এই বিশেষ রাতের ব্যাপারে কুরআনে তেমন কোনো উল্লেখ পাওয়া যায় না। তবে, সিয়াহ সিত্তাহ বা বিশুদ্ধ ছয়খানা হাদিস গ্রন্থের কোনো কোনো হাদিসে এই রাতের বিশেষত্ব নির্দেশক হাদিস বর্ণিত হয়েছে। এছাড়াও অন্যান্য হাদিস গ্রন্থেও এই রাতের বিশেষত্বের উল্লেখ পাওয়া যায়। এই রাতের কথা ইমাম তিরমিযী কর্তৃক বর্ণিত হাদিসে পাওয়া যায়, ঐ হাদিস মতে, এক রাতে ইসলামের নবী হযরত মুহাম্মদের(সাঃ) স্ত্রী মা আয়েশা ঘুম থেকে উঠে পড়লেন কিন্তু হযরত মুহাম্মদ(সাঃ)কে বিছানায় দেখতে পেলেন না। তিনি হযরত মুহাম্মদকে(সাঃ) খুঁজতে বের হলেন এবং তাঁকে জান্নাতুল বাকি কবরস্থানে দেখতে পেলেন।হযরত মুহাম্মদ(সাঃ) বললেন, ১৫ শাবানের রাতে আল্লাহ সর্বনিম্ন আকাশে নেমে আসেন এবং [আরবের] কালব্ উপজাতির ছাগলের গায়ের পশমের থেকে বেশি লোককে কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা করেন। উল্লেখ্য, সেসময় কালব্ গোত্র ছাগল পালনে প্রসিদ্ধ ছিল এবং তাদের প্রচুর ছাগল ছিল। এই হাদিসের নিচে ইমাম তিরমিযী উল্লেখ করেন, "হযরত আবু বকরও [রা.] এরূপ হাদিস বর্ণনা করেছেন বলে জানা যায়।
ইদানিং ইন্টারনেট এর বিভিন্ন সাইট এবং ব্লগে কতিপয় চিহ্নিত ব্লগার ইচ্ছেমত পবিত্র শবে বরাত এর বিরুদ্ধে লিখে যাচ্ছে। যা সৌদী ওহাবী ইবনে বাজ তাদের অনুসারীদের মনগড়া ব্যাখ্যা বিশ্লেষন মাত্র। বিপরীতে আমাদের দেশসহ বিশ্বের বিভিন্নস্থানে যারা শবে বরাত উৎযাপন করেন তাদেরকে ভন্ড দেওয়ানবাগী পীর ও মাজার পূজারীদের অনুসারী বলে প্রচার করা হচ্ছে।
এদের এসব প্রতারনাপূর্ন কথাবার্তায় অনেক সাধারন সুন্নী মুসলিম ব্লগার বিভ্রান্ত হয়ে তারা পবিত্র শবে বরাত এর নিয়ামতকে পরিত্যাগ করছে। তাদের সঠিক বুঝের জন্য আমি এখানে বাংলাদেশে দেওবন্দী কওমী আলেমরা এ বৎসর পবিত্র শবে বরাত প্রসঙ্গে কি বলেছেন সেটা উল্লেখ করে প্রশ্ন রাখছি- এরাও কি ভন্ড দেওয়ানবাগী পীর ও মাজারপূজারী কি-না
১. বাংলাদেশে দেওবন্দী কওমীদের সবচাইতে বড় মাদ্রাসা হাটহাজারীর মুখপত্রের জুলাই/২০১১এর ১৩-১৪ পৃষ্ঠায়,“ক্ষমা ও মার্জনায় মহিমান্বিত রাত শবে বরাত” শিরোনামে লিখা হয়েছে-
অসীম কল্যানে ভরপুর এই শবে বরাত রজনী বান্দার জন্য মহান আল্লাহর বিশেষ এক নিয়ামত। কোন কোন মহল এ রাতের ফজীলতকে অস্বীকার করতে লাগলো। এসব লোক চরম ভূল ভ্রান্তির শিকার। হাদীস শাস্ত্র সম্পর্কে তাদের অজ্ঞতা ও অনভিজ্ঞতাই সে ভূল ধারনার একমাত্র কারন। উপমহাদেশের বিখ্যাত হাদীস ব্যাখ্যাকার আল্লামা আনোয়ার শাহ কাশ্মিরী (রহ) বলেন- এটা লাইলাতুল বরাত, এ রাতের ফজীলত সম্পর্কীয় হাদীসগুলো সহীহ তথা নির্ভরযোগ্য।(আরফুশ শাযী শরহে তিরমিযী,পৃষ্ঠা-১৫৬)
২. দেওবন্দী কওমীদের অন্যতম মুরুব্বী মাওলানা মাহিউদ্দীন খান তার মাসিক মদীনায় জুলাই/২০১১ এর ৪১পৃষ্ঠায় “আল-কুরআনে শব-ই-বরাত: একটি বিশ্লেষন” শিরোনামে লিখেছে-
সুরা দুখানের লাইলাতুম মুবারকা শব্দের সংখ্যাতাত্ত্বিক বিশ্লেষন করলে দেখা যায় যে, সুরা দুখান কুরআনের ১ম থেকে ৪৪নং সুরা। ৪৪ এর অঙ্কদ্বয়ের সমষ্টি ৪+৪=৮; ৮দ্বারা বুঝায় ৮ম মাস অর্থাৎ শাবান মাসে লাইলাতুম মুবারকা অবস্থিত। আবার কুরআনের শেষ থেকেও সুরা দুখান ৭১ নং সুরা। ৭১ অঙ্কদ্বয়ের সমষ্টি ৭+১=৮, পুনরায় ৮ম মাসের দিকেই ইঙ্গিত করে। আবার এ সুরার প্রথম থেকে ১৪টি হরফ শেষ করে ১৫তম হরফ থেকে লাইলাতুম মুবারকায় কুরআন নাযিল সংক্রান্ত আয়াত শুরু হয়েছে। এটা ইঙ্গিত করে যে, ঐ ৮ম মাসের ১৪ তারিখ শেষ হয়ে ১৫তারিখ রাতেই লাইলাতুম মুবারকা। এই সংখ্যাতাত্ত্বিক বিশ্লেষন প্রমান করে, সুরা দুখানে বর্নিত লাইলাতুম মুবারকা ১৪ই শাবান দিবাগত ১৫ই শাবানের রাত। অর্থাৎ লাইলাতুল বারাআত বা শব-ই-বারাআত। এছাড়া মুফাসিসরীনদের বিশাল এক জামাত দাবী করেছেন, সুরা দুখানে বর্নিত যে রাতকে লাইলাতুম মুবারকা বলা হয়েছে তা অবশ্যই শব-ই-বরাত। (ইমাম কুরতবী, মোল্লা আলী কারী (রহ), বুখারী শরীফের সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষ্যকার হাফিজুল হাদীস আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানী রহ; এবং হাম্বলী মাজহাবের অন্যতম ইমাম বড়পীর আব্দুল কাদির জিলানী রহমাতুল্লাহি সহ আরো অনেকে এ বিষয়ে একমত)
৩. দেওবন্দী কওমীদের অন্যতম মুখপত্র মাসিক আল জামিয়া এর জুলাই/২০১১ সংখ্যায় “লাইলাতুল বারাআত: করনীয়-বর্জনীয়” শিরোনামে প্রকাশিত আর্টিকেলে লিখেছে-
শবে বরাতের ফজীলত হাদীস শরীফ দ্বারা ছাবেত তথা প্রমানিত নয়, এ কথা বলা সঠিক নয়, বরং বাস্তব কথা হলো দশ জন সাহাবী রা; থেকে বর্নিত হাদীসে রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে এ রাতের ফজীলত সম্পর্কে বর্ননা পাওয়া যায়। সঠিক কথা হলো, এ রাত হলো ফজীলতের রাত। এ রাতে জাগ্রত থেকে ইবাদত করা সওয়াব ও পূন্যের কাজ, যার অনেক গুরুত্ব কুরআন ও হাদীস পাকে রয়েছে। (বায়হাকী, মিশকাত ১ম খন্ড)
৪. বাংলাদেশে দেওবন্দীদের অন্যতম প্রধান মুরব্বী ভারতের মাওলানা আশরাফ আলী থানবী সাহেবের প্রধান খলীফা মুজহিদে আযম মাওলানা সামসুল হক ফরীদপুরী সাহেব প্রতিষ্ঠিত মুখপত্র মাসিক আল আশরাফ এর জুলাই/২০১১ সংখ্যায় “শবে বরাত নিয়ে প্রান্তিকতা” শীর্ষক আর্টিকেলে লিখা হয়েছে-
শবে বরাত সম্পর্কিত হাদীস বেশ কয়েকজন সাহাবায়ে কিরাম থেকে বিভিন্ন সুত্রে বর্নিত হয়েছে। এ জন্য এসব হাদীসকে দুর্বল অনির্ভরযোগ্য বলে অস্বীকার করার আদৌ কোন সুযোগ নেই। হাদীস দ্বারা শবে বরাত প্রমানিত এটা কিন্তু স্বীকার করতেই হবে। এক শ্রেনীর মুসলমান রয়েছেন যারা শবে বরাতের ফজীলত শ্রেষ্ঠত্বের কথা স্বীকারই করেন না। এটা মারাতœক প্রান্তিকতা যা অতি জগন্য ব্যাপার।
৫. বাংলাদেশে দেওবন্দী কওমী আলেমদের শায়খুল হাদীস বলে পরিচিত মাওলানা আযীযুল হকের মুখপত্র মাসিক রাহমানী পয়গাম জুলাই/২০১১ সংখ্যায়, “শবে বরাত; জীবন বদলে যাক মুক্তির আনন্দে” শিরোনামের আর্টিকেলে লিখা হয়েছে-
এক শ্রেনীর লোক মনে করে, শবে বরাতের কোন অস্তিত্বই নেই ইসলামে। ইসলামের সঠিক দৃষ্টিবঙ্গি কি তা আমাদের জানা দরকার। কুরআন হাদীসের বক্তব্য থেকে জানতে পারি, চৌদ্দই শাবান দিবাগত রাতটি অত্যন্ত বরকতময় মহিমান্বিত এক রজনী। যাকে অবহিত করা হয় শবে বরাত নামে। শব্দটির অর্থ হচ্ছে মুক্তির রজনী। এ রাতে মহান রাব্বুল আলামীন রহমতের দৃষ্টি দেন, দয়ার সাগরে ঢেউ উঠে, মাগফিরাতের দ্বার উম্মোচিত হয় পাপি-তাপি সকল বান্দার জন্য।
৬. দেওবন্দী কওমী আলেমদের চট্টগ্রাম ভিত্তিক মুখপত্র মাসিক দাওয়াতুল হক জুলাই/২০১১ সংখ্যায় “শবে বারাআত; কয়েকটি তাহক্বীকি মাসআলা” শিরোনামে লিখা হয়েছে-
সহীহ হাদীস থাকা অবস্থায় শবে বরাতের ফজীলত ও গুরুত্বকে সম্পূর্ন অস্বীকার করা এবং এ সংক্রান্ত সকল বর্ননাকে মওজু বা জয়ীফ বলা কত যে বড় অন্যায়, তা তো বলাই বাহুল্য। শবে বরাতের গুরুত্ব ও ফজীলত প্রমানিত হওয়ার জন্য হযরত মুয়াজ ইবনে জাবাল রাদিয়াল্লাহু তায়ালা বর্নিত একটি হাদীস শরীফই যথেষ্ট। যদিও হাদীসের বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য কিতাব থেকে এ বিষয়ক আরো হাদীস উল্লেখ করা সম্ভব।
৭. দেওবন্দীদের অন্যতম মুখপত্র মাসিকত আন নাবা এর জুলাই/২০১১ সংখ্যার ৭ পৃষ্ঠায় হাকিমুল উম্মাতে কওমীয়া মাওলানা আশরাফ আলী থানবী সাহেব র্কতৃক পবিত্র শবে বরাত এর হাদীস শরীফ নিয়ে সরাসরি সংগৃহিত একটি লিখা- “ক্ষমা ও বিপদমুক্তির রাত ১৫ শাবান” শিরোনামে পত্রস্থ হয়েছে।
৮. বর্তমান বিশ্বে দেওবন্দী কওমী আলেমদের সবচাইতে বড় মাওলানা এবং সৌদী রাজ র্কতৃক প্রকাশিত তাফসীরে মায়ারেফূল করআন এর লিখক মূফতী শফী সাহেব এর পুত্র বিচারপতি তাকী উসমানী সাহেব “শবে বরাত হাকিকত স›দ্ধানে” শিরোনামের আর্টিকেলে লিখেছে-
মুসলিম উম্মাহর যে কালটিকে খায়রুল কুরুন বা সর্বশ্রেষ্ঠকাল হিসেবে স্মরন করা হয় সেটা হলো সাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈন ও তাবে তাবেঈনের কাল। অথচ আমরা লক্ষ্য করলে দেখি, উম্মাহর এই শ্রেষ্ঠকালেও আমাদের পূর্বসুরী বুর্জুগানে দ্বীন শবে বরাতের ফজীলত লাভে যথেস্ট যত্নবান ছিলেন। ধর্মপ্রান মুসলমানগন এ রাতে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে ইবাদত বন্দেগী করতেন। সুতরাং এ রাতের ইবাদতকে বেদাত বলা বা ভিত্তিহীন বলা কোনক্রমেই সঙ্গত নয়। বরং বাস্তবতার আলোকে স্বীকার করতেই হবে এটি একটি ফজীলতপূর্ন রাত। এ রাতে জাগ্রত থাকা, ইবাদত বন্দেগী করা পুন্যময় কাজ। (সুত্র; মাসিক মদীনার পয়গাম, জুলাই/২০১১ঈসায়ী।)
সংগ্রিত
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা জুন, ২০১৫ সকাল ৮:৩৭