সাতটা একুশ বাজে।
হাসান তার তিনশ টাকার হাতঘড়িতে সময় দেখে ভুরূ কুঁচকালো। আব্বা তো জগিং করতে এত দেরি করেন না! আজ আর আব্বার জন্য অপেক্ষা করা সম্ভব না। হাসান গলা চড়ালো, 'কাজল, পেপারটা দিয়ে যা তো'। একটা চিকন-চাকন চৌদ্দ বছরের মেয়ে এসে হাসানের সামনে শীতল-পাটিতে পেপার ফেলল। হাসান মেয়েটার দিকে তাকায়। মেয়েটা তার ছোটবোন, এবং বেশ আদরের বলা চলে। কাজল হাসানের সামনে হাঁটু গেঁড়ে বসে, 'ভাইয়া, আজকে আমার সাথে একটু স্কুলে আসবে?'
-'কেন? কি হয়েছে? আব্বার সাথে যাবি না?'
-'না, আজকে প্রথম সাময়িক পরীক্ষার রেজাল্ট দেবে।'
-'তাই?'
-'না, মানে, পরীক্ষা ভালো হয় নাই। আব্বা আবার রেজাল্ট খারাপ হলে সবার সামনে বকে তো, আমার ভালো লাগে না। সবাই হাসে।'
-'আমি পারব না। আমার আটটার প্রাইভেট পড়াবে কে? আজকে সাত তারিখ না? বেতন দেওয়ার ডেট। '
কাজলের মুখটা কালো হয়ে যায়, গম্ভীর মুখ করে উঠে পড়ে।
হাসান দুই মিনিট ভাবে। কাজলের কথা সত্যি হবার কোন কারণ নেই। সে ক্লাসের থার্ড গার্ল, এবং রেজাল্ট যাই হোক, আব্বা কখনোই তাকে কিছু বলেন না। সাথে যেতে বলার পেছনে নিশ্চিত অন্য কোন কারণ আছে। যাক গে, পরে দেখা যাবে। হাসান তার মধ্যবিত্ত জীবনের একমাত্র বিলাস পেপারে মনোনিবেশ করে।
সেই একই খবর। অমুক দলের তমুক নেতা বিবৃতি দিয়েছেন তারা শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে লড়ে যাবেন, বাংলার মানুষ তাঁদের সাথে আছে। তেলের দাম বাড়ল। অমুক দপ্তরে দুর্নীতি নিয়ে প্রতিবেদন, নিচে আবার সেই প্রতিবেদনের প্রতিবাদ। শেয়ারবাজারে আবার ধস। কোন এক কোচিংয়ের বিজ্ঞাপন, তারা মেডিকেল-বুয়েটে নিশ্চিত চান্স পাইয়ে দিতে পারে। পড়তে পড়তে কোণার একটা খবরে হাসানের চোখ আটকে যায়, 'নারায়ণগঞ্জে গৃহবধূ ধর্ষণ, প্রতিবেশীকে সন্দেহ গ্রামবাসীর'। ও মনে মনে রেগে ওঠে, এসব শুয়ারের দলকে ফাঁসি দেয় না কেন সরকার? এরা কি মানুষ, না নরকের কীট? মনের রাগ মিটতে না মিটতে সে আরেক পৃষ্ঠায় দেখে, 'স্কুল-বালিকার শ্লীলতাহানি, দুই যুবক আটক'। এবার মনের অজান্তে বাজে একটা গাল দিয়ে ওঠে সে। তাড়াতাড়ি পৃষ্ঠা ওল্টায় আবার। বারবার ফ্যানের বাতাসে অগোছাল হয়ে যাওয়া স্ট্যাপলার না মারা কাগজ আঁকড়ে ধরে পড়তে পড়তে একটা সময় সে আবিস্কার করে, প্রতি পৃষ্ঠায়ই বড় বড় লেখার ফাঁকে ফাঁকে একটা দুটো করে ধর্ষণের খবর ছাপা হয়েছে।
শালা! হাসানের মুখ দিয়ে আরেকটা বাজে গাল বেরিয়ে আসে। সম্পাদকগুলো সব লুচ্চা। রিপোর্টাররা আরও লুচ্চা। এমনভাবে বর্ণনা দেয়, পড়লেই গা জ্বলে যায়। শালারা আলাদা একটা পাতা রাখলেই পারিস, 'আজকের ধর্ষণ', প্রতিদিন সেটা পুড়িয়ে তারপর যাতে পেপারে হাত দেওয়া যায়।
হাসান এই সব ধর্ষকদের পেলে রোমান পদ্ধতি অবলম্বন করত। উল্টো করে ঝুলিয়ে শালাদের বিচি পাথর দিয়ে ঠুকে ঠুকে গুঁড়ো করে দিত। এদের মানুষ বলে ধরা উচিত না। শালাদের বাড়িতে যে মা-বোন আছে, ধর্ষণের সময় সেটা মনে থাকে না? আর শুধু ওই শালারা কেন, যারাই মেয়েদের এমন অসম্মান করে সবগুলোকেই ধরা দরকার। হাত পা ভেঙে একেবারে লুলা করে দেওয়া দরকার। হাসানের এক বন্ধু ছিল, কলেজে খুব হামবড়া ভাব দেখিয়ে চলত। একবার এক মেয়ের ওড়না ধরে টানাটানির সময় হাসান ওকে দেখে ফেলে। বন্ধুর গালে সবার সামনে চটাস চটাস চড় মেরেছিল ও। সেইখানেই বন্ধুত্বের ইতি। তার সাথে এখনো মাঝেমধ্যে দেখা হয়, কিন্তু ও কথা বলে না। এমন মানুষকে হাসান প্রচণ্ড ঘৃণা করে।
বারান্দায় শব্দ হয়। আব্বা এলেন। হাসান হাতে পেপার গুছিয়ে নিয়ে আস্তে আস্তে উঠে পড়ে। আব্বার ঘরে ঢোকে। ঘরে ক্যাঁচকোঁচ শব্দ করে পুরনো ফ্যানটা সর্বোচ্চ শক্তি নিয়ে অপ্রকৃতিস্থের মত ঘুরছে। ডায়াবেটিসের রোগী আব্বা ঘর্মাক্ত মুখে বিছানায় পিঠে বালিশ দিয়ে গা এলিয়ে বসে আছেন। হাসানকে দেখে সোজা হয়ে বসেন। 'আয়, তোর সাথে কথা আছে।'
হাসান একটু অবাক হয়। 'কি কথা, আব্বা?'
'আজকে মিলনের সাথে দেখা হল। আমার পুরান বন্ধু। তুই তো দেখেছিস ওকে। গত কয়েক বছরে অনেক পালটে গেছে, বড় ব্যবসায়ী হয়েছে। ওর কাছে তোর কথা বললাম। ও বলল, তোকে একটা চাকরি দিতে পারবে। মাসে ন' হাজার টাকা বেতন। কালকে তুই ঢাকায় ওদের বাসাতে যা, আমার কাছ থেকে ঠিকানা আর টাকা যা লাগে নিয়ে নিস।'
-'আচ্ছা।' হাসান ঘুরে বেরোতে উদ্যত হয়।
-'আর আজকে কাজুকে স্কুলে নিয়ে যাস। আমার ভালো লাগছে না।'
-'ঠিক আছে আব্বা'। হাসান ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। শীতল পাটিতে বসে পরিবারের বর্তমান অবস্থা চিন্তা করে। বড় আপার বিয়ে দেওয়া হল ঋণ করে, প্রতি মাসে এখন পাওনাদারকে তিন হাজার টাকা করে দিতে হয়। আব্বার পেনশন আর হাসানের প্রাইভেটের উপার্জন, আয়ের এই দুই উৎস। হাসান শিক্ষিত বেকার। প্রথমে প্রাইভেট পড়াত একটা, তাও নিজের পড়ালেখার খরচ জোগাতে। কিন্তু অনার্স সেকেন্ড ইয়ার পর্যন্ত পড়ে থামতে হল। ভালো কোন চাকরি না পাওয়ায় প্রাইভেটের সংখ্যা বাড়ল। এখন সে প্রাইভেট পড়ায় তিনটা। তাতেই কোন মতে চলছে। এখন একটা চাকরি পেলে, তাড়াতাড়ি ঋণটা চুকানো যায়...কাজলকে ঢাকার ভালো একটা কলেজে ভর্তি করিয়ে দেবার সুযোগ মিলত...মেয়েটার পড়ালেখা করার খুব শখ...
হঠাৎ কাজলের ডাকে ওর মোহভঙ্গ হয়। 'ভাইয়া, সাতটা চল্লিশ বাজে। তাড়াতাড়ি! ক্লাস ধরতে পারব না!'
হাসান তাড়াহুড়ো করে কাপড় পরে, একটা রিকশা ডেকে নিয়ে আসে। কাজল স্কুল-ড্রেস পরে ব্যাগ কাঁধে রিকশায় হাসানের বামপাশে বসে। রিকশা চলা শুরু করে। বেশ কিছুক্ষণ পর, একটা চায়ের দোকান পার হবার সময় হঠাৎ বাতাসে শিস ভেসে আসে। সাথে কিছু বাজে মন্তব্য। সাথে সাথে কাজল শরীর শক্ত করে ফেলে, ব্যাগের স্ট্র্যাপ আঙ্গুলে আঁকড়ে ধরে। হাসান পুরো অবাক হয়ে যায়। এই কারণে কাজল আসতে বলেছিল! সে কাজলকে জিজ্ঞেস করে, 'কতদিন ধরে ডিস্টার্ব করে তোকে?' কাজল উত্তর দেয় না। মাথা নিচু করে বসে থাকে।
হাসান রিকশা থামিয়ে নামে, তারপর কাজলকে স্কুলে যেতে বলে দৃপ্ত পায়ে চায়ের দোকানের দিকে রওনা দেয়। ও পরিষ্কার করে কিছু ভাবতে পারছে না। মাথার মধ্যে বারবার সকালে পড়া খবরটা ঘুরছে, 'স্কুল-বালিকার শ্লীলতাহানি, দুই যুবক আটক'। দোকানের সামনে একটা হোন্ডা, বেঞ্চে একজন আর হোন্ডার ওপরে একজন বসে আছে। হাসান নিরীহমুখে বেঞ্চে বসে এককাপ চায়ের অর্ডার দেয়। ওরা কেউ হাসানকে চিনতে পারেনি। ছেলে দুটার বয়স ১৮-১৯ হবে। পাছার কাছে জিন্স ঢুলঢুল করছে। একজনের চাঁদির মাঝখানে কিছু চুল কালার করা। মুখে বেপরোয়া ভাব। ভোঁসভোঁস করে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ছে। বখে যাওয়া পোলাপান, বোঝাই যাচ্ছে।
হাসান দোকানদারের হাত থেকে চা নিয়ে আস্তে আস্তে চুমুক দিয়ে একসময় শেষ করে ফেলল। এই সময়ের মাঝে তিনটে মেয়ে স্কুলের দিকে গেল। প্রত্যেকের দিকেই মন্তব্য ছোঁড়া হল। প্রথম দুজনের ব্যাগ ধরে টানাটানি করা হল। এমনকি বেঞ্চে বসা ছেলেটা শেষ মেয়েটার পেছন পেছন অনেকদূর একটা বাজে প্রস্তাব দিতে দিতে হাঁটল। হাসান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ভেবেছিল দু-চারটে চড় মেরে ছেড়ে দেবে। কিন্তু এরা বেশি বাড় বেড়েছে। আশেপাশে তাকিয়ে একটা ছোট মোটা ডাল দেখল খালি, আর ভাল তেমন কিছু নেই। দোকানদারকে কাপটা ফেরত দিল ও।
বেঞ্চে বসা ছেলেটা কেবল চায়ের কাপ ঠোঁটে ঠেকিয়েছে, তখনি হাসান উঠে কাপের নিচের অংশ উঁচু করে মুখের ওপর চেপে ধরল। গরম চা ছেলেটার সারা মুখে ছড়িয়ে পড়তে না পড়তে আরেক হাতে কাপের ওপর জোরে থাবড়া মারল ও। কাঁচ আর ঠোঁট-দাঁতের ঘর্ষণে বিশ্রী একটা শব্দ হল। সাথে সাথে ঠোঁট কেটে রক্ত বেরিয়ে চায়ের সাথে মিশে পড়তে লাগল। হাসান ধারণা করল অন্ততঃ সামনের দুটো দাঁত উপড়ে গেছে। ছেলেটা সাপের মুখে আটকা পড়া কুনোব্যাঙের মত গোঙাতে লাগল। মুখ থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে ছেলেটাকে ছেড়ে দিল ও, উবু হয়ে পড়ে গেল ছেলেটা।
হোন্ডায় বসা ছেলেটা এই ঘটনায় এতই অবাক হয়েছে যে, একটু আগের খ্যাঁকখ্যাঁক করে হাসার ভঙ্গিটাও মুখ থেকে মুছে ফেলার কথা ভুলে গেছে। হাসান তার দিকে তাকাতেই চোখে ভয় ফুটল, হোন্ডা রেখে উল্টোদিকে দৌড় দিল সে। হাসান ডালটা তুলে নিয়ে দৌড়ে কিছুক্ষণের মধ্যে ছেলেটার ঠিক পেছনে চলে এল, পা সই করে ডাল চালাল। তিন চার ডিগবাজি খেয়ে ছেলেটা পড়ে গেল। এবার ও সর্বশক্তিতে পেটাতে শুরু করল। সাবধানে সবগুলো বাড়ি দিল পিঠে আর পাছায়। প্রথম বাড়ি খেয়ে ছেলেটা নাকিসুরে ভ্যাবানো শুরু করল। সাত নম্বর বাড়িতে ডাল কড়াৎ করে ভেঙ্গে গেল। ততক্ষণে পিঠের মাংস মোটামুটি থেঁতলে দেয়া গেছে। হাসান থামল। জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলছে। হাঁটুর ওপর ভর দিয়ে উবু হয়ে গোঙাতে থাকা ছেলেটাকে বলল, 'কি জন্যে পেটালাম, জানস। মনে থাকে যেন কুত্তার বাচ্চা'।
সোজা হয়ে আবার দোকানে ফিরে গেল সে। ওখানে ছেলেটা মুখ ধরে ওঠার চেষ্টা করছে। পেটে কলেজের ফুটবল টীমের মিডফিল্ডারের মাপা দুটো লাথি খেয়ে শুয়ে পড়ল আবার। হাসান হোন্ডা চেক করল, চাবি ইগনিশনে নেই। কি আর করা, হ্যান্ডেল ধরে ঠেলে ঠেলে দোকানের পেছনে নিয়ে গেল। একটা ডোবার মত জায়গা আছে ওখানে, ময়লা-বর্জ্য-কাদায় ভর্তি। হাসান হোন্ডা ঠেলে ডোবায় ফেলে দিল। যাঃ শালারা, খেটে খা।
ছেলেটার দিকে আরেকবার বিষদৃষ্টিতে তাকিয়ে একটা রিকশা ডেকে উঠে পড়ে ও, আজ সবগুলো প্রাইভেটের বেতন ওঠানো যায় কি না চেষ্টা করে দেখতে হবে।
** ** ** ** ** ** ** **
আরেকবার নিজের দিকে তাকাল হাসান। স্বীকার করতেই হবে, বেশ স্মার্ট লাগছে ওকে। মনে হচ্ছে কোন সরকারি চাকরির উপযুক্ত প্রার্থী। পিঠের কাছে নীল সার্টটা ঘামে লেপটে গেছে একটু, সেটা ব্যাপার না। ঠিকানা খুঁজে বের করতে একটু ঘুরতে হয়েছে, ঘাম হওয়া স্বাভাবিক।
একটা কুচকুচে কালো কাঠের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে ও। কি কাঠ সে সম্পর্কে কোন ধারণা নেই ওর, কিন্তু দেখেই বোঝা যাচ্ছে দামি জিনিস। অভিজাত একটা ভাব আছে। হাসান কলিংবেল টিপল। একবার। দুবার।
তিনবারের বেলায় এক যুবতী ন্যাকড়ায় হাত মুছতে মুছতে দরজা খুলে বিরক্তমুখে বলল, 'কি চাই?' হাসান গলা পরিষ্কার করে বলল, 'মিলন সাহেব আছেন?'
-'না।' এই বলে যুবতী দরজা আটকে দিতে উদ্যত হল।
এ কি জ্বালা! হাসান তাড়াতাড়ি একদমে বলল, 'তাহলে উনার ওয়াইফকে একটু ডেকে দিন। বলবেন মিলন সাহেবের এক বন্ধুর ছেলে এসেছে।'
-'আচ্ছা, একটু দাঁড়ান।' খট করে দরজা আটকে গেল। ভেতরের কথা একটু একটু শোনা গেল, 'আম্মা, আম্মা, কেরা জানি আইছে। আপনেরে খোঁজ করে'। ওঃ, মেয়েটা তাহলে কাজের লোক ছিল! কেমন শুদ্ধ ভাষায় কথা বলল! কাজের মেয়ে বলে মনেই হয়নি।
একটু পরে মধ্যবয়স্ক এক মহিলা দরজা খুললেন। হাসিখুশি চেহারা। হাসান কিছু বলার আগেই মহিলা বললেন, 'তুমি রশিদ ভাইয়ের ছেলে, হাসান?'
হাসান সত্যিই অবাক হয়ে হাসে, 'জী, চিনতে পেরেছেন আমাকে?'
মহিলার মুখ হঠাৎ গম্ভীর হয়ে ওঠে, 'না, উনি বলেছিলেন তুমি আসবে। তা আজ তো তোমাকে এখানে থাকতে দিতে পারব না, আমার বাপের বাড়ি থেকে লোক এসেছে। বাসার কোথাও জায়গা নেই। তুমি কাল সকাল দশটায় আস। ঠিক আছে?'
বিহ্বল হাসান মাথা নাড়ে। মহিলাও মাথা নাড়েন, 'আচ্ছা ঠিক আছে', তারপর ওর মুখের সামনে দরজা লাগিয়ে দেন।
নিজেকে খুব ছোট, খুব অপমানিত লাগে হাসানের। পুরো বিষয়টা হজম করার জন্য নিজেকে কিছুক্ষণ সময় দেয় ও। আসলে মনে ক্ষীণ আশা, এখনি হয়তো মহিলা দরজা খুলে হেসে বলবেন, 'এই দেখো, তোমাকে বসতে বলার কথা মনেই নেই আমার! আসলে বাসায় লোক তো অনেক, বোঝোই তো। আস, ভেতরে আস, একটু চা-কফি খেয়ে যাও'। এইকথা বললে তাঁকে পুরো ক্ষমা করে দেবে ও। কিন্তু কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে হাসানের মাথা পরিষ্কার হল। সে বুঝতে পারল মহিলা তাঁকে একটা বাড়তি ঝামেলা বলে মনে করছেন। বাসায় ঢুকতে দেবার প্রশ্নই ওঠে না। এদিকে রাত হয়ে এলো....
ভাবতে ভাবতে ও কখন নিচে নেমে এসে রিকশা ডেকেছে, বুঝতেই পারেনি। রিকশাওলা জিজ্ঞেস করল, 'কই যাবেন?' হাসান রিকশায় উঠে বলল, 'আশেপাশে ভালো কোন হোটেল আছে? একরাত থাকার জন্য দরকার।' রিকশাওলা প্যাডেল না মেরে সিটে বসল, 'হ, আছে তো। হোটেল প্যারাডাইস আছে, কল্লোল হোটেল আছে, অনেকটি আছে। কুনটায় যাইবেন?'
হাসান পকেটের কথা ভাবে। প্রাইভেটগুলো থেকে ওঠানো মোটমাট তিন হাজার টাকা আছে। আব্বার কাছে টাকা চাওয়ার ইচ্ছে হয়নি।
-'হোটেলের ভাড়া কেমন?'
রিকশাওলা হেসে দেয়, 'আমি কি ওনে কহনো থাকছি যে জানুম?' হাসানের হতাশ মুখ দেখে যোগ করে আবার, 'তয় হাইফাই হোটেল তো, হাজারের উপরে হওয়ার কতা।'
হাজার? হাতে আছে তিন, সামনে তো আরও লাগবে বোধহয়। একরাতেই এত খরচ করাটা ঠিক হবে না।
-'তার চেয়ে কম ভাড়ার হোটেল নেই?'
-'আছে, চারশ-পাঁচশ টাকায় এক রুম এক রাতের লিগা পাওয়া যাব, কিন্তু অইসব হোটেলে আপনে থাইকা আরাম পাবেন না। বেশি ভালো হোটেল না।'
-'তা হোক। একটা রাতই তো! ওইরকম একটা হোটেলেই নিয়ে চল'।
রিকশা এসে থামে সানরাইজ হোটেলের সামনে। হাসান ভাড়া মিটিয়ে ভেতরে ঢোকে। এক খোঁচা খোঁচা দাড়িওলা লোক ছাল ওঠা কাঠের টেবিলের পেছনে বসে আছে। সম্ভবতঃ সে-ই ম্যানেজার। কথা বলে একটা রুম ঠিক করা গেল। দুই তলার প্রথম রুম, ভাড়া চারশ টাকা। হাসান অযথা বাক্যব্যয় না করে চাবি হাতে সিঁড়ি বেয়ে রুমে ঢুকল। ২৫ ওয়াটের হলুদ আলো। একটা খাট, একটা চেয়ার, চেয়ারের ওপরে একটা টেবিল ফ্যান। দেয়ালে অজস্র লেখা, নারী-পুরুষের সম্পর্কজনিত নানা বিশ্লেষণমূলক ছবি আঁকা। এক কোণায় লেখা, 'কল মি', নিচে নাম্বার দেওয়া। সিলিঙে ফ্যানের শূন্য হুক। লম্বা লম্বা শিকের জানালা, কোন পরদা নেই। কাপড় পালটে হাসান টয়লেটে ঢুকল, নাক ধরে দ্বিগুণ বেগে বেরিয়ে এল। কমপক্ষে তিনটে আরশোলা, দুটা গোবদা মাকড়সা মুক্তভাবে বিচরণ করছে, আর সেই সাথে পুরো টয়লেট জুড়ে (সম্ভবতঃ রুমের প্রাক্তন বাসিন্দার কাজ) হলুদ-কালো ছোপছোপ দুর্গন্ধময় শিল্পকর্ম। নিচে ম্যানেজারের সাথে কিছুক্ষণ কথা বলার পর দেখা গেল হাসান মুখ শক্ত করে বাইরের পাবলিক টয়লেটে ঢুকছে, তার একটু পরই হোটেলের সামনে টিউবওয়েলে পা ধুচ্ছে।
এরকম 'রিফ্রেসমেন্টে'র পর হাসানের খুব ক্লান্তি লাগতে থাকে, টেবিল ফ্যান অন করে বিছানায় হাত পা ছেড়ে দেয়। চোখে একটু ঘুম ঘুম লাগতে থাকে ওর, ফ্যানের বাতাসে মাথা আস্তে আস্তে ঠাণ্ডা হতে থাকে। সারাদিনের দুশ্চিন্তা মাথা থেকে ছুটি নেয়। একটু একটু করে চোখ লেগে আসতে থাকে।
হঠাৎ, পিঠে একটু খোঁচা লাগে ওর। আসি আসি ঘুমটা টুটে যায়, শরীরটা একটু নড়ে চড়ে ওঠে। হঠাৎ করেই সম্পূর্ণ জাগ্রত হয়ে ওঠে হাসান। বিরক্ত মুখে এপাশ ওপাশ কাত হতে না হতেই আরেকটা খোঁচা। তারপর আরেকটা। তারপর যেন খোঁচার বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। বিছানায় আর থাকতে পারল না ও, লাফিয়ে উঠে পড়ে পিঠ চুলকাতে লাগল। একি?! সাথে সাথে একটা বদ্ধ সন্দেহ হল ওর। চট করে লাইট জ্বালিয়ে তোশক উঁচু করে দেখল। হুম, যা সন্দেহ করেছিল ঠিক তাই। তোশকের নিচে শয়ে শয়ে কিলবিল করছে ছারপোকা! বাহ, ক্লাসিক!
পিঠ চুলকাতে চুলকাতে বিছানায় একটা লাত্থি লাগাল ও। মন্দ ভাগ্য একেই বলে। ময়লা ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে মেজাজ আরও খারাপ হয়ে যায় ওর। এখন সারা রাত শোবে কোথায়? যত্তসব। রাগ করে হাসান আরেকটা লাথি দেয় বিছানায়। সঙ্গে সঙ্গে সিনক্রোনাইজড ড্যান্সের মত টেবিল ফ্যান ঘোরা বন্ধ করে দিল। হাসান সুইচ টেপে কয়েকবার, কারেন্টের লাইন চেক করে। কারেন্ট আছে। ফ্যানটাই নষ্ট হয়ে গেছে।
চমৎকার! টয়লেট ভর্তি শিল্পকর্ম, বিছানাভর্তি ছারপোকা, সারাদিনের ক্লান্তি চোখে কিন্তু ঘুমানোর জায়গা নেই, ভ্যাপসা গরম পরিবেশ, ঘামে চটচট শরীর। নরক এর চেয়ে আর কতই বা নিকৃষ্ট হতে পারে? হাসান অনির্দিষ্ট কাউকে কয়েকটা গাল দেয়। বিছানার ওপর টেবিল ফ্যানটা ছুঁড়ে ফেলে চেয়ার টেনে বসে জানালার সামনে। যদি কিছু বাতাস আসে...
জানালা দিয়ে হোটেলের সামনে একটা একতলা বাড়ি দেখা যাচ্ছে। ওই বাড়ির জানালাও খোলা। পরদা নেই। ঘরের সাদা আলোতে ভেতরের বিছানাটুকু পরিষ্কার চোখে পড়ছে। একজন তরুণী বাচ্চাকে দুধ খাওয়াচ্ছে। তরুণীর বসার ধরণ দেখে হাসানের বড়'পার কথা মনে পড়ে যায়। কতদিন ধরে আপা বাড়িতে আসে না!
এভাবে তাকান ঠিক শোভন না। হাসান অন্যমনস্কভাবে চোখ ফিরিয়ে নিতে গিয়ে থেমে যায়। জানালার কাছে একটা লোক দেখা যাচ্ছে না? সে ভালো করে তাকায়। হ্যাঁ, ওইতো, চোরের মত আবার মাথা নামিয়ে নিল। চেক চেক লুঙ্গি, লাল শার্ট পরা মোটা একটা লোক। লুকিয়ে লুকিয়ে দেখছে। তরুণী জানেও না তাঁকে কেউ চোরের মত এভাবে কেউ দেখছে।
হাসানের মাথা গরম হয়ে ওঠে। হয়তো বা বড়'পার সাথে মেয়েটার সাদৃশ্যের কারণে, বা আশেপাশে দম আটকানো বিশ্রী পরিবেশের কারণে, কিংবা তারুণ্য ও বিবেকের সম্মিলিত চাপের কারণে - কে জানে! কিন্তু হাসানের মাথা গরম হয়ে ওঠে। হাতের পেশি শক্ত হয়ে ফুলে ফুলে ওঠে। ভুলে যায়, সম্পূর্ণ অপরিচিত একটা জায়গায় আছে ও। মাথার মাঝে কেবল লোকটাকে শায়েস্তা করার কথা ঘুরতে থাকে বারবার। ও কোনমতে একটা শার্ট গায়ে দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে রাস্তায় নেমে আসে। আশেপাশে তাকিয়ে দেখতে পায় সেই লোকটাকে। দৃপ্ত পায়ে এগিয়ে যেতে থাকে তার দিকে।
কাছাকাছি পৌছাতেই তীব্র মদের গন্ধ পায় হাসান। শালা মাতাল মাতলামি করার আর জায়গা পাও না? ডান হাত মুষ্টি করে বড় বড় পদক্ষেপ নিয়ে এগোতে এগোতে সে ঠিক করে প্রথম ঘুষিটা দেবে চোয়ালে। লোকটার কাছাকাছি পৌঁছে ও থামে। লোকটাও শব্দ পেয়ে ঘুরে ওর দিকে তাকায়। বোঝাই যাচ্ছে রসভঙ্গ হওয়ায় বিরক্ত হয়েছে। ঘুষিটা দেবার আগে হাসান ভালো করে চেহারাটা দেখে। মাথায় টাক, পুরু কালো ঠোঁট। ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে পানের পিকের মত লাল একটা কিছু পড়ছে। মদের বাজে দুর্গন্ধ ভক ভক করে মুখ দিয়ে বেরোচ্ছে, কিন্তু সামান্যও টলছে না। পাকা মদারু বোধহয়। মোটা নাক, নাক থেকে বাম চোখের ওপর একটা আড়াআড়ি কাটা দাগ...
হঠাৎ করেই লোকটাকে চিনে ফেলে হাসান। বাড়িতে আগে কয়েকবার ইনি এসেছেন, যদিও অনেক বছর আগে, কিন্তু ওই কাটা দাগ ভোলার নয়। মুষ্টিবদ্ধ হাত শিথিল হয়ে স্বয়ংক্রিয়ভাবে কপালে লেগে যায়।
-'আসসালামু আলাইকুম, মিলন চাচা।'
মদ্যপ ব্যক্তি চোখ পিটপিট করে তাকায়। কিছুটা মদ্যপ কণ্ঠে সন্দেহের সুরে বলে, 'কে?'
-'আমি চাচা। রশিদ মিয়ার ছেলে, হাসান।'
এবারে লোকটার কণ্ঠ ম্যাজিকের মত পরিবর্তন হয়ে যায়। সহজ, প্রাণোচ্ছল, স্বাভাবিক।
-'ও, রশিদের ছেলে? তা এইখানে কেন তুমি? উঠছ কোথায়? আমার বাসায় গেছিলা?'
হাসান বলার চেষ্টা করে, 'চাচা আসলে...', কিন্তু তার আগেই লোকটা থামিয়ে দেয় ওকে, 'আইচ্ছা ঠিকাছে, কালকে সকালে তুমি বাসায় আস। তুমার চাকরি নিয়া কথা বলব নে। আর রাত্রে এইসব জায়গায় হাঁটাহাঁটি কইরো না, বুঝোনাই? জায়গাটা ভালো না। আজে বাজে মানুষের আখড়া। যাও তাইলে।'
এক কথায় কথোপকথনের ইতি টেনে দেয় লোকটা। তারপর হাসানের দিকে একদৃষ্টে তাকায়। হাসান বুঝতে পারল, তাঁকে ভদ্রভাবে ভেগে যেতে বলা হল। সে 'জী চাচা' বলে হোটেলের দিকে দুর্বলপায়ে হাঁটতে শুরু করল। হোটেলে ঢোকার আগে আরেকবার পেছনে তাকাল হাসান, দেখল লোকটা আগের মতই উঁকিঝুঁকি মারছে। তবে এবার নতুন জিনিস যোগ হয়েছে, তার হাতে একটা মোবাইল ফোন দেখা যাচ্ছে। পুরো বিষয়টা ভিডিও করছে সম্ভবত।
সামনে তাকিয়ে হাসান মনে মনে আউড়ে নেয়, 'চাকরি পেলে তাড়াতাড়ি ঋণ শোধাতে পারব, আব্বা একটু আরাম পাবে, কাজলকে ঢাকায় কলেজে পড়াতে পারব। চাকরি পেলেই...', মনে মনে কথাগুলো বারবার বলতে বলতে সে নিজের রুমে পৌঁছে যায়। জানালার কবাট বন্ধ করে দেয়। বিছানার ওপর থেকে টেবিল ফ্যানটা সরিয়ে চেয়ারে রাখে। তারপর বিছানায় শুয়ে পড়ে। ছারপোকার কামড় খেতে খেতে তার পিঠ ফুলে ওঠে, ঘামে শরীর ভিজে যেতে থাকে। ও নির্বিকার মুখে শুয়ে থাকে।
পোকার কামড় খেতে খেতে হাসানের কেন যেন কাফকার গল্পের কথা মনে পড়ে যায়, যেখানে মূল চরিত্রটি মানুষ থেকে একদিন হঠাৎ বিশাল এক পোকা হয়ে যায়।