরল ও সুন্দর মনটির কোজ কেউ নিল না। বরের সাময়িক ঘোরও কেটে গেল। চিরকাল তার ভিতরটা কান্নায় ফেটে পড়ত- যা সৃষ্টিকর্তা ছাড়া কেউ খেয়াল করত না।
এবার সুবর্ণার স্বামী ভালভাবে পরখ করে, সদ্য ফোটা গোলাপের মত, পরমা সুন্দরী এক কন্যাকে বিয়ে করে ঘরে নিয়ে এল।