আমি তখন NASA-এর প্লানেট ডিভিশনের চীফ ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করি। বাঙালী হিসেবে নাসা'তে তখন আমি একাই, অবশ্য পরে অনেকেই সেখানে গিয়েছে ।
দিনটি ছিল ৩০ সেপ্টেম্বর, রবিবার। টানা ১৩দিন নাসা'র বিজ্ঞানীদের দিন কি রাত বলে কিছু ছিলনা। উদ্বেগ, উৎকন্ঠায় প্রতিটা সেকেন্ড'কে যেন এক একটা বছরের মত লাগছিল। সারা বিশ্বের মিডিয়া, চ্যানেল, দেশ, মানুষ সব তখন নাসা'র দিকে তাকিয়ে। আমাদের প্রত্যেকটা সেকেন্ডের স্টেপ বাই স্টেপ লাইভ করে দেখানো হচ্ছিল।
কারণ, সেপ্টেম্বরের শুরুর দিকে নাসা'র পর্যবেক্ষণ দল জানতে পারে, মঙ্গল গ্রহ থেকে প্রায় আরো ৯১৩ আলোকবর্ষ দূর থেকে একটা ধূমকেতু ঘন্টায় ১১৩০০০ কিলো গতিবেগে পৃথিবী অভিমুখে আঘাত হানার জন্য আসছে। একজন বিজ্ঞাণী হিসেবে যেদিন আমি প্রথম এই কথাটি শুনেছিলাম সাধারণ মানুষের মত আমিও কথাটার তেমন গুরুত্ব দেইনি কারণ এ পর্যন্ত নাসা' অনেক কিছু বলেছে, অমুক তারিখে এটা হবে ওটা হবে কিন্তু হয়নি, তাই নাসা যখন কিছু বলে তখন সাধারণ মানুষ খুব সহজেই তা উড়িয়ে দেয়। কিন্তু চীফ হিসেবে আমার উড়িয়ে দেয়াটা যুক্তিসঙ্গত ছিল, কারণ ৯১৩ আলোকবর্ষ দূর থেকে যে ধূমকেতুটি পৃথিবীর দিকে আসছে তার আসতে সময় লাগবে প্রায় ১১৩ দিনের কিছু বেশী সময় কারণ ধূমকেতুটির গতিবেগ প্রতি সেকেন্ডে ১.৩ কিলো করে বাড়তে থাকে, আর এত দূর পথ আসতে মহাশূণ্যের বায়ুমন্ডলের তাপ ও ঘর্ষণে ধূমকেতুর নিজস্ব কিছু ক্ষয়ও রয়েছে, আর সেই ক্ষয় যদি হয় ধূমকেতুর যে আকার তার ১৩% তাহলে ওজন হ্রাস পাওয়া হালকা ধূমকেতুর পক্ষে অবিকল তার গতিপথ ঠিক রাখা সম্ভব নাও হতে পারে, সেক্ষেত্রে পৃথিবী অভিমুখে না হয়ে অন্য পথে তার অতিক্রম'টা ফিজিক্স বিদ্যায় খুব কঠিনভাবে সমর্থন করে।
কিন্তু সেবারই প্রথম, আমাদের সমস্ত যুক্তিবিদ্যা আর ফিজিক্স,ম্যাথের সব হিসেব ভূল করে ধূমকেতুর গতিপথ অবিকল পৃথিবী অভিমুখে থাকলো। আমি যে সময়কার কথা বলছি তখন পৃথিবী থেকে ধূমকেতুটির অবস্থান মাত্র ১.৩ আলোকবর্ষ দূরে। খুব বেশী হলে সর্বোচ্চ ১৩ দিন সময় আমাদের হাতে ছিল। পৃথিবীকে ধূমকেতুটির হাত থেকে রক্ষা করতে আমরা নাসার বিজ্ঞানীরা ততক্ষণে একটি মহাকাশযান তৈরী করেছিলাম, যেখানে অত্যন্ত শক্তিশালী আনবিক বোমা সংযুক্ত করা হয়েছিল। আর এই মহাকাশযানটির কাজ হল ঠিক সময়ে আনবিক বোমাগুলোকে ধূমকেতুর দিকে ছুড়ে দেয়া যাতে পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে ধূমকেতুটি আসার আগেই মহাশূণ্যে বিস্ফোরিত হয়। যদি ১ সেকেন্ডের হাজার ভাগের ১ ভাগও ভূল হয় তবে পৃথিবী নিশ্চিহ্ন হতে সেই সময়ের অনেক কম সময়ের প্রয়োজন হবে এবং মুহুর্তেই মহাশূন্যের বুক থেকে পৃথিবী নামক গ্রহটি চিরদিনের জন্য মুছে যাবে।
আমরা বিজ্ঞানীরা মহাকাশজানটির নাম দিয়েছিলাম 'saver'. সময়ের হিসেবে ৩০ সেপ্টেম্বর ছিল ধূমকেতুটির পৃথিবীতে আঘাতের দিন। আমরা ঠিক তার ৩১৩ ঘন্টা আগে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল থেকে ধূমকেতু অভিমুখে Saver কে যাত্রা করে দিলাম। পুরো বিশ্ব মিডিয়া তখন আমাদের দিকে তাকিয়ে। পৃথিবী বোধহয় কখনো এমন নিশ্বাস বন্ধ পরিস্থিতিতে কাটাইনি, শিশু থেকে বৃদ্ধ, যে যার ধর্মের সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করছিল যাতে পৃথিবীকে রক্ষা করা যায়।
আমাদের Saver স্বাভাবিক গতিতে এগিয়ে চলছিল, বিপত্তি ঘটলো ঠিক ধূমকেতু'তে আঘাত হানার ১১৩ ঘন্টা বাকী থাকতে, Saver এর ফোর্স স্টিমুলেশন প্যানেলের একটি ইলেকট্রিক সার্কিট ঠিকমত রেসপন্স করছিলো না, যেহেতু মহাকাশজানটি রোবট দ্বারা পরিচালিত ছিল তাই তাকে সংকেত পাঠানোর মাত্র ১৩ মিনিটেই সেটিকে তা সমাধান করতে পেরেছিল আর Saver তার পুরোনো স্বাভাবিক গতিতে চলতে থাকে।
শেষ দিন। সেদিন সকালের আকাশটাও ছিল অন্ধকার যেন দেখে মনে হবে আর কিছুক্ষণ বাদেই সন্ধ্যা নামবে। আমাদের প্রত্যেকটা বিজ্ঞাণীর চোখ তখন মনিটরে, saver এগিয়ে চলছে সবকিছু ঠিক থাকলে ঠিক ঘন্টা ২৪ পরই saver তার এ্যাটোমিক বোমার চেম্বার থেকে গোটা ১৩ বোমা ছুড়ে দেবে বিধ্বংসী ধূমকেতুটির দিকে। আমাদের কাউন্ড ডাউন শুরু হয়ে যায় সেকেন্ডের হিসেবে, এক এক সেকেন্ড করে কমতে থাকে আর সময় এগিয়ে যেতে থাকে এক অনিশ্চয়তার পথে।
১৩ ঘন্টা হাতে থাকতেই আমাদের শেষ মুহুর্তের রিপিট এন্ড ফাইনাল চেকিং শুরু হয়। ককপিট পোরশন, রোবটের টেম্পারেচার থেকে শুরু করে অটোমোটেড হুইল, গ্যাস চেম্বার, ফুয়েল, হিট এবজরবশন, প্রেসার সিন্ক্রোনাইজ, ওয়েভ ট্রান্সফিউশন এভাবে একে একে প্রত্যেকটা ডিভিশন থেকে ওকে রিপোর্ট আসতে থাকে, সবশেষে আমার 'প্লানেট' ডিভিশন। মাত্র তখন ১ঘন্টা ৩০ মিনিট বাকী, saver মিশনের চীফ উইলিয়াম থারটিন আমাকে ফোন দিয়ে জানতে চাইলেন "কেমন বোধ করছো" আমি নির্ভয়ে উত্তর দিলাম "সব ফাংশন ঠিক থাকলে আমাদের ভয় নেই" তিনি ফোন রাখার আগে বললেন "উইশ ইউ বেষ্ট লাক" এটা বলার কারণ saver এর ১৩টি এ্যাটোমিক বোমার চীফ অপারেটর আমি। কারণ বোমাগুলো ছুড়তে হবে কাটায় কাটায় লাস্ট সেকেন্ডে, এর হাজার ভাগের এক ভাগ সময়ও এদিক সেদিক করা যাবে না। আর এই বোমা ছোড়ার ঠিক লাস্ট সেকেন্ডে সেটাকে এক্টিভেট করার জন্য আমাকে এখান থেকে 4 ডিজিটের একটা পাসওয়ার্ড প্রেস করতে হবে যা saver এর ককপিটে থাকা রোবটিকে কনফারমেশন সিগন্যাল দিবে বোমাগুলোকে ব্যারেল বক্স থেকে প্রচুর প্রেসারে ধূমকেতুর দিকে আঘাত হানার জন্য। আর কোনভাবে পাসাওয়ার্ড টি প্রেস না হলে ব্যারেল থেকে একটি বোমাও বের হবে না।
১৩ মিনিট বাকী থাকতেই saver - এর ককপিটে থাকা রোবটিকে সচল করে দেয়া হয়েছিল, রোবটটি একে একে মহাকাশজানটির সব ইঞ্জিন রিসেট করছিল, গ্যাস চেম্বার থেকে প্রেসার সিন্ক্রোনাইজ করে সেটা পেছনের ফূয়েলের পোরশনে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছিল যাতে saver আঘাত হানার আগে তার গতি ধূমকেতুটির গতির দ্বিগুন হয়। ব্যারেল ডোর ততক্ষণে ওপেন করে দেয়া হয়েছিল ।
৫ মিনিট থেকে মাত্র ১সেকেন্ড কমে ৪ মিনিট ৫৯ সেকেন্ড, তৃতীয় বারের মত আমি আমার রুমে মনিটরের সামনে পাসওয়ার্ড টি মনে রাখার চেষ্টা করতে লাগলাম, কিন্তু এ কি ? কি হচ্ছে আমার ? পাসওয়ার্ড মনে পড়ছে না কেন ? ওয়ান, টু, থ্রী, ফোর ..... না না , ফোর, থ্রী, টু, ওয়ান ... না না, পাসওয়ার্ড কিছুতেই মনে পড়ছেনা। হাতের কাছে থাকা সব কমান্ড পেপার এক টানে সরিয়ে ফেললাম কিন্তু না পাসওয়ার্ডটি কোথাও লেখা নেই, আর এ পাসওয়ার্ড আমি ছাড়া আর কেউই জানে না।
মাথা মাথা নীচু করে শুধু একবার মনিটরের দিকে তাকানোর সুযোগ পেয়েছিলাম ৪ মিনিট ০১ সেকেন্ড, ঠিক তখনই উইলিয়ামের ফোন "ইউ রেডী ? " আমার তখন কথা বলার কোন শক্তি ছিলনা। কারণ যেখানে পৃথিবীকে রক্ষা করার এই মিশন আর যার মূল ফাংশান কমান্ড আমার কাছে আর ঠিক কয়েক মিনিট আগে পাসওয়ার্ড মনে করতে না পারার এই ম্যাসেজটি উইলিয়ামকে দেবার কোন মানসিক শক্তি আমার ছিলনা। উইলিয়াম এবার জোড়ে ম্যাসেজ রিপিট করলো "ইউ রেডী ?" কোনভাবে মিথ্যে বলেছিলাম "ইয়েস রেডী"
আমার হাতের একটা শিরা নীল দেখতে পেয়েছিলাম, বুঝতে পারছিলাম আমার শরীর অবশ হয়ে আসছে, সামনের দৃশ্যগুলো ক্রমশ আমার কাছে কেমন ঝাপসা হতে লাগল, সামনে রাখা কি বোর্ডের এন্টার বাটনের দিকে হাত বাড়ানোর কোন শক্তিই যেন আমি পাচ্ছিলাম না। ঠিক সে সময়টা আমি ভেবে নিলাম যতক্ষণ বেঁচে আছি কোনভাবেই নিজেকে দূর্বল হতে দেবোনা, ততক্ষণে নাসা'র সেন্ট্রাল সাউন্ড সিস্টেম এ্যাক্টিভ হয়ে গেছে, লাস্ট মিনিট, সাউন্ড সিস্টেমে সেকেন্ড 59, 58, 57 ........ শোনা যাচ্ছিল।
চোখ বন্ধ করে এক মুহুর্তের জন্য পাসওয়ার্ডটি শেষ বারের মত মনে করার চেষ্টা করতে লাগলাম। শুধু একটা বাচ্চার ছবি ভয়ে মা'কে জড়িয়ে আছে আর সকালে দেখা কয়েকটি অনলাইন পত্রিকার হেড লাইন "Today is the Last Day" "Last day of the universe" "Bye Bye the world"
ঠিক তখনই ডেস্কের পাশে রাখা আমার মোবাইল ফোনে রিং বেজে উঠলো, চোখ খুলে তাকাতেই যে কল করেছিলো মোবাইল স্ক্রীণে শুধু তার নামটি দেখতে পেয়েছিলাম, সাউন্ড সিস্টেমে তখন সেকেন্ড 11, 10, ....... মাত্র ৯ সেকেন্ড বাকী, মনে পড়ে গেল পাসওয়ার্ডটি। কিবোর্ডে ৪ ডিজিটের পাসওয়ার্ড টাইপ করাও শেষ ঠিক তখনই সেকেন্ড 1 এন্ড 0, সাথে সাথেই এন্টার ! শুধু একটা বীপ তার ঠিক এক সেকেন্ড পর "ম্যাসেজ সেন্ড ওকে, saver এক্টিভেটেড এন্ড হিট টার্গেট "
নাসা'র কন্ট্রোল রুমে কোন জানালা থাকেনা, তাই বাইরে লাগানো সিসি ক্যমেরায় যতটুকু আকাশ দেখা যায় তাতে মনে হয়েছিল আকাশের দূরে কোথাও আতশবাজির কোন একটা গুদাম ঘরে কেউ আগুন দিয়েছে। সারা পৃথিবীর মানুষ তখন রাস্তায় নেমে পড়েছে, চিৎকার, চেঁচামেচি, এ ওকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে, কয়েকটা শিশুর হাতে প্লাকার্ড "Thanks NASA; Thanks our Creator" টেলিভিশনের পর্দায় যখন এ দৃশ্যগুলো দেখছিলাম কখন যে পেছন থেকে উইলিয়াম এসে কাধেঁ হাত রেখেছে খেয়াল করিনি, হ্যান্ডশেক করে শুধু বললো "ব্রাভো ম্যান, ইউ আর হিরো"
হঠাৎ মনে পড়লো, মোবাইলের রিং-এর কথা। ফাইনাল মিশনের ঠিক কয়েক সেকেন্ড আগের যে কলটি সেদিন পুরো পৃথিবীকে বাচিয়েঁ দিয়েছিল । যে কলটি না আসলে হয়তো কখনোই আর মনে পড়তোনা পাসওয়ার্ডটি। কলটি দিয়েছিল আমার প্রিয় মানুষ আর সেই মানুষটির নামই ছিল "SAVER" মিশনের পাসওয়ার্ড।
Password : M i L i