somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্পঃ খসে পড়া শব্দ যত

০৪ ঠা জুলাই, ২০১৫ বিকাল ৫:২৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

'আমরা এখন চলে যাব আমাদের সহকর্মী আহসানের কাছে, যিনি বর্তমানে ঘটনাস্থলে উপস্থিত আছেন। আহসান, আহসান, আপনি শুনতে পারছেন আমার কথা?'
-'জি মিমি, আমি শুনতে পাচ...পাচ...পাচহি আপনাকে।'
'আপনার চারিপাশে কি ঘটছে, বিশেষ কিছু কি দেখতে পেয়েছেন আপনি?'
-'আসলে পুলিশ ঘেরাও করে রেখেছে ঘটনাস-স...ঘটনা...ঘটনাস-হল, মানে জায়গাটা; কাউকে ঢুকতে বা কথা বলতে দিচ...দি-দিচ-হে না...'

তরুণ ফিল্ড রিপোর্টারের বিভ্রান্ত প্রতিক্রিয়া দেখে বুঝতে পেরেছিলাম। সকাল সকাল জোড়াখুনের খবর দিতে এসে আটকে যাচ্ছে বারবার। কেন আটকাচ্ছে নিজেও বুঝতে পারছে না বেচারা। তার মানে শুরু হয়ে গেছে ব্যাপারটা। কিছু করার নেই। টিভি অফ করে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম আবার।

লায়লা কল দিল দুপুরের দিকে।
'উঠেছ?'
-হুঁ।
'দেখেছ খবর?'
-হুঁ।
'আসলেই ঘটছে ব্যাপারটা, হ্যাঁ? খেয়েছ?'
-উহুঁ।
'বাসায় খাবার নিয়ে আসছি আমি। দুজনে একসাথে খাবো। তুমি ওঠো। হাত মুখ ধোও। ওঠো ওঠো!'
-এইতো উঠি। তুমি আসতে থাকো।

আর একটু ঘুমিয়ে নিতে চাইছিলাম। ঘুম এলো না। চটে গেছে। কিছুক্ষণ এপাশ ওপাশ করে উঠে পড়লাম। দাড়িগুলো কাটা দরকার। চুল উসকোখুসকো হয়ে আছে। রেজর, চিরুনি এইসব খুচরো জিনিস কই যে থাকে! গোসল করে নিলেই ভাল হবে মনে হয়। তারপর ঘরদোর গুছিয়ে, বিছানাটা ঝেড়েঝুরে ভদ্রস্থ করতে হবে। বাসায় মানুষ এলে ঝামেলার শেষ নাই।

লায়লা আসতে আসতে ড্রয়িংরুমের চেহারা পাল্টে ফেললাম। আশা করছিলাম আমার ঘরে ও ঢুকবে না। খেয়ে, টিভি-টুভি দেখে, সোফাতেই রেস্ট নিয়ে ভাগবে। কিন্তু যেখানে বাঘের ভয়। বাসায় এসে সোজা আমার ঘরে গিয়ে ঢুকল।
-কই যাও?
'কেন, গোসলখানায়!'
-রান-নাঘরের পাশে আরেকটা আছে। জানোই তো।
'ওটা নোংরা, আর পিচ-পিচ [আমি শব্দ ধরিয়ে দিলামঃ ছোট] হ্যাঁ, ছোট। অসস- মানে ভাল লাগে না।'

স্বস্তির ব্যাপার- ঘরের হাল দেখে সকৌতুকে ভুরূ বাঁকালেও, টিটকারি মারল না। ফ্রেশ হয়ে বেরোলে ওকে দেখলাম। এমনিতে মোবাইলে কথা হয় মাঝেমাঝে, কিন্তু অনেকদিন পর ভাল করে চর্মচক্ষে তাকিয়ে দেখলাম। একটু মুটিয়ে গেছে। বয়সের ছাপ কিছুটা পড়েছে মুখে। চোখ দুটো চঞ্চল। কিশোরীদের মতো মিটমিট করে উজ্জ্বল চোখে এদিক ওদিক চাইছে। আমার চেয়ে পাঁচ-ছ বছরের ছোট, তারমানে কম করে হলেও পঁয়ত্রিশ চলছে ওর। একেবারে খাঁটি মহিলা হয়ে গেছে! এই বয়সে এই চোখ কি মানায়?

আমরা খুচরো কথাবার্তা চালান করতে করতে খেলাম। ওদের এনজিও-টা সরকারি সাহায্য পাচ্ছে না। চাকরি ছেড়ে দেবে হয়তো। কয়েক জায়গায় এপ্লাই করেছে। হাত নেড়ে সাংকেতিক ভাষা বলতে জানে ও, সেটা সামনে অনেক কাজে দেবে। আমি ভার্সিটির প্রফেসারি ছেড়ে দিয়েছি সেটা জানালাম। ও খাবার চিবুতে চিবুতে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর আস্তে করে বলল, 'কাগজপাতি নিয়ে এসেছি। তুমি চাও তো ব্যাপারটা সেরে ফেলি, নাকি...'

ডিভোর্সের পেপারগুলোর কথা বলছে। আমি নানা বাহানায় ঠেকিয়ে রেখেছি এতদিন। ওও তেমন জোর করে নি। আজ একেবারে বাসায় নিয়ে এসেছে কাগজ। কেন? টাকাপয়সা, জায়গাজমির ঝামেলা তো আমরা মিটিয়ে নিয়েছি শুরুতেই। অন্য কিছু তাহলে?

-আমার কথা বাদ দাও, তুমি কি চাও? কাউকে ভাল লেগেছে ইদানিং?, আমি স্থূল রসিকতার চেষ্টা করি।

ব্যর্থ চেষ্টা। কথাটা লেগেছে ওর। চোখ ফিরিয়ে নিয়ে লায়লা টিভি ছাড়ে। মুহূর্তেই কথার বিষয়বস্তু পাল্টে ফেলে। ডিভোর্সের কথা যেন ওঠেইনি কোন কালে, এরকম ভাব ধরে আমরা নতুন উপদ্রব 'ধ্বনি-বিপর্যয়' নিয়ে কথা বলতে থাকি। এই অদ্ভুত ব্যাপারটা শুরু হয়েছে ক'বৎসর আগে। হঠাৎ একাধিক ভাষা জানা ব্যক্তিরা আবিষ্কার করলেন, তারা মাতৃভাষা ছাড়া বাকি ভাষাগুলো ধীরে ধীরে ক্রমান্বয়ে ভুলে যাচ্ছেন। জিনিসটা শুরু হয় একটি শব্দ দিয়ে, দেখা যায় তিনি সেটি আর মুখস্ত বা উচ্চারণ করতে পারছেন না। চেষ্টা সত্ত্বেও পুনরায় শিখতে পারছেন না। তারপর আরেকটি শব্দ। তারপর আরেকটি। এভাবে শয়ে শয়ে ভাষার মৌখিক রূপ ক্রমশ সংকীর্ণ হয়ে হারিয়ে যাচ্ছে, এবং সেই সাথে ক্রমান্বয়ে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে তাদের লিখিত রূপ। ভয়ের ব্যাপার হল, এটা যারা একাধিক ভাষা জানেন- তাদের দুএকজনের ক্ষেত্রে নয়, বরঞ্চ তাদের সবার ক্ষেত্রেই ঘটছে। একটা বিশ্বজনীন আতঙ্ক।

সম্ভাব্য কারণ নিয়ে অনেক মাথা ঘামাঘামি হল। বিজ্ঞানীদের একটি অংশ বললেন, হয়ত কোন ভাইরাস মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট অংশে আক্রমণ করছে, এজন্যে স্মৃতি ও বাচনশক্তি নিয়ে এমন সমস্যা হচ্ছে। কিংবা হয়তো তেজস্ক্রিয়তায় মিউটেটেড কোন জীবাণুর আক্রমণ। গত কয়েক বছরে নিউক্লিয়ার রিএকটর নিয়ে দুর্ঘটনা ঘটেছে অনেকগুলো, হতেও পারে। হয়তো জিনিসটা বিজ্ঞানের কুফল। কেউ বললেন, না, প্রকৃতির অভিশাপ। কেউ বললেন, ঈশ্বরের। বহু তত্ত্ব এল, বহু গুজব রটল, কিন্তু সমাধান মিলল না। দিন-মাস-সপ্তাহ কেটে যেতে লাগল, তারপর পেরিয়ে গেল বছর। আসলে প্রক্রিয়াটা চোখের পলকে ঘটে না, সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। ঘোড়া না দাবড়িয়ে খুনি যদি শামুকের পিঠে চড়ে আক্রমণ করতে আসে- তবে বিপদটাকে খুব একটা ভয়ানক বলে মনে হয় না, বাস্তব যা-ই হোক না কেন।

এক সময় আমরা অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, ব্যাপারটা গায়ে সয়ে গেছে। মানুষের অভিযোজন ক্ষমতা অসাধারণ, একটি মাত্র ভাষার সীমিত ব্যবহার নিয়েই আমরা স্বচ্ছন্দে জীবনযাপন করতে শুরু করেছি। বিপদ হল আমার মত কিছু মানুষের। ইংরিজি পড়াতাম ভার্সিটিতে, বুঝতে পারছিলাম ক্রমশ ভুলে যাচ্ছি ভাষাটা। একদিন ক্লাস নিচ্ছি, বোর্ডে লিখছিলাম, হঠাৎ লক্ষ্য করলাম বোর্ডে নিজের লেখা কিছুই বুঝতে পারছি না। বিজাতীয় আঁকিবুঁকি মনে হচ্ছে। কি পড়াচ্ছিলাম সেটাও মনে করতে পারলাম না। নাটক মনে হয়। ষোড়শ শতাব্দীর এক লেখকের। খুব বিখ্যাত ছিল ব্যাটা, নাম যেন কি?

পরবর্তী কয়েক ঘণ্টায় অনেক চেষ্টা করেও যখন ইংরিজির কিছুই মাথায় আনতে পারলাম না, নিজেকে ফালতু মনে হতে লাগল। ইস্তফা দিয়ে এসে পড়লাম। অযথা ছাত্রদের সামনে অপদস্থ হবার কি দরকার!

যাকগে ওসব কথা। এরপরে প্রশ্ন উঠল- পরের ধাপটা কি? মানুষ কি নিজের মাতৃভাষাও ভুলে যাবে একসময়? আমরা আমাদের সমস্ত সভ্যতা, আধুনিকতা নিয়ে নিঃশব্দে বসে থাকব, পাশের জনের সাথে একটা নিকৃষ্ট জন্তুর মতো কথাও বলতে পারব না? গবেষকরা বললেন- এটা শুরু হবে ধীরে ধীরে। হয়তো আজই, হয়তো আগামি সপ্তায়, আগামি মাসে, এক বছর কি দশ বছর পর। কখন তা ঠিক করে বলা যায় না। কিন্তু শুরু হবেই। প্রথমে মানুষ হয়তো যুক্তাক্ষরগুলো কিভাবে উচ্চারণ করতে হয় সেটা ভুলে যাবে। নির্ভর করে ভাষার গঠনের ওপর। তারপর একটা একটা করে শব্দের পালা। তারপর একটা সময়, নৈঃশব্দ্য নেমে আসবে সবখানে। আমরা আদিম মানুষের মত ইঙ্গিতে কথা কইব, ইশারায় গাল দেব, ভুলে যাব শব্দের ব্যবহার।
-সেই ধাপটাই শুরু হল আজ, বুঝলে? মানবজাতির জন্যে ভয়ানক একটা দিন - আমি লায়লাকে বলি।
'কিসের ভয়ানক! বাইরের পরিবেশ দেখেছ? আকাশ দেখেছ? কতদিন এরকম তরল রোদ ওঠেনি বলো দেখি!'
-কথা বলতে না পারাটা তোমার কাছে ভয়ানক লাগে না?
'লাগে। তাই বলে ভয় আঁকড়ে ধরে পড়ে থাকব? সময়ের সাথে সব পাল...প-পাল মানে বদলায়, আসিফ। মানুষও বদলে নেবে নিজেদের।'

খাওয়া শেষে লায়লা উঠে পড়ল। ডিভোর্সের পেপারগুলো ব্যাগে ভরে চুল ঠিকঠাক করতে লাগল।
'উঠি আসিফ। মা বাসায় একা। দুশ... ভাববেন দেরি হলে।'
-আবার আসবে কবে?
ওর চোখ নরম হয়ে আসে, 'আজ তোমায় দেখতে এসেছিলাম, ঠিক আছ কিনা। তা তো ভালই আছো।'
-আবার আসবে কবে? গোঁয়ারের মত পুনরাবৃত্তি করি কথাটা।
'আর আসব না আসিফ। এখানে এলে আমার দম বন...বন...বনহ [আমি ঘাড় নেড়ে বোঝালাম যে বুঝতে পেরেছি কি বলতে চাইছে] হয়ে আসে। পুরনো কথা মনে পড়ে যায়।'
আমি চুপ করে থাকি।
'আর ভাল কথা, সোমবারে আমি বাসায় থাকব। এসে তোমার ডায়েরিগুলো নিয়ে যেও। ধুলো জমছে ওগুলোর গায়ে। আসি তাহলে।'

লায়লা চলে গেলে আমি টিভি দেখতে থাকি অন্যমনস্ক হয়ে। ডায়েরির কথাও তুলল অবশেষে! বারো বছর বয়েস থেকে আমি ডায়েরি লিখতাম। আব্বা খুব উৎসাহ দিতেন। 'লেখ লেখ, বড় হয়ে দেখবি এগুলো কত বড় সম্পদ মনে হবে।' ওই বয়সে অনেকেই লেখে ডায়েরি। ছয়মাস-এক বছর লিখে বাদ দিয়ে দেয়। আমি বাদ দিইনি। কৈশোরের ওই সময়টার কথা অম্লান বদনে লিখে গেছি। ডায়েরি চুরি করে পড়বে এমন কেউ ছিল না আমাদের পরিবারে, সুতরাং সত্য লিখতে আটকায় নি। করোটির ভেতরে যত সুন্দর এবং কুৎসিত এবং অন্যান্য চিন্তা ছিল, তার প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠছিল ডায়েরিতে। তারপর যুবক হলাম, স্কুল কলেজ পেরিয়ে ভার্সিটিতে উদ্দাম একটা সময় কাটল। সবই লিখতাম। আমার একান্ত ভাবনা, ভয়, ক্ষোভের কথা; কাকে ভাল লাগে, কি ভাবি, কি করলাম, কি করব- সব। রেজাল্ট ভাল ছিল, পাস করে বেরিয়েই চাকরি পেয়ে গেলাম। আম্মা বিয়ে করানোর জন্য জান লড়িয়ে দিতে লাগলেন। অবশেষে মাসছয়েক পর হার মেনে বললাম- যাও, করব বিয়ে। মেয়ে খুঁজে নিয়ে আসো।

লায়লাকে পছন্দ করেছিলাম নাম শুনে। লায়লা। রাত্রি। নিশি। রহস্যময়ী নাম। ছবি চাইলাম ঘটকের কাছে। দেখলাম- ওর ছবিটাও অন্যরকম ছিল, অন্যদের মতো স্টুডিয়োতে তোলা নয়। কারো বিয়েতে গিয়েছিল, তখন তোলা হয়েছে। চুল পেছনে নিয়ে বড় খোঁপা করে বাঁধা, সবুজ-নীল শাড়ি, হাতে একটা মেয়েলি ঘড়ি। ঘাড় ঘুরিয়ে হাসছে। এটাও ব্যতিক্রম, এমনিতে ছবির বাকি মেয়েরা সেজেগুজে বড় বড় ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে থাকত আমার দিকে। আম্মাকে বললাম, চলো, মেয়ে দেখে আসি। আমরা তখন গুষ্টিসুদ্ধু আলিফ লায়লা নিয়মিত দেখি, মামাত-চাচাত ভাইয়েরা খ্যাপাতে লাগল 'আসিফ লায়লা/ আসিফ লায়লা/ আসিফ লায়লাআআআআ' গাইতে গাইতে।

এরপর যা করার বাকিরাই করল। আমি খালি কয়েকবার হবু শ্বশুরবাড়ির লোকের সাথে কথা বললাম, গায়ে হলুদ মাখানোর সময় মুখ কুঁচকে রইলাম, বিয়ের সময় কিছু নির্দিষ্ট শব্দ উচ্চারণ করলাম। তারপর অনুষ্ঠান শেষে ঘরে ঢুকে বুঝতে পারলাম, বিছানার মাঝখানে বসে থাকা অপরিচিত এই মেয়েটিকে আমি সত্যিই, একেবারে কলমা পড়ে আপাদমস্তক বিয়ে করে ফেলেছি। বুকের ভেতরে আছড়ে পড়ছিল সাগরের ঢেউ, কথা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। এখন বুঝতে পারি, সদ্য বিবাহিত লায়লা নিশ্চয়ই সে রাতে স্বামীটির কাজকর্ম দেখে ভড়কে গেছিল। কই লোকটা কাছে এসে বসবে, রোমান্টিক কিছু বলবে, তা না করে গাদা গাদা নোটবুক এসে বিছানায় রাখছে। পাগল নাকি! আসলে ঘাবড়ে গেছিলাম। আমাকে, ভেতরের ঘুণে কাটা শ্যাওলাধরা আসল আমাকে কিভাবে চিনবে মেয়েটা? কিভাবে বুঝবে আমি কেমন মানুষ? এক সাথে বছরখানেক কাটিয়ে যদি বলে আর সহ্য করতে পারছে না, তখন? তার চেয়ে এভাবেই পরিচয় হোক। পনেরটা নোটবুক বিছানায় রেখে বলেছিলাম - এই দ্যাখো। এইটেই আমি। পড়ে দ্যাখো। তারপর তুমি বলবে, আমরা স্বামী-স্ত্রী থাকব কি থাকব না।

বিশাল বোকামি ছিল কাজটা। বিয়ের প্রথম রাতে কি কেউ স্বামী-স্ত্রী হয়ে থাকা না থাকার কথা বলে? কিন্তু জীবন-সঙ্গিনীর কাছে নিজেকে তুলে ধরার এরচে ভাল উপায় খুঁজে পাইনি তখন। পরবর্তী একটা মাস চরম অস্বস্তি নিয়ে কাটালাম। দুজনে একই বিছানায় শুই, এক কাতে রাত পার করে দিই। লায়লা রাত জেগে অনেক সময় ডায়েরি পড়ে। অনেক সময় হাসে। আবার মুখ গম্ভীর করে পড়ে যায় নিঃশব্দে, কথা বলে না। তখন আমি মনে মনে বের করার চেষ্টা করি- কোন অংশটা পড়ছে। ওর দিকে মুখ ফেরাতে সাহস হয় না।

তারপর থেকে আমাদের সম্পর্কটা কেমন যেন আশ্চর্যরকম সহজ হয়ে গেল। এমন একজন মানুষ পেলাম, যে আমার সবটাকেই চেনে, কিন্তু আমি তাকে চিনতে শুরু করেছি কেবল। লায়লার তুমি তুমি ডাক শুনতে অদ্ভুত আনন্দ লাগত বুকে। আমরা ঘনিষ্ঠ হতে লাগলাম। লায়লা আর আমি রাত জেগে কথা বলি। ওর ছোটবেলার কথা, ওর আত্মীয়-স্বজনের গল্প। কিভাবে পা পিছলে একবার ঘাটে পড়ে গেছিল, ছোট বোনদের সাথে কিরকম ঝগড়া করত। হাত পা নেড়ে নেড়ে নানান মুখভঙ্গি করে কথা বলতে দেখে আমি হাসি আটকাতে পারতাম না। ও রেগে যেত, 'এইই, হাসো কেন? জানো হাঁটুর ওপরে কতটুকু ছিলে গেছিল? এই যে এখনও কালো দাগ হয়ে আছে।'

আমি প্রেমে পড়ে যাচ্ছিলাম।

মোবাইল বেজে উঠল হঠাৎ। স্ক্রিনে নাম দেখলাম- হাসান কল দিয়েছে। ওকে অবশ্য আমিই কল দেবার কথা ভাবছিলাম, পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নিচ্ছে জানার জন্যে। এরকম অবস্থায় একজন শব্দবিজ্ঞানীর গুরুত্ব অনেক। রিসিভ করলাম। হাসানের গলা কাঁপছে, তার মধ্যে অনেক শব্দ উচ্চারণ করতে পারছে না। কথা শেষ করতে অনেকক্ষণ লাগল।

হাসান বলছে- ওদের ইন্সটিটিউটে গবেষকরা পাগলের মত হয়ে যাচ্ছেন। তারা , কিন্তু মানুষের শব্দ ভুলে যাবার হার বের করে ফেলেছেন। তারা বলছেন, আর সর্বোচ্চ এক সপ্তা, তারপর মানুষ সম্পূর্ণ ভুলে যাবে যার যার মাতৃভাষা। অক্ষর চিনতে পারবে না। শব্দের অর্থ বুঝতে পারবে না। স্রেফ গুহাবাসী মানুষের মত অর্থহীন ধ্বনি উচ্চারণ করে যাবে। ও অবশ্য কল দিয়েছে অন্য কারণে। কিছু টাকা আর আমার গাড়িটা ধার চাইছে। দুই মেয়ে আর বউকে নিয়ে গ্রামে চলে যেতে চায়, অবস্থা খারাপ হতে শুরু করলে শহরে থাকাটা নিরাপদ হবে না। মানুষ এরকম অদ্ভুত পরিস্থিতিতে কি দিয়ে কি করবে কিছুই বলা যায় না। রাস্তায় আর্মি নেমে গেছে ইতোমধ্যে। জ্বালাও-পোড়াও-লুটপাট শুরু হয়ে যেতে পারে যেকোনো সময়। জবাবে কাল সকালে এসে টাকা আর গাড়ি নিয়ে যেতে বললাম। আমি কোথায়ই বা যাব, বউ নেই বাচ্চা নেই একা মানুষ; গাড়িটা শুধু শুধু পড়ে আছে গ্যারাজে। আরেকজনের কাজে লাগলে ক্ষতি কি?

আমারও হাসানের মত ফুটফুটে দুটো মেয়ে থাকতে পারত। লায়লা আমার পাশে থাকতে পারত। কিন্তু বাস্তব হল- তেমন কিছু ঘটে নি। গল্পে যেরকম ঘটে, একটা দিক শুধু দেখানো হয়। দুটো মানুষ কাছাকাছি আসে, ভালবাসে, তারপর চিরকাল সুখে শান্তিতে বসবাস করতে থাকে। আসলে কি তাই ঘটে? আলোর পেছনে আঁধারের কথা কেউ বলে না। একটা মিষ্টি কথা হলে তিক্ত শব্দ ছোঁড়াছুঁড়ি হয় দশটা, প্রেমিক মন জেগে ওঠে হয়তো একদিন, আর বাকি মাসে সেই একই রসকষহীন বস্তুবাদি মানিয়ে চলা জীবন। এই একঘেয়েমি থেকে মুক্তি পেতে অনেকে বাচ্চা নেয়। তখন হঠাৎ দেখা যায়, প্রেমিক-প্রেমিকা জামাই-বউ বলতে কারো অস্তিত্ব নেই। কেবল আছে বাচ্চার মা-বাচ্চার বাপ নামক দুইটি বিভ্রান্ত-চিন্তিত প্রাণী। আকণ্ঠ চিরন্তন প্রেমের কথা তখন কেউ বলে না, বরঞ্চ দিনের শেষে যারা মেজাজ ঠিক রেখে একে অপরকে সহ্য করে চলতে পারে- তারাই তখন প্রকৃত সফল দম্পতি। আমি আর লায়লা এরকম সফল দম্পতি হতে পারতাম। দিনশেষে দুজন বিছানায় এলিয়ে পড়ে একে অপরের বিরক্তির, ক্লান্তির কথা বলতাম। ঝগড়া করতাম। ভালবাসতাম। দুজনে মিলে একসাথে বেঁচে থাকতাম পৃথিবীতে। আমাদের তেমন শুভ সমাপ্তি হয় নি। হয়তো কিছু মানুষ থাকে, অভিশপ্ত। নইলে কেন বিয়ের দুই বছর পরেও আমাদের কোন বাচ্চা হবে না? কেন ডাক্তার এসে বলবে, আপনারা সন্তান নিতে পারবেন না?

ফ্যামিলি ডাক্তার তো, সরাসরি বলে নি কেন নিতে পারব না। দোষটা কি আমার? নাকি লায়লার? পরিষ্কার করে নি। এবং কি আশ্চর্য, আজ পর্যন্ত আমি জানি না অক্ষমতা কার ছিল। জানা কি খুব জরুরি? যদি আমার দোষ হয়, লায়লা কি আমাকে ছেড়ে চলে যাবে? কিংবা বিপরীত হলে আমিই কি ওকে ছাড়ব? কি হাস্যকর কথা! কি তুচ্ছ একটা ব্যাপার! আমরা বরঞ্চ একটা বাচ্চা দত্তক নেব। সে এসে আমাদের এই ক্ষুদ্র আণুবীক্ষণিক অক্ষমতা ভুলিয়ে দেবে, আমাদের সম্পর্কের অদৃশ্য ফাটলটাকে বুজিয়ে দেবে। বাচ্চারা ঈশ্বরের দূত, তারা কি না পারে!

অনেক খোঁজাখুঁজির পর, তেমন একজন দূত এসেছিল আমাদের দ্বারে। দেড় বছরের ফুটফুটে শিশু। সারাক্ষণ হাসছে। ওর হাসি দেখে অনেক দিন পর আমি লায়লাকে হাসতে দেখলাম। খুব সতর্ক হয়ে ও কোলে নিলো মেয়েটাকে, যেন তার শরীর ডিমের খোসা দিয়ে বানানো। ওর হাত কি ভীষণভাবে কাঁপছিল! আমরা দোকানে দোকানে ঘুরে ক্ষুদে ফেরেশতা-টার জন্যে কাপড় কিনলাম। দোলনা কিনলাম। ছোট ছোট জামা, প্যাম্পারস, পিচ্চি পিচ্চি জুতো, সেগুলো পরে হাঁটলে নাকি চিক চিক করে শব্দ হয়, আলো জ্বলে; কতগুলো প্লাস্টিকের খেলনা, দুটো টেডি বেয়ার, অনেকগুলো পুতুল- লায়লা তুমুল উৎসাহ নিয়ে কিনল ওসব। বাচ্চাটার মা একটা হাসপাতালের নার্স, বয়েস মাত্র একুশ। বাচ্চাটাকে রাখতে পারছে না বলে অনেকক্ষণ কান্নাকাটি করল লায়লাকে ধরে। বাচ্চার বাবা বিদেশে চলে গেছে, বছর কেটে গেলেও কোন খবর নেই। তাকে নার্সের কাজ করে সংসার চালাতে হয়, শ্বশুর-শাশুড়িকে দেখে রাখতে হয়; এমন অবস্থায় সে কি করে মেয়েকে সময় দেবে? লায়লাও তাকে ধরে কাঁদল। আমি একই সাথে দুজন নারী এবং তাদের হৃদয়ের ভেতরে চেপে রাখা ভিন্ন দুরকম ঝড় বয়ে যাওয়া দেখছিলাম। মাতৃত্বের এই রূপ দেখে নিজেকে বড্ড ছোট মনে হচ্ছিল। আমি কখনো কি আমার সন্তানকে এরকম করে ভালবাসতে পারব?

সময় একটা অনন্ত বৃত্তের মতো। একই ব্যাপার ঘুরে ঘুরে আসে। একবার। দু'বার। বারবার। দত্তক নেবার পর তিরিশ দিন সময় দেওয়া হয় বাচ্চার প্রকৃত মা-কে, এই সময়ে সে মন পরিবর্তন করলে অন্য পরিবারটি বাচ্চাকে ফিরিয়ে দিতে বাধ্য থাকবে। আমাদের বলা হয়েছিল এটা স্রেফ সম্মতিপত্রের কাগুজে একটা নিয়ম, বাস্তবে এরকম কেউ করে না। নার্স মেয়েটা ফিরে এলো আটাশতম দিনে। সারা মুখে আনন্দ ঝকমক করছে। তার স্বামী ফিরে এসেছে দেশে, এবং দত্তকের কথা শুনে তখনই তাঁকে পাঠিয়ে দিয়েছে মেয়েকে নিয়ে আসতে। সেদিন একই দৃশ্য পুনরায় অভিনীত হতে দেখলাম। বৃত্ত ঘুরে এসেছে এক পাক, চরিত্রগুলো উল্টে গেছে শুধু। বাচ্চাটাকে নিয়ে গেল যখন, খারাপ লাগছিল। মেয়েটাকে দোষ দিতে পারছিলাম না, কিন্তু মনে হচ্ছিল সুযোগ পেয়ে আমাদের খুব ঠকিয়ে নিয়েছে কেউ। তারপর অসহ্য লাগতে শুরু করল ঘরের শূন্য দোলনাটা দেখে। খেলনাগুলো দেখে। জুতোজোড়া দেখে- যেগুলো পরে হাঁটলে নাকি চিক চিক করে শব্দ হয়, আলো জ্বলে। এগুলোও দিয়ে দেওয়া উচিৎ ছিল। কি হবে রেখে? লায়লা একটা টেডি বেয়ার হাতে নিয়ে চুপ করে বসে রইল। স্থবির। নিশ্চুপ। কেউ কোন কথা বলিনি, কিন্তু দুজনেই বুঝতে পারছিলাম আমাদের সেই অদৃশ্য ফাটলগুলো কড়কড়-মড়মড় শব্দে বিস্তৃত হয়ে ধীরে ধীরে ভয়াল আঁধারে জমাট বেঁধে উঠছে।

দু'মাস পর আমাদের ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল। টিকিয়ে রাখার জন্যে আত্মীয়-স্বজনরা অনেক চেষ্টা করেছিল যদিও। আমরা যেন একসাথে থাকি, কেন আলাদা হয়ে যাচ্ছি, সম্পর্কে তো উত্থান-পতন থাকবেই, তাই বলে আলাদা হয়ে যাওয়া কি কোন সমাধান হল? দত্তক নেবার জন্যে আরও কতশত বাচ্চা পড়ে আছে, এই বোকামি করছি কেন ইত্যাদি ইত্যাদি বিভিন্ন কথা, আদেশ, অভিযোগ। কাজ হয় নি। লায়লা বিশ্বাস করত আমাদের সম্পর্কটা অভিশপ্ত, আমি এই যুক্তির বিরুদ্ধে বলার মতো কিছু খুঁজে পাই নি। সুতরাং পারস্পরিক বোঝাবুঝি নিয়ে পুরো ব্যাপারটা শেষ করে ফেললাম দুজনে। আমাদের মাঝে অবশ্য কোন তিক্ততা, গ্লানি ছিল না। বরঞ্চ আমি বলব অদ্ভুত একটা সহমর্মিতার প্রলেপে দুজন আবৃত হয়ে ছিলাম। আমি প্রফেসারিতে মন দিলাম, খাতা দেখা, ক্লাস নেবার মাঝে ডুবে গেলাম। লায়লা পথশিশুদের নিয়ে কাজ করে এরকম একটা এনজিওতে কাজ নিলো, এবং খুব দ্রুতই ব্যস্ত হয়ে পড়ল। হয়তো বাচ্চাদের নিয়ে কাজ করে ও মাতৃত্বের সেই শাশ্বত আনন্দের কিছুটা খুঁজে পেত। আমরা কথা বলতাম, মাঝে মাঝে। বেশিরভাগ সময় খোঁজখবর নিতেন আমার প্রাক্তন শাশুড়ি, লায়লার মা। ওনার সাথে দেখা হয় না অনেকদিন। সোমবার তাহলে যাওয়া যাক একবার। দেখা করে আসব। ডায়েরিগুলোও নিয়ে আসা যাবে এই ফাঁকে, তারপর বাসায় নিয়ে এসে পুড়িয়ে ফেলতে হবে। ওগুলোর প্রয়োজন ফুরিয়েছে।


***


লায়লা বাসাতেই ছিল। একা। বলল ওর মা-কে গ্রামে পাঠিয়ে দিয়েছে। শহরে গত কয়েক দিনে কারফিউ জারি করা হচ্ছে বিকেল ৫টার পর থেকে। তবুও মানুষের ক্ষোভ, আতঙ্ক কারফিউয়ের বাঁধ উপচে উপচে পড়ছে। ভেঙে যাবে যেকোনো মুহূর্তে। টিভিতে দেখলাম পুলিশ-সামরিক বাহিনী এরাও আর সরকারের নির্দেশ মানছে না। অর্ধেক শহর ছেড়ে পালিয়েছে, বাকিরা ইউনিফর্ম খুলে নেমে পড়েছে ইচ্ছেমতন লুটতরাজে। আসলে মানুষের ভেতরের অসুখি-অসামাজিক প্রাণীটা ভঙ্গুর একটা আবরণে নিজেকে লুকিয়ে রাখে। ঠিক জায়গায় সামান্য একটা টোকা দিলেই প্রাণীটা বের হয়ে এসে নরক নামিয়ে আনে পৃথিবীর বুকে। ওই ব্যাপারটাই ঘটছে এখন। এমন অবস্থায় মানবজাতির আদর্শ সংস্করণ কি করত? তারা নিজেদের নবীন এবং প্রাচীন সদস্যদের আগলে রাখত। নৈরাজ্যের মোকাবেলা করত শৃঙ্খলা দিয়ে, পশুত্বের বিরুদ্ধে লড়ত ভালবাসা দিয়ে, আর তাদের শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানিরা বাকি সময়টাতে চেষ্টা করত একটা সমাধান বের করতে। আর আমরা কি করছি? পালাচ্ছি। মুখোশ ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে পালাচ্ছি। কার কাছ থেকে? নিজেদের কাছ থেকে। গ্রামে যাচ্ছে এতো মানুষ, কি হবে গিয়ে? ওখানেও তো এরকম অবস্থা হতে পারে। কে জানে? হাসান, রাকিব, পল্লব- আমার বন্ধু, কলিগ সবাই শহর ছেড়ে গেছে গ্রামে। এরপরে কাউকে কল দিয়ে পাই নি। হয়তো মোবাইলের নেটওয়ার্ক সিস্টেম ভেঙে পড়েছে। কিংবা হয়তো ওদের সবারই খারাপ কিছু হয়েছে। হতে পারে না? নিরাপত্তা নেই কোন জায়গায়। আমি আজকে যে লায়লার বাসাতে এসেছি, তাও প্রচণ্ড রিস্ক নিয়ে। বাসার সামনেই একটা মোটরসাইকেলে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে মানুষ। আমি চুপি চুপি সিঁড়ি ধরে উঠে এলাম, দুই চারজন তখনো চেয়ে ছিল। বুক ধকধক করছিল, এরা যদি পিছু পিছু উঠে আসে? কি করব আমি? কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে, কেউ আসে নি। রাস্তার মাথায় আরেকটা গাড়ি থামিয়ে হৈচৈ করছিল। জানালা সরিয়ে একটু পরে দেখলাম আগুন লাগিয়ে দিয়েছে।

এরকম প্রতি রাতেই গাড়ি পোড়ায় একদল মানুষ। ইশারায় মশাল জ্বেলে ল্যাম্পপোস্টের নিচে আগুন জ্বালায়, দোকান ভাংচুর করে। এবং কথা বলতে না পারা সত্ত্বেও, তাদের প্রত্যেকটি অপরাধে একটা 'দশে মিলে করি কাজ' এর মত অস্বাভাবিক ভ্রাতৃত্ববোধ দেখা যায়। পোড়া ধাতুর গন্ধে তাদের অবাস্তব জীবনে একটু হলেও কি বাস্তবতা ফিরে আসে? বুনো দৃষ্টি তাদের চোখে, একটা সফল বিপ্লবের সৈনিকের মত তাদের হাবভাব। এখনো যে বাড়ি বাড়ি গিয়ে হামলা শুরু করে নি তাই আশ্চর্যের ব্যাপার। খুব দেরিও নেই হয়তো। হিংস্রতা মানুষের মাঝে খুব স্বচ্ছন্দে বেঁচে থাকে, বড় হয়। আমি অবস্থার যে এতো দ্রুত অবনতি ঘটবে তা প্রথমে বুঝতে পারিনি। অন্ততঃ লায়লাকে সাবধান করে দিতাম।
-মা-র সাথে তুমিও যেতে পারতে। যাওনি কেন?
'এমনি। কারণ নেই কোন।'
-চাকরিতে যাও এখনো?
'নাহ। ওরা আমাকে ছুটি দিয়ে দিয়েছে। চাকরি নেই এখন', লায়লা বিষণ্ণ হাসে।
-তাহলে কি...কি করছ তুমি এখানে? বাইরের কি পরিবেশ দেখেছ?! মাথা খারাপ হয়ে গ্যাছে নাকি তোমার??

আমার দুশ্চিন্তা লায়লাকে বিন্দুমাত্র স্পর্শ করে না। ও শান্ত পায়ে জানালার কাছে যায়, পর্দা সরিয়ে উঁকি দেয় বাইরে, তারপর বলে- 'সুন্দর জ্যোৎস্না উঠেছে আজকে। চলো ছাদে যাই। বাতাস আছে বাইরে।'

আমি আগের বাক্যটাই পুনরাবৃত্তি করি। ওর প্রকৃতস্থতা নিয়ে আরও সংশয় প্রকাশ করি। লায়লা এমনভাবে কথা বলে যেতে থাকে যেন আমার কথা শোনেই নি। 'পুরো ব্যাপারটা মানসিক বোধহয়, তাই না?'
-কোন ব্যাপারটা?
'এই যে, মানুষের কথা বলতে ভুলে যাওয়া। বাইরের লোকগুলো একেবারেই কথা বলতে পারে না, জানো? আমি সারাদিন জানালার কাছে বসে বসে দেখেছি। তবু ওদের মাঝে ভুল বোঝাবুঝি নেই কোন। আর আমরা এখনো কথা বলতে পারছি।'
-খুব বেশি সময় নেই। আমাদেরও একইরকম হবে। ওরা বাইরে আছে বলে বেশি খারাপ প...পররভাব পড়েছে হয়তো।
'তাহলে থাক। ছাদে যাব না। বোসো, ই বানিয়ে আনি। খাই আর কথা বলি।'
-ই?
লায়লাকে বিভ্রান্ত দেখায়, 'হ্যাঁ, মানে ওই যে, চিনি আর কালো গুঁড়ো মিশিয়ে বানায় না?'
-কফি? কফির কথা বলছ?
ও কিছুক্ষণ মনে করার চেষ্টা করে, তারপর হাল ছেড়ে দেয়। 'জানিনা বাপু ই কি, বানিয়ে আনি, তারপর দেখা যাবে।'

বাইরে বিকট শব্দে বিস্ফোরণের শব্দ হয়। অস্পষ্ট চিৎকার ভেসে আসে। রান্নাঘরে লায়লা টুংটাং শব্দে 'ই' বানাচ্ছে। আমি ওই টুংটাং শব্দেই কান দেবার সিদ্ধান্ত নেই। ডায়েরি নিয়ে এখন কথা বলা যায়। আচ্ছা, ওকে জিজ্ঞেস করব কি, ডিভোর্স পেপার কেন নিয়ে গেছিল? পরিস্থিতির সাথে প্রশ্নটা হয়তো যায় না, কিন্তু মনের ভিতরে খুচখুচ করছে। আসলে অদ্ভুত জিনিস মানুষের মন। এতদিন নির্জীব হয়ে এক কোণায় গুটিসুটি মেরে পড়ে ছিল, কিছুই চায় নি, কিছুই জিজ্ঞেস করে নি। যেই দেখা হল আবার, একগাদা প্রশ্ন নিয়ে তড়াক করে দাঁড়িয়ে গেল। কিন্তু তার পরেও জিজ্ঞেস করার সাহস পাচ্ছে না।
'ধরো।'
সাদা কাপে কালো কফি। চুমুক দিলাম সাবধানে।
'কেমন?'
-...গরম। খুব!

আমার জিভ বের করে হ্যা হ্যা করা দেখে লায়লা হাসে কিছুক্ষণ। 'তাহলে এতো সাবধানে চুমুক দিয়ে লাভ হল কই?'
আমিও হাসি। ব্যাপারটা ইচ্ছাকৃত, গুমোট পরিবেশটা হালকা করাই উদ্দেশ্য ছিল। উদ্দেশ্য সফল বলা যায়। তারপর আমরা কথা বলতে থাকি, এটা সেটা নিয়ে। ঘড়ির কাঁটা ঘুরতে থাকে। কফির কাপে চুমুক দেই। শব্দ ভুলে যেতে থাকি একটা একটা করে। বিষয়ের পরিধি কমে আসতে থাকে। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার, তা কারুরই নজরে পড়ে না। বরঞ্চ একজন আরেকজনের সঙ্গ কতটা যে উপভোগ করতাম, সেটা পরিষ্কার হয়ে মনে পড়তে থাকে তখন। ঘণ্টাখানেক পরে, রসিকতা করে লায়লার খাদ্যরুচির কথা তুলতে গিয়ে দেখলাম কিছুই বলতে পারছি না। আমি জানি ও কি পছন্দ করে, জানি কোন উপাদানটা তৈরি করতে গিয়ে ও বিপদে পড়েছিল, মাথার ভেতরে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি আমি পুরো ব্যাপারটা; কিন্তু বর্ণনা করতে পারছি না। বলতে পারছি না। অনেকক্ষণ চুপ করে বসে থাকার পর আমি ওর দিকে চাইলাম।

লায়লা বুঝতে পেরেছে। ও নিজেও বলার চেষ্টা করল, আমি দেখলাম, কিন্তু কিছু উচ্চারণ করতে পারল না। চোখে অপার্থিব এক দৃষ্টি নিয়ে ও আস্তে করে হেসে বলল, 'আসিফ লায়লা'।

সেই মুহূর্তে আমার ভেতরে একটা ঝড় বয়ে গেল যেন। আমি লায়লাকে বলতে চাইলাম- নিজেকে অকেজো মনে হয় আমার। বলতে চাইলাম- মধ্যবয়সের একাকীত্ব জঘন্য একটা অনুভূতি। আমার বয়েসি বাকি মানুষেরা রীতিমত সংসার করে ক্লান্ত, আড্ডায় তাদের পাওয়া যায় না। তাদের সাথে কথায় ঘুরে ঘুরে আসে পরিবারের কথা। চোখে কিরকম স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে পড়ে। মেয়ে কেমন চঞ্চল হয়েছে, বাপকে দেখলেই দৌড়ে কোলে গিয়ে ওঠে। পকেট হাতড়ে দ্যাখে বাবা চকলেট এনেছে কিনা। কিংবা ছেলেটা এখনো নিজে হাতে ভাত খায় না, মা তার সাথে বসবে, মা তাকে খাইয়ে দেবে- তবেই পেট ভরবে ছেলের। এরকম কাহিনীগুলো শুনে আমি আর বলার মত কিছু খুঁজে পাই না। ফাঁকা কণ্ঠে সুর মেলাই, বিমল হাসির ফেনা তুলি। একসময় সবাই ফিরে যায় যার যার ঘরে। আড্ডার মানুষ খুঁজে বেড়াই পরিচিত মহলে, কিন্তু একসময় বাসায় ফিরতেই হয়। আবার জাপটে ধরে একাকীত্বের ক্লান্তি। মাথায় আবোল-তাবোল চিন্তা আসে। মরে যেতে ইচ্ছে করে। বলতে চাইলাম- আমার ভীষণ একা লাগে আজকাল।

কিচ্ছু বেরোল না গলা দিয়ে। অস্পষ্ট, অর্থহীন কিছু ধ্বনি বেরিয়ে বিদ্রূপ করল শুধু। লায়লা একদৃষ্টিতে চেয়ে রইল আমার দিকে। আমার অসহায় মুখের দিকে। শব্দের ওপর প্রভুত্ব হারিয়ে ফেলেছি দুজনেই। যেন এক মহাকাল কেটে গেল এর মাঝে। পরিত্যক্ত কফির কাপে শ্যাওলার বেড়ে ওঠা, জীর্ণ বাতির টিমটিমে আলো, দেয়ালে বসা টিকটিকির তড়িৎ পলায়ন। অনন্ত কাল ধরে ঘড়ির নিরন্তর টিকটিক করে চলা। তারপর আমরা দুজনেই একটা সম্ভাবনা আবিষ্কার করলাম। একটা সম্ভাব্য সমাধান।

হয়তো, হয়তো কণ্ঠ নিশ্চুপ হলে শরীর তখন কথা বলে।

বাইরে তখন বিস্ফোরণের শব্দ ঘন ঘন হচ্ছিল। বিচ্ছিন্ন গোলাগুলির শব্দ, চিৎকার কাছিয়ে আসছিল ধীরে ধীরে। কিন্তু ওসব বহু দূরের বিষয়, অবাস্তব। পুরো বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে শুধু এই ঘরটা বাস্তব, আমরা দুজন বাস্তব। বাকি সব ভ্রম। সময় বলতে কিছু নেই আমাদের এখানে। চারপাশের জগত যখন খসে খসে পড়ছিল, আমরা দুজন ভাঙা মানুষ একে অপরকে সারিয়ে নিচ্ছিলাম। সেখানে কিছুক্ষণের জন্য স্বর্গ বলে যদি কিছু থাকে, তবে তাই নেমে এসেছিল। আমরা দুজন প্রথম মানব মানবী হয়ে ঘুরে বেরিয়েছিলাম স্বর্গে। টের পেয়েছিলাম জীবনের আদি স্পন্দন।

অন্ধকার একটা ঘরে শুয়ে থেকে, নিজেদের শ্বাস প্রশ্বাসের শব্দ শুনতে শুনতে এরপর নিজেকে খুব সুখি মনে হতে থাকে আমার। আর কিছু বলার নেই। নেই আর কিছু করার। কিছুক্ষণের জন্যে সমুদ্রের সব স্রোত থেমে গিয়েছিল, নিভে গিয়েছিল সব তারা, এখন আবার সেই প্রাচীন চক্র ঘুরতে শুরু করেছে। এখন প্রিয় মানুষটিকে জড়িয়ে শুধু অপেক্ষা। পরবর্তী ধাপের অপেক্ষা। আর তাই সিঁড়ি বেয়ে একদল মানুষের উঠে আসার শব্দে দুজনের কেউ আঁতকে উঠি না। দরজায় তাদের রাগান্বিত চিৎকারে, ধাক্কায় কোন ভয় লাগে না কেন যেন। আমি জানি, পাশে শুয়ে থাকা এই মানুষটি হাজার হাজার বছর ধরে একইভাবে আমার কাছে আসবে। দূরে সরে যাবে। আমরা অবশ হাতে শূন্য দোলনা দুলিয়ে যাব। একে অপরকে খুঁজে নেব আবার।

কারণ সময় একটা অনন্ত বৃত্তের মতো।
একটা অনন্ত অভিশপ্ত বৃত্তের মতো।
একই ব্যাপার ঘুরে ঘুরে আসে।
একবার, দু'বার;
বারবার।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা জুলাই, ২০১৫ বিকাল ৫:২৪
৫৪টি মন্তব্য ৫৪টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হাসান মাহমুদ গর্ত থেকে বের হয়েছে

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১১:১২


যুক্তরাষ্ট্রের একটি বাংলা টেলিভিশন চ্যানেল হাসান মাহমুদের সাক্ষাৎকার প্রচার করেছে। আমি ভাবতেও পারি নাই উনি এতো তারাতারি গর্ত থেকে বের হয়ে আসবে। এই লোকের কথা শুনলে আমার গায়ের লোম... ...বাকিটুকু পড়ুন

দারিদ্রতা দূরীকরণে যাকাতের তাৎপর্য কতটুকু?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১১:১৮



দরিদ্র দূরীকরণে যাকাতের কোনো ভূমিকা নেই।
যাকাত দিয়ে দারিদ্রতা দূর করা যায় না। যাকাত বহু বছর আগের সিস্টেম। এই সিস্টেম আজকের আধুনিক যুগে কাজ করবে না। বিশ্ব অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

শেখস্তান.....

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:১৫

শেখস্তান.....

বহু বছর পর সম্প্রতি ঢাকা-পিরোজপু সড়ক পথে যাতায়াত করেছিলাম। গোপালগঞ্জ- টুংগীপাড়া এবং সংলগ্ন উপজেলা/ থানা- কোটালিপাড়া, কাশিয়ানী, মকসুদপুর অতিক্রম করার সময় সড়কের দুইপাশে শুধু শেখ পরিবারের নামে বিভিন্ন স্থাপনা দেখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের বিয়ের খাওয়া

লিখেছেন প্রামানিক, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ২:৪৮


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

১৯৬৮ সালের ঘটনা। বর আমার দূর সম্পর্কের ফুফাতো ভাই। নাম মোঃ মোফাত আলী। তার বিয়েটা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। বাবা ছিলেন সেই বিয়ের মাতব্বর।... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিএনপি-আওয়ামী লীগের মধ্যে মৈত্রী হতে পারে?

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০০


২০০১ সাল থেকে ২০০৬ পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত আওয়ামী লীগের ওপর যে নির্যাতন চালিয়েছে, গত ১৫ বছরে (২০০৯-২০২৪) আওয়ামী লীগ সুদে-আসলে সব উসুল করে নিয়েছে। গত ৫ আগস্ট পতন হয়েছে আওয়ামী... ...বাকিটুকু পড়ুন

×