ফার্মেসির সামনে আসতেই ওকে দেখে সরোয়ার ভাই হাসি দেন একটা।
'কেমন আছেন জনাব, কি অবস্থা?'
ওর মুখেও আবছা হাসি ফোটে। এইতো ভাই, আছি।
-'বুকের ব্যথা আবারো?'
হ্যাঁ।
-'ধরেন, নিয়া যান এক পাতা। আপনেরা যুবক পোলাপান, সারাদিন এই ব্যথা ওই ব্যথায় কাইত হইয়া থাকলে চলবো? জিম হইতাছে তো একটা দক্ষিণ পাড়ায়, ভর্তি হইয়া যান। ঘাম ঝরাইলে ঠিক হয়া যাইব সব।'
ও মাথা নেড়ে মৃদু সম্মতি জানাল, তারপর বেরিয়ে এল ওষুধ আঁকড়ে। সরোয়ার ভাই পাতার পর পাতা ওষুধ দিয়ে যাচ্ছেন তাকে, কিন্তু তিনি বোঝেন না- ওর ওষুধ নয়, জিম নয়, বরঞ্চ বিষ বা শটগানের দরকার। রাস্তার পাশে লালরঙা টিউবওয়েল চেপে সে পানি খেল গবগবিয়ে, আর দুটো ট্যাবলেট গিলে ফেলল। আপাততঃ স্বস্তি। আগামী দশ বারো ঘণ্টা বুকের ভেতরের বাসিন্দারা পা শুন্যে তুলে ঘুমোবে, মাংসের ভেতরে পছন্দমতন হাড় বেছে নিয়ে ঠোকরা-ঠুকরি করবে না। আশা করা যায় ঘুমের ঘোরে এরা গান-ও গাইবে না কুৎসিত সুরে। কিন্তু বড়ি দুটো পেটের ভেতরে যাবার কিছুক্ষণ পর, ওর মাথা চক্কর দিয়ে ওঠে। ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। এইটুকু স্বস্তির বিনিময়ে তার এখন বমি আসবে উথলে উথলে, শরীরে কোন শক্তি পাবে না, আর মাথা ধরবে ভীষণ। ও ঘোলাটে চোখে ঢুলে ঢুলে রাস্তাটা পার হল।
বাসায় গিয়ে বিছানায় এখন কোনোমতে শুয়ে পড়তে পারলেই হয়, বেঁচে যায় সে।
*
রাশেদ প্রথম জন্মদিনের উপহার পেয়েছিল সাত বছর বয়সে।
ওর বাবা রাশভারি মানুষ, কথা খুব কম বলতেন। একটু বোকাটে ছিলেন। সবার বাবা যেমনটা হয় আর কি। সেদিন সকালে বাবা ওর ঘরে এলেন। হাতে একটা কাপড়ে ঢাকা বাক্স। একটু বিব্রত কণ্ঠে তিনি ওকে জাগালেন, তারপর জিজ্ঞেস করলেন, রাশেদ কি বাক্সটা খুলে দেখতে চায়? ইচ্ছে করলে সে খুলে দেখতে পারে। আজ ওর জন্মদিন কিনা, তাই তিনি একটা উপহার কিনে নিয়ে এসেছেন। এই কথায় এক ঝটকায় রাশেদের ঘুমের ঘোর ভেঙে যায়, উৎসাহিত আঙুলে সে বাক্স খুলে ফেলে, তারপর দেখে, 'উপহার'টা আসলে একটা খাঁচার ভেতরে দুটো টুনটুনি পাখি। সে অবাক হয়ে বাবার দিকে তাকালে তিনি অপরাধী মুখে কৈফিয়ত দেন, রাশেদের বুকের শূন্য খাঁচাটা দেখে উনার অস্বস্তি লাগে। মানুষের বুক তো খালি রাখার মতো জিনিস না। খালি রাখলে শাশ্বত, প্রাচীন নিয়মগুলির অবমাননা করা হয়। তাই উনার ইচ্ছে, সে পাখি দুটোকে তার বুকের খাঁচায় ভরে রাখুক। দেখতে ভাল লাগবে। এই বলে তিনি ওর বুকের খাঁচার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থাকেন।
ছোট্ট রাশেদ নিজেও তাকিয়ে দেখে। তাঁর গলার নিচ থেকে পেটের ওপর পর্যন্ত, পুরো জায়গাটা চামড়াহীন, মাংসহীন। বুকের শাদা হাড়গুলো একেকটা শিকের মত সমান্তরাল, পরস্পর দূরত্ব বজায় রেখে অসংখ্য ফুটোঅলা এক প্রাচীর তৈরি করেছে। এই প্রাচীর আর মেরুদণ্ডের মাঝখানটায় কিচ্ছু নেই। ফাঁপা, ফাঁকা, ভয়াল রকমের রিক্ত। এখানে কি করে টুনটুনি দম্পতি বাস করবে? এদের বর্জ্য গিয়ে পড়বে কোথায়? ওর মনে বিভিন্ন প্রশ্ন জাগে। কিন্তু বাবা চেয়ে আছেন দেখে সে এসব তুচ্ছ, মামুলি প্রশ্ন করার সাহস পায় না। বিনা বাক্যব্যয়ে অসংখ্য ফুটোগুলোর একটায় নখ আটকে হাড়-প্রাচীরকে দু-ফাঁক করে ফেলে। তারপর ভয়ার্ত টুনটুনিদের সাবধানে স্থানান্তরিত করে বক্ষদেশে। তারপর আমতা আমতা করে সে জিজ্ঞেস করে, 'ওদের নাম কি রাখব, বাবা?'
উনি চমকে ওঠেন। 'নাম রাখার কি দরকার? বুকে থাকবে, খাবে -এইতো! তুমি তো আর পাখি নিয়ে সংসার করতে যাচ্ছ না!' এইটুকু বলে তিনি উঠে পড়েন, নিঃশব্দে দরজা ভিড়িয়ে চলে যান বাইরে। রাশেদ এই সামান্য ঘটনাটা কাউকে বলেনি। কেন, এই ব্যাপারেও ও ঠিক পরিষ্কার না।
*
ঘরে ঢুকে ও একটু অপ্রস্তুত হয়ে যায়। একটা মেয়ে বসে আছে ওর বিছানায়। মুখে চকমকে উৎফুল্ল একটা ভাব।
-'আপনি রাশেদ?'
ওর রাগ হয় খুব। হ্যাঁ, আপনি কে?
-'ইকো। নাইস টু মিট ইউ!' মেয়েটা হাত বাড়ায়।
সাধারণ শালীনতার নিয়ম অনুসারে এখন ওর উচিত নিজের নামটা বলে, মুখে হাসি ফুটিয়ে হাতে হাত মেলানো। অন্য কোন পরিস্থিতিতে ও হয়তো ওটাই করত, কিন্তু এখন ওর মাথা ঘুরছে, চোখে সব ঘোলাটে লাগছে, খুব শুয়ে পড়তে ইচ্ছে করছে। মেয়েটা যে ওর অসুস্থ কল্পনার সৃষ্টি নয় তাই বা কে বলবে? আর বাংলাদেশি মেয়েরা নিশ্চয়ই অপরিচিত যুবকের সাথে হাত ঘষাঘষি করার চেষ্টা করে না, তাদের নাম বিটকেল 'ইকো'-ও হয় না। সুতরাং নিশ্চিত ভুল দেখছে ও। এই সিদ্ধান্তে এসে রাশেদ মনে মনে নিজের যুক্তিক্ষমতার তারিফ করে, এবং মেয়েটার পুরো অস্তিত্ব এড়িয়ে গিয়ে শুয়ে পড়ে বিছানায়। তারপর জামা খুলতে খুলতে ভাবতে থাকে কাল রাতে কি জিনিস খেয়েছিল যে এমন হ্যালুসিনেশন হচ্ছে।
মেয়েটা অপ্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। একটা কিছু বলার চেষ্টা করে। তারপর হঠাৎ খেপে গিয়ে টেবিল থেকে একটা খালি সোডার বোতল নিয়ে ছুঁড়ে মারে রাশেদের মুখে। নাকে পটাস করে জিনিসটা ল্যান্ড করলে ও মুখ ঢেকে ব্যথায় হাউমাউ করে ওঠে।
-'আপনার সমস্যা কি? চোখে দেখেন না?'
এখনও ও বিশ্বাস করতে পারছে না ব্যাপারটা। পুরো বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে। মেয়েটা ঝাড়ি দিয়েই যাচ্ছে একতালে,
-'কি, কানে যায় না কথা? আমি ভাল মনে এলাম যে নতুন বাসায় উঠেছি, আশেপাশের মানুষগুলোর সাথে একটু পরিচিত হয়ে আসি, আর দেখো এনার ভাব, যেন মানুষই না আমি, কি সুন্দর পাশ কাটিয়ে সটান শুয়ে পড়ল বিছানায়! মানুষের ভদ্রতা বলেও তো একটা কিছু থাকে, নাকি? অসভ্য, ইতর লোকজন সব!' বিমূঢ়, এবং অর্ধেক-জামা-খুলে-আটকে-যাওয়া রাশেদকে কিছু বলবার সুযোগ না দিয়ে মেয়েটা ধুপধাপ পা ফেলে বের হয়ে যায় ঘর থেকে। ও নাক হাতাতে হাতাতে ভাবে, কি হল এটা??
ভীষণ অবাক হয়েছে বলেই কিনা, শরীর যে আর খারাপ লাগছে না, এটাও ওই মুহূর্তে মাথায় আসে না ওর।
*
প্রথম টুনটুনি-জোড়া মরে গেছিল উপহার পাবার দু'দিন পর।
দোষটা ওরই। বুকের নিচে বালিশ গুঁজে গল্পের বই পড়ছিল, কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে বুঝতেই পারেনি। জেগে উঠে দেখে পাখি দুটো মুখ থুবড়ে পড়ে আছে খাঁচার ভেতর, পাখায় ছড়াছড়ি হয়ে গেছে বুকের ভেতরটা। খুব ঝাপটাঝাপটি করে তারপর মরেছে দুজনে, বোঝা যাচ্ছিল। ছোট্ট রাশেদ ভয়ে বাবা! বাবা! বলে চিৎকার করছিল আর কাঁথার ভেতরে ডুবিয়ে ফেলছিল নিজেকে, যেন পালাতে চায় এই নির্মম বাস্তব থেকে। বাবা দৌড়ে এলেন, কিন্তু চেষ্টা করেও খাঁচাটা খুলতে পারলেন না। ও নিজেও পারল না। দীর্ঘ দুইটি দিন প্রচণ্ড ভয়ার্ত রাশেদ অস্থিপঞ্জরে মৃত পাখির গলিত দুর্গন্ধময় পচা মাংস জোড়াকঙ্কাল নিয়ে ঘুরল।
অবশেষে তৃতীয় দিন বিকেলে সে দুটো জিনিস আবিষ্কার করল, এক- স্থির মস্তিষ্কে খুব মনোযোগ দিয়ে চেষ্টা করলেই এ খাঁচা খোলে, নইলে নয়। আর দুই- খাঁচাটা খুলতে পারে একমাত্র ও-ই।
এরপর আর টুনটুনি পোষা হয়নি। বাবা ক'দিন পর জোড়া টিয়া কিনে দিলেন। এরা তেমন জ্বালাত না, কিন্তু বড্ড ঠোকরাত। অভিযোগ জানালে বাবা বলেছিলেন, টুনটুনির মতো মাই ডিয়ার টাইপ পাখি এখন আর খুঁজে পাওয়া যায় না, এরা বিলুপ্তপ্রায়; তাই টিয়া নিয়েই ওকে সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে আপাততঃ। সেই থেকে রাশেদের বুক ব্যথা শুরু। কত ওষুধ খেল, কত ডাক্তারের কাছে গেল, লাভ হল না। ব্যথাটা কিছুক্ষণ কমে, তারপর আবার পূর্ণোদ্দমে হাজির হয়। জিভে ওষুধ বুকে টিয়া নিয়ে বেচারাকে পুরো প্রাইমারি লেভেল কাটাতে হল। বজ্জাত টিয়াজোড়া মরতে সময় নিয়েছিল অনেক, মুক্তি মিলেছিল হাইস্কুলে ওঠারও দুই বছর পর।
*
ইকো মেয়েটার সাথে ওর প্রেম হতে পারত।
সিনেমায় যেমন দেখায়, প্রেমের সব উপাদান-ই উপস্থিত ছিল। সে জোয়ান ছেলে, ইকো তন্বী তরুণী। রাশেদ মেয়েটার কাছে মাফ চাইতে যাবে, মেয়েটা প্রথমে একটু রাগ দেখাবে কিন্তু তারপর ঠিক দুজনে মিলমিশ হয়ে যাবে। তারা হাসাহাসি করবে, সূক্ষ্ম ছিনালি-ও হতে পারে, হয়তো রাশেদ ওকে শহরটা ঘুরিয়ে দেখানোর প্রস্তাব দেবে, তারপর বৃষ্টি নামবে ঝুম করে। তাতে ভিজতে ভিজতে দুজন দুজনের দিকে ইঙ্গিতময় চোখে, ভঙ্গিতে তাকিয়ে, নেচে নিজেদের শাশ্বত প্রেম প্রকাশ করবে।
কিন্তু রাশেদ বিছানা থেকে উঠতে অস্বীকার করায় এই বিপুল সম্ভাবনাময় সম্পর্ক অকালে বিনষ্ট হয়ে গেল। আসলে বলা উচিত, বিনষ্ট হতে পারত। সম্ভাবনা এখনও আছে একটু-আধটু। কারণ অনাগ্রহ সত্ত্বেও ইকো মেয়েটা খোদা জানে কোন কারণে ওর পিছু ছাড়ছে না। সে প্রতিদিন আসে, রাশেদকে শুয়ে থাকতে দেখে, কিছুক্ষণ বকবক করে; তারপর চলে যায়। কি কারণ থাকতে পারে এর পিছনে? মেয়েটা কি একটু গায়েপড়া স্বভাবের? নাকি দেখে ফেলেছে ওর বুকের খাঁচা, আর তাতেই উৎসাহী হয়ে পড়েছে?
হতে পারে। চিত হয়ে শুয়ে বুকের হাড়ের ফাঁকফোঁকর দিয়ে শস্যদানা ছড়িয়ে দিতে দিতে ও ভাবতে থাকে। বুকের ভেতরে পাখোয়াজ শালিকগুলো উৎফুল্লসুরে ডাকে আর খায়।
তখনই ইকো ঢোকে ঘরে।
*
অনেকবার ভেবেছে ও, নচ্ছার পাখিগুলোকে বের করে দেবে বুক থেকে। কিন্তু বাবার চোখে পড়বে এই ভয়ে পারেনি। সুতরাং বাবা যখন মরে গেলেন যথেষ্ট বেঁচে, ক'দিন শোক প্রকাশের পর ওর মনে হল, এই সুযোগ। বুকের লেটেস্ট অধিবাসী তখন একজোড়া চিল। খোলা মাঠে গিয়ে দুটোর পাখা চেপে ধরে বের করে ফেললে কে আসছে আপত্তি জানাতে?
যেই ভাবা সেই কাজ। পাখি সরাও, বুকটা ধুয়ে ফেল। দুটো কাজ সারতে কতক্ষণই বা লাগে! কিন্তু কাজটা করার ঘন্টাখানেক পর, রাশেদ হঠাৎ অনুভব করল ওর বুকে কেমন চাপ লাগছে। সময় যায়, চাপ আরও বাড়ে। বিরক্ত হয়ে শার্ট উঁচিয়ে ও দেখল, বুকের হাড়গুলো মরা গাছের ডালের মতো কুঁকড়ে বেঁকে যাচ্ছে, যেকোন সময় পটপট করে ভেঙে যাবে একটা একটা। যেন হাড়েরা যুক্তি করেছে, খাঁচার ভেতরে পাখিই যখন থাকবে না, তখন খাঁচার কি দরকার? গুঁড়িয়ে দাও হাড়-কপাট। বাজারে দৌড়ে গিয়ে একজোড়া পায়রা কেনার পর ওর মনে হয়েছিল, পাখিগুলো ওর দিকে তাকিয়ে বিদ্রুপের হাসি হাসছে। বলছে- কেমন দিলাম, দেখেছ? যতই জ্বালাই, আমাদের পাখির গুষ্ঠি ছাড়া তোমার চলবে না।
সত্য কখনো কখনো খুব তিতে মনে হয়।
*
রাশেদ কখনো প্রেম করে নি। এটা একটা ঘনিষ্ঠ ব্যাপার, বুকে পাখির কাঁচা মল আর পাখার ফড়ফড়ানি নিয়ে অন্ততঃ ঘনিষ্ঠ হওয়া যায় না। সুতরাং কম বয়সে এই কনসেপ্ট নিয়ে বহু জল্পনাকল্পনা এবং বিস্তর বিষাদের ছবি দেখার পর সে সাব্যস্ত করেছিল, প্রেম হচ্ছে ফাঁপা একটা ব্যাপার। প্রেমিকারা আসে, তারা ক'দিন ভালবাসে, তারপর চলে যায়। কিন্তু মানুষ যেহেতু সামাজিক জীব, সে নিজের আদিম একাকীত্ব দূর করার জন্যে, জৈবিক প্রয়োজন মেটাতে আবার সঙ্গী খোঁজে; আর ভালোবাসার দোহাই দিয়ে পুরো ব্যাপারটার দীনতা ঢেকে দেবার চেষ্টা করা হয়। কোন এক দার্শনিক বলেছিলেন না, প্রেম হচ্ছে দুই দেহে এক আত্মার অস্তিত্ব? কাল্পনিক একটা কথা। আসলে জিনিসটা যতটা না প্রয়োজন, তারচেয়ে অনেক বেশি বিলাসিতা। ওর তেমন কোন ভাল বন্ধুও ছিল না, সুতরাং কেউ খোঁচা দিয়ে বলে নি- হা! আঙ্গুর ফল টক!
কিন্তু ইকোর সাথে কিভাবে যেন ওর প্রেম হয়ে গেল; অনেকটা জোর করেই। জিনিসটা দুশ পৃষ্ঠার একটা বইয়ের প্রথম পাঁচ-দশ পৃষ্ঠা পড়ে হঠাৎ এক লাফে শেষ লাইনটা পড়ে ফেলার মত মনে হচ্ছে, যদিও সত্য এটাই। ইকো সেদিন ওর খাঁচা দেখে ফেলেছিল, তারপর থেকেই সে তেজি ওই মেয়েটা থেকে পাল্টে গেল পুরোপুরি, কেমন মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়ল। নাওয়া নেই, খাওয়া নেই, সারাদিন রাশেদের বাসায় এসে বসে থাকত। আর খালি প্রশ্ন। খাঁচাটা দেখি? আপনার বুকটা এমন কেন? এক্সিডেন্ট হয়েছিল কোন, নাকি জন্মগত? কি পাখি পোষেন ওখানে? ব্যথা হয় না? ইত্যাদি ইত্যাদি। আশেপাশের মানুষ ফিসফাস করত কিনা জানা নেই, কিন্তু ওর নিজের অস্বস্তি লাগত। মেয়েটা এমন পাগলামি করে কেন? মানুষের বুকে খাঁচা থাকতেই পারে, একটু অস্বাভাবিক হয়তো, কিন্তু এতোটা উৎসাহের বা কৌতূহলের ব্যাপার তো না। খোঁজাখুঁজি করলে এমন আরও কেস নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে। কিন্তু কিছু বলত না রাশেদ। হয়তো বুকের ব্যথা কমে যাওয়ার ব্যাপারটা ও ধরতে পেরেছিল, কিংবা হতে পারে মেয়েটার সঙ্গ সত্যিই ওর ভাল লাগা শুরু করেছিল।
সুতরাং একদিন রাত হয়ে এলে যখন ইকো বাসায় যেতে অস্বীকার করল, রাশেদ তেমন উচ্চবাচ্য করেনি। এমনকি রাত আরেকটু গভীর হয়ে এলে, মেয়েটা যখন ঠেলেঠুলে ওর পাশে বিছানায় শুয়ে পড়ল আর মন্ত্রমুগ্ধ চোখে ওর বুকের আদিম কুৎসিত ফাটলগুলোতে আড়ষ্ট ভঙ্গিতে আঙুল বুলোতে শুরু করল- তখনো ও, কিংবা বুকের পক্ষীকুল, কেউ আপত্তি করেনি; বরঞ্চ আদর্শ লম্পট যুবকের মতো রাশেদ দেহ মন্থনে ব্যপ্ত হয়েছে, ইকোও সাড়া দিয়েছে স্বয়ংক্রিয় ভঙ্গিতে। শারীরিক তৃপ্তির পর মাথা ঠাণ্ডা করে রাশেদ ভেবেছিল- তবে এ-ও কি প্রেম? অন্ধকার ঘরে একে অপরের শ্বাস-প্রশ্বাস নির্লিপ্তভাবে পর্যবেক্ষণ করতে করতে যে অনুভূতি জাগে, কিংবা যেখানে একজন আরেকজনের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে চরিতার্থ করে কামনা- একে কি প্রেম বলা চলে? জানা নেই ওর। তবে ওদের সম্পর্কটা নিঃসন্দেহে ভিন্নরকম। সময় কাটার সাথে সাথে এ বিশ্বাস আরও দৃঢ় হয় ওর। এই সম্পর্কে সুষম কোন ব্যাপার নেই, সবকিছুই তীব্র, একমুখী। ইকো এখন এখানেই থাকে, ওর বাসাটায় যায় না বললেই হয়। তাঁর পুরো জগৎটা এখন আবর্তিত হয় রাশেদকে ঘিরে। রাশেদ কি পরবে, কি খাবে, কখন বাইরে বেরোবে, সব মেয়েটার হাতে। কিংবা ঠিক করে বললে, পাখি দুটো আর মেয়েটার হাতে। ওদের সম্পর্ক এখন সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক। দুটো ভোট দেয় ইকো আর পাখিদ্বয়, একটা ভোট ওর। কারা জেতে সবসময় সেটা বলাই বাহুল্য। কিন্তু এখন ওর হারতেও খুব ভাল লাগে।
মানুষ কত কম সময়ে পাল্টে যায়, রাশেদ ভাবে খুশিমনে।
ইকো ওকে প্রশ্ন করে মাঝেমাঝে, 'আচ্ছা, খাঁচা খুলে দিলে পাখিগুলোর কি হবে?'
-'উড়ে চলে যাবে!'
'সত্যি?', মেয়েটাকে বিষণ্ণ দেখায়, 'এত সহজেই? আমি হলে কোনোদিন যেতাম না, গুটিসুটি মেরে ওইখানেই বসে থাকতাম সারা জীবন।'
আবার কখনো রাশেদের হাত ধরে বলে, 'এই পাখিরা কতদিন ধরে আছে তোমার বুকে?'
-'অনেকদিন!'
'আমার আসার আগে থেকেই?'
-'হু।'
'কতদিন থাকবে?'
-'অনেকদিন।'
'আমি মরে গেলেও?'
-'হু', রাশেদ রসিকতা করার চেষ্টা করে, তারপর ওর মুখের ভাব দেখে শুধরে নেয় কথাটা, মাফ চায় বারবার, আদর করে প্রেমিকাকে। ইকো শান্ত হয় একসময়। হাসে। জিজ্ঞেস করে, 'তুমি ওদের নাম দাও নি?'
-'নাম?'
'হ্যাঁ! এতদিন ধরে আছে, একটা নাম দেবে না? মানুষ তো পোষা বেড়াল-কুকুরেরও নাম রাখে।'
রাশেদ তখন ব্যাখ্যা করে। এসব পাখিদের ওর কখনো আপন মনে হয় নি। এরা হিংস্র, এরা হিংসুক, ঠুকরে ঠুকরে ব্যথা দেয় ওকে। নেহায়েত না পুষলে চলে না, তাই এদের সাথে বাধ্য হয়ে সহাবস্থানে থাকে, নইলে কবেই সে তাড়িয়ে দিত পাখি-টাখি!
ইকো কিছু বলে না। উঠে চলে যায়। বিভ্রান্ত রাশেদ তাঁর এই আচরণের ব্যাখ্যা পায় পরের দিন। মেয়েটা একজোড়া দোয়েল কিনে এনেছে। 'ধরো, জাতীয় পাখি। ও দুটোকে বের করে আমার ভাল পাখি দুটোকে ঢোকাও।' ও আপত্তি করার সুযোগ পায় না। ইকো অবশ্য প্রাক্তন বুকের বাসিন্দা দুটোকে মুক্ত করে দেয় না, দোয়েলের খাঁচাতেই ভরে রাখে। নতুন বাসিন্দার আগমনে ওর বুকে গ্যাস্ট্রিক বেড়ে যায়, কিন্তু হাসিমুখে সহ্য করে নেয় সব। প্রেমিকার খুশির জন্য এইটুকু করতে পারবে না ও!
কিন্তু ইকো খুশি হয় না। এক মাস পরেই সে আবার পাখি কিনে নিয়ে আসে, একজোড়া ঘুঘু। 'দোয়েলগুলো বড্ড নখ দিয়ে খামচে ধরে তোমায়, ঘুঘুই ভাল।' রাশেদ অস্বস্তি বোধ করে এবার। এত তাড়াতাড়ি! কিন্তু কিছু বলে না। ভরে নেয় বুকে। নতুন পাখির কারণে আলসার দেখা দেয় ওর। ওকে বিস্কিট খেতে দিয়ে ইকো দোয়েলগুলোকে ঝুলিয়ে রাখে ঘরের এক কোণে।
ঘুঘু টিকল দুই সপ্তা। এরপর ময়না, শ্যামা, তোতা, বাবুই একে একে আসে, স্থানান্তরিত হয়, তারপর আবার আসে নতুন কোন পাখি। রাশেদের সেই সাথে পাল্লা দিয়ে অসুখ বাড়তে থাকে। মাইগ্রেন, জ্বর, কাশি, ঠাণ্ডা - এসব সাধারণ রোগ ওকে চেপে ধরে, একেবারে কাবু করে ফেলে। ইকো তবুও থামে না, 'নতুন পাখিগুলো খুব জ্বালাচ্ছে তোমায়, না? চিন্তা কোরো না, কালকেই আমি নতুন জোড়া নিয়ে আসছি।' রাশেদের মৃদু প্রতিবাদ সে কানেই তোলে না, দ্বিগুণ উৎসাহে বাজারে রওনা হয়।
অবশেষে মেয়েটা একজোড়া ঘাড়ছেলা শকুন নিয়ে এলে রাশেদের ধৈর্যচ্যুতি ঘটে।
-কি শুরু করেছ তুমি? শকুন, আমি শকুন পুষব বুকে! মশকরা করছো আমার সাথে?
ইকো অবাক হয়, 'কেন, তুমি খুশি হও নি?' রাগে ও বলার মত শব্দ খুঁজে পায় না। মেয়েটা এই সুযোগে ওর বুকের কাছে সরে আসে, তারপর নিশ্চিত আঙুলে, যেন খুব স্বাভাবিক ব্যাপার এটা, এমন ভাবে ওর বুকের খাঁচা খট করে খুলে ফেলে। তারপর আলতোভাবে শকুন দুটোকে ভিতরে ঢোকাতে শুরু করে। এই অসম্ভব ঘটনায় রাশেদ ভীত হয়ে পড়ে, এক ধাক্কায় সরিয়ে দেয় বিস্মিত মেয়েটাকে। ওর পুরো সত্ত্বা কেঁপে কেঁপে উঠছে এখন।
'তুমি এমন করছ কেন? আমি কি করলাম?' এমন ন্যাকা প্রশ্নে ওর ক্রোধ আর ভীতি, দুটোই জ্বালানি পেয়ে দপদপিয়ে জ্বলে ওঠে।
-'বুকের খাঁচা খুললে কি করে?' রাশেদ চিৎকার করে উত্তর দাবি করে।
'তুমি, তুমি শান্ত হও। আমি কি করেছি?'
রাশেদের গলার রগ যেন ছিঁড়ে রক্ত বেরিয়ে আসবে মুখে, 'মাগি তুই আমার খাঁচা খুললি কিভাবে? কিভাবে?'
ইকো এই আচরণে, এই হিংস্র-থুথু-ছেটানো-ক্ষিপ্ত রাশেদকে দেখে স্তব্ধ পাথর হয়ে গেল, নিঃশ্বাস নিতেও ভুলে গেছে।
-'বেরো, বের হ আমার ঘর থেকে! একেবারে খুন করে ফেলব!', ইকো এবারে সম্বিৎ ফিরে পায়, মুখ ঢেকে দ্রুত বের হয়ে যায় কাঁদতে কাঁদতে। লাল রক্তিম চোখে ওকে বেরিয়ে যেতে দেখে রাশেদ।
*
ইকো মেয়েটার সাথে ওর প্রেম হয়েছিল।
কোন এক দার্শনিক বলেছিলেন না, প্রেম হচ্ছে দুই দেহে এক আত্মার অস্তিত্ব? অক্ষরে অক্ষরে সত্যি বলেছিলেন। ওদের দুজনের এক হয়ে যাওয়াতেই মেয়েটা এত সহজে পিঞ্জরের বাধা পেরোতে পেরেছিল। অপদার্থ রাশেদ, ভীতু রাশেদ বুঝতে পারে নি। পাখি অদল-বদল করে ইকো ওর ব্যথা কমাতে চেয়েছিল, আর ও কি না দেখেছে শুধু এই গ্যাস্ট্রিক আর আলসারের দিকটা; খাঁচা খোলার ব্যাপারটাকে ভুল বুঝে সরিয়ে দিয়েছে নিজের একমাত্র ভালোবাসার মানুষটিকে! কতটা অন্ধ, কতটা কৃতঘ্ন হলে মানুষ এরকম করতে পারে!
ঝগড়া হবার পরবর্তী ঝাড়া ছয়টি ঘণ্টা এরকম ভাবতে ভাবতে কাটানোর পর, নিজেকে অনুশোচনার আগুনে বারংবার দগ্ধ করে অবশেষে রাশেদ একটা সিদ্ধান্তে আসে। ইকো নিশ্চয়ই ওর পুরনো বাসায় ফিরে গেছে। ও এখনই যাবে সেখানে, দরকার হলে ইকোর হাত-পা ধরবে, নাকে খৎ দিয়ে মাফ চাইবে; তবুও ফিরিয়ে আনবে ওর প্রিয়তমাকে। বলবে, দরকার হলে তুমি আমার বুকের ভেতরে একজোড়া উটপাখি পোষো, আমি কিচ্ছু বলব না, তবু তুমি ফিরে এসো আমার কাছে। আমি আর কিছু চাই না, শুধু তোমাকে ফিরে পেতে চাই।
এরকম কয়েকবার রিহার্সাল দিয়ে, দুরুদুরু মনে সে পৌঁছে যায় ইকোর দরজার সামনে। কড়া নাড়ে কাঁপা হাতে। কিছুক্ষণ পর শাড়ি পড়া ইকো দরজা খোলে। রাশেদ বড় একটা নিঃশ্বাস নিয়ে বলতে শুরু করে, 'আমার ভুল হয়ে গেছে লক্ষ্মীটি, মাফ করে দাও; আমি আসলে ভয় পেয়ে গেছিলাম, নিজের কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম মনে হয়...' সে বিব্রত হয়ে শুকনো হাসি হাসে কিন্তু দেখে মেয়েটা বিরক্তিমাখা নিরস চোখে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। চোখে অপরিচিত দৃষ্টি, সেখানে মমতা বা ভালোবাসার এমনকি মনোযোগের লেশমাত্র নেই, বরঞ্চ মেয়েটা পিছু তাকিয়ে অবজ্ঞার সুরে ডাকে, 'অ্যাই কবীর, পাশের ফ্ল্যাটের সেই লোকটা এসেছে, দ্যাখো তো কি চায়, মাফ চাইতে এসেছে নাকি!' এইটুকু বলে চলে যায় ভেতরে। একটা দাড়িঅলা পড়ন্তবয়েসি লোক, যে নিশ্চয়ই 'কবীর', এসে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়। রাশেদ একটু অস্থির হয়ে তাকে বলে, 'ইকোকে একটু আসতে বলুন প্লিজ, ও আমার ওপরে রাগ করে আছে, আমি কিছু বলতে চাই ওকে...।' লোকটা এবারে বিরূপ ভঙ্গিতে দাড়িয়ে ভারি গলায় বলে, 'আমি ইকোর স্বামী। যা বলার আমাকে বলুন, আমি ওকে জানিয়ে দেব।'
রাশেদ প্রথমে ভাবে লোকটা ঠাট্টা করছে, এই কারণে নয় যে তাঁর দাড়ি আছে, বয়েস বেশি; বরঞ্চ এই কারণে যে ইকো তো কারো বউ নয়, ইকো-রা কখনো কারো বউ হয় না, তারা শুধু মমতাময়ী প্রেমিকা হতে পারে। কিন্তু লোকটার পাথর-কঠিন দাঁড়ানোর ভঙ্গি আর মেয়েটার ওকে চিনতে না পারা এই ভাবনাকে দুমড়ে মুচড়ে মিথ্যে করে দেয়। ইকোর সাথে ওর ঘনিষ্ঠতা তো দূর, কখনো কোন সম্পর্কই ছিল না- এই তিতে সত্যের স্বাদে মুখ বিকৃত করে ও বিড়বিড়িয়ে বলে, 'সরি, ভুল জায়গায় এসে পড়েছি', তারপর পা টেনে টেনে নিজেকে ঘরের ভেতরে ফিরিয়ে নিয়ে আসে।
আশ্চর্যরকম এক নির্লিপ্ততা ওকে চেপে ধরে চারপাশ থেকে। বাস্তব এবং অবাস্তবের যে সরু সীমানার ওপরে সে ভেসে বেড়িয়েছে এতদিন, সেটা বিপদসীমার ওপরে উপচে উঠে ওর সম্পূর্ণ জগত প্লাবিত করে দেয় ধীরে ধীরে। নিজের সাথে প্রেম কিংবা নির্বোধ, নির্বোধ একাকীত্বের মন্দ্রজালে আটকে ছিল সে কতকাল? এই প্রাকপুরাণিক নগ্ন ভ্রম আর বাস্তবের মাঝে কোথায় সে টানবে পার্থক্যের সরলরেখা? জীবিত নাকি মৃত কিংবা জীবন্মৃত রাশেদ অনেকদিন পর ভাল করে ঘরের চারপাশটা তাকিয়ে দেখে। কোন দেয়ালে জায়গা বাকি নেই, শুধু ঝুলছে অসংখ্য শূন্য পিঞ্জর। পাখিগুলো মুক্ত হয়ে পাখা ঝাপটা-ঝাপটি করছে; ওড়াওড়ি করছে, কর্কশ সুরে ডাকছে; যেন অভয়ারণ্যে নিশ্চিত আশ্রয় খুঁজে পেয়েছে। তাদের পাখা, তাদের পালক এখানে ওখানে, সোফায়-টেবিলে-বিছানায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে; মেঝের রং পাল্টে গেছে তাদের হরেক বর্ণের বিচিত্র গন্ধময় বিষ্ঠায়। ওর এখন খুব ঘুম পাচ্ছে। খুব সাবধানে রাশেদ মেঝেতে শুয়ে পড়ে চিৎ হয়ে, বুকের খাঁচা খুলে অবলীলায় মুক্ত করে দেয় জোড়া বক্ষকপোত; তারপর মাথার পেছনে দুই হাত দিয়ে ঘোলাটে চোখে তাকিয়ে থাকে সিলিংয়ের দিকে। বুকের হাড়গুলো ভেঙে যাবার আগে বড়োজোর দুই ঘণ্টা সময় পাচ্ছে ও। এরই মাঝে বাজারে গিয়ে একজোড়া টুনটুনি কিনতে হবে। বাবা যেমনটা কিনে দিয়েছিলেন।
ঘরভরতি একঝাঁক বিভ্রান্ত পাখির কলকাকলির মাঝে শুয়ে সে মগ্ন হয়ে ভাবতে থাকে, টুনটুনি দুটোর কি নাম দেওয়া যায়।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে জুলাই, ২০১৪ সন্ধ্যা ৬:২৬