ভারত, নেপাল ও ভুটান থেকে জলবিদ্যুৎ আমদানি সম্পর্কে কথা বলার আগে, আমাদের আসলে হিমালয় অঞ্চলে জলবিদ্যুতের উন্নয়নের বৃহত্তর চিত্রটি দেখতে হবে।
হিমালয়ের বরফ-বেল্টকে সাধারণত "এশিয়ার পানির টাওয়ার" নামে ডাকা হয়, এটি মহাদেশের বেশিরভাগ অংশের জন্য পানি, খাদ্য এবং পরিবেশগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। হিমালয় পর্বতমালা দশটি প্রধান নদী ব্যবস্থার উত্স যা এশিয়া জুড়ে দুই বিলিয়ন লোকের জন্য পানি সরবরাহ করে পাশাপাশি এটি খাদ্য উত্পাদন এবং অন্যান্য বাস্তুতন্ত্রের একটি লাইফ লাইন। হিমালয়ের হিমবাহগুলি অ্যান্টার্কটিক এর পরে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম কুলিং টাওয়ার হিসাবেও কাজ করে। প্রায় ৩৫০০০ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত ১৮০৬৫ টি হিমবাহ প্রায় ৩৭৩৫ ঘন কিলোমিটার বরফ ধারণ করে। এটি বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম হিমবাহের স্থান। চীনা বিজ্ঞানীদের একটি স্টাডিতে দেখা যায় হিমবাহগুলির ৯৫% ই ক্রমান্বয়ে ছোট হয়ে যাচ্ছে এবং হিমালয়ের পানির পরিমান কমে যাচ্ছে। হিমালয় পর্বতমালার তুষার রেখার নীচে, স্পঞ্জ-সদৃশ পর্বতগুলি আনুমানিক ১২০০০ ঘন কিলোমিটার পরিমাণে মিঠা পানি ধারণ করে। শীতকালে হিমবাহ গলে না; এটি সারা বছর ধরে ধীরে ধীরে বয়ে যাওয়া হিমালয়ের নদীগুলিকে জারি রাখে।
চিত্র-১: হিমালয়ের বরফ-বেল্ট
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সাথে সাথে ভারতের বিশাল অর্থনীতিকে খাওয়ানোর জন্য সম্পদের প্রয়োজন বাড়ছে। হিমালয়ের বরফ বলয়, যার ২০০ গিগাওয়াটেরও বেশি জলবিদ্যুৎ পটেনশিয়াল রয়েছে, ভারতের জন্য দ্রুত বিদ্যুৎ এবং পানি সম্পদ আহরনের ক্ষেত্র হয়ে উঠছে। ভারত সরকার তার বৈদ্যুতিক গ্রিড এবং আন্ত-নদী সংযোগ প্রকল্পগুলিকে একযোগে দেশের বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে এবং জল-সমৃদ্ধ অঞ্চল থেকে শুষ্ক অঞ্চলে জলের সংস্থানগুলিকে প্রসারিত করছে। এই উভয় উদ্দেশ্যের জন্য "বাঁধ" একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
হিমালয়ের ২০০+ গিগাওয়াট হাইড্রো পটেনশিয়ালের প্রায় অর্ধেক ব্রহ্মপুত্র নদী অববাহিকায় বিদ্যমান যা শিলিগুড়ি করিডোর থেকে ভারতের অরুণাচল প্রদেশের পূর্ব প্রান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত (এর মধ্যে সিকিমে ৮ গিগাওয়াট, ভুটানে ২৪ গিগাওয়াট এবং ভারতের ৬৬ গিগাওয়াট যার মধ্যে ৫০ গিগাওয়াটই আছে অরুণাচল প্রদেশে)। ব্রহ্মপুত্র নদীর অববাহিকা, অসংখ্য উপনদী দ্বারা গঠিত (যার বেশির ভাগই সিকিম, ভুটান এবং অরুণাচলের মধ্য থেকে উৎপন্ন) এর প্রায় সমস্ত পানি বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়। একারণে এটিকে বাংলাদেশের জন্য পানির প্রাথমিক উৎস হিসাবে বিবেচনা করা হয়। ব্রহ্মপুত্র নদের অববাহিকা থেকে পানি প্রবাহ বাংলাদেশের মত একটি ছোট দেশের বিশাল জনসংখ্যার বেচে থাকার প্রধান উৎস। এইজন্য বাংলাদেশের উজানে বাঁধ নির্মাণের যে কোনও কার্যকলাপ একটি গুরুতর উদ্বেগের বিষয় কারণ এতে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ, ভূগর্ভস্থ পানির রিচার্জ, সেচ, লবণাক্ততা দূরীকরণ, নদীভিত্তিক বাণিজ্য ও পরিবহন, সারাদেশের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ, মৎস্যসম্পদ, এবং পরিবেশকে প্রভাবিত করবে। এছাড়াও আকস্মিক বন্যা এবং চরম খরা বাড়তে থাকবে যা বাংলাদেশের অর্থনীতি ও পরিবেশকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
চিত্র-২: ব্রহ্মপুত্র নদের অববাহিকা
বর্তমানে ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার পশ্চিম কোণে ভারত সরকারের জলবিদ্যুৎ নদী সংযোগ প্রকল্পগুলোর অধিকাংশ বাস্তবায়িত হয়েছে যা প্রধানত তিস্তা নদীকে প্রভাবিত করছে। ভারতের সিকিম বিদ্যুৎ বোর্ডের প্রায় ১৮-২০ টি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প তিস্তা নদীর প্রায় অর্ধেক পানি আটকে রাখে এবং অবশিষ্ট পানি গজলডোবা ব্যারেজে আটকা পড়ে এবং সেখান থেকে সেচের জন্য পশ্চিমবঙ্গে নিয়ে যাওয়া হয়। ফলে এটি বাংলাদেশের বৃহত্তর রংপুর অঞ্চলে শুষ্ক মৌসুমে পানির সংকট সৃষ্টি করে এবং বর্ষাকালে আকস্মিক বন্যার কারণ হয়। যদি ভারত সরকার এই জলবিদ্যুৎ নদী সংযোগ প্রকল্পগুলোর আওতা সিকিম থেকে ব্রহ্মপুত্র অববাহিকা বরাবর আরও পূর্ব দিকে বিস্তৃত করতে থাকে, তাহলে তিস্তার সমান্তরাল নদীগুলিও তিস্তার মত ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং বাংলাদেশের পানি সংকটের আয়তন এবং তীব্রতা বৃদ্ধি পেতে থাকবে।
ভারতের মূল ভূখণ্ডের নাগালের মধ্যে হিমালয়ের বরফ বলয়ের বেশিরভাগ জলবিদ্যুৎ পটেনশিয়াল ইতিমধ্যেই কাজে লাগানো হয়েছে (উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলি ছাড়া)। বর্তমানে ভারতের মোট জলবিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় ৪৬ গিগাওয়াট, যার বেশিরভাগই আসে সিন্ধু নদীর অববাহিকা থেকে। চিন সরকারের মদদে নেপালের মাওবাদিদের হাইড্রো পলিটিকস এবং শিলিগুরি করিডোরের দুর্গমতার কারণে সিন্ধু অববাহিকা ছাড়া হিমালয়ের বাদবাকি জলবিদ্যুৎ পটেনশিয়ালের খুব কম অংশই ভারত এখন পর্যন্ত তাদের জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করতে পেরেছে। নেপালের বেশিরভাগ হাইড্রো সম্ভাবনা (আনুমানিক ৮০ গিগাওয়াট) এখনও অব্যবহৃত। বর্তমানে, নেপালের জলবিদ্যুৎ ক্ষমতা প্রায় ১.১ গিগাওয়াট এবং বেশ কয়েকটি জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র উন্নয়নের বিভিন্ন পর্যায়ে রয়েছে। ভুটানের ২৪ গিগাওয়াট জলবিদ্যুতের সম্ভাবনা রয়েছে যার মধ্যে ২.৩ গিগাওয়াট ইতিমধ্যেই ব্যবহার করা হয়েছে এবং অন্যান্য বেশ কয়েকটি জলবিদ্যুত প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন রয়েছে।
বর্তমানে ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার পশ্চিম কোণে ভারত সরকারের জলবিদ্যুৎ নদী সংযোগ প্রকল্পগুলোর অধিকাংশ বাস্তবায়িত হয়েছে যা প্রধানত তিস্তা নদীকে প্রভাবিত করছে। ভারতের সিকিম বিদ্যুৎ বোর্ডের প্রায় ১৮-২০ টি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প তিস্তা নদীর প্রায় অর্ধেক পানি আটকে রাখে এবং অবশিষ্ট পানি গজলডোবা ব্যারেজে আটকা পড়ে এবং সেখান থেকে সেচের জন্য পশ্চিমবঙ্গে নিয়ে যাওয়া হয়। ফলে এটি বাংলাদেশের বৃহত্তর রংপুর অঞ্চলে শুষ্ক মৌসুমে পানির সংকট সৃষ্টি করে এবং বর্ষাকালে আকস্মিক বন্যার কারণ হয়। যদি ভারত সরকার এই জলবিদ্যুৎ নদী সংযোগ প্রকল্পগুলোর আওতা সিকিম থেকে ব্রহ্মপুত্র অববাহিকা বরাবর আরও পূর্ব দিকে বিস্তৃত করতে থাকে, তাহলে তিস্তার সমান্তরাল নদীগুলিও তিস্তার মত ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং বাংলাদেশের পানি সংকটের আয়তন এবং তীব্রতা বৃদ্ধি পেতে থাকবে।
ভারতের মূল ভূখণ্ডের নাগালের মধ্যে হিমালয়ের বরফ বলয়ের বেশিরভাগ জলবিদ্যুৎ পটেনশিয়াল ইতিমধ্যেই কাজে লাগানো হয়েছে (উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলি ছাড়া)। বর্তমানে ভারতের মোট জলবিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় ৪৬ গিগাওয়াট, যার বেশিরভাগই আসে সিন্ধু নদীর অববাহিকা থেকে। চিন সরকারের মদদে নেপালের মাওবাদিদের হাইড্রো পলিটিকস এবং শিলিগুরি করিডোরের দুর্গমতার কারণে সিন্ধু অববাহিকা ছাড়া হিমালয়ের বাদবাকি জলবিদ্যুৎ পটেনশিয়ালের খুব কম অংশই ভারত এখন পর্যন্ত তাদের জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করতে পেরেছে। নেপালের বেশিরভাগ হাইড্রো সম্ভাবনা (আনুমানিক ৮০ গিগাওয়াট) এখনও অব্যবহৃত। বর্তমানে, নেপালের জলবিদ্যুৎ ক্ষমতা প্রায় ১.১ গিগাওয়াট এবং বেশ কয়েকটি জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র উন্নয়নের বিভিন্ন পর্যায়ে রয়েছে। ভুটানের ২৪ গিগাওয়াট জলবিদ্যুতের সম্ভাবনা রয়েছে যার মধ্যে ২.৩ গিগাওয়াট ইতিমধ্যেই ব্যবহার করা হয়েছে এবং অন্যান্য বেশ কয়েকটি জলবিদ্যুত প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন রয়েছে।
চিত্র-৩: নিম্নলিখিত মানচিত্রটি হিমালয়ের বরফ বেল্ট বরাবর জলবিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের একটি সামগ্রিক দৃশ্য দেখায়।
ভারতের অরুণাচল প্রদেশ ব্রহ্মপুত্র নদের ৬০% পানির উৎস এবং একারণে এই প্রদেশের জলবিদ্যুৎ পটেনশিয়াল অত্যন্ত সমৃদ্ধ (এর পরিমান ৫০ গিগাওয়াটেরও বেশি, যা ভারতের মোট জলবিদ্যুৎ পটেনশিয়ালের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ) এবং এই অরুণাচল প্রদেশে ভারত সরকার ১৫০ টিরও বেশি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণের পরিকল্পনা করেছে (চিত্র-৪)। এই বিশাল জলবিদ্যুৎ পটেনশিয়ালকে কাজে লাগাতে, ব্রহ্মপুত্র অববাহিকা থেকে (প্রধানত অরুণাচল এবং ভুটান) ভারতের মূল ভূখণ্ডের দিকে তারা বেশ কয়েকটি উচ্চ-ক্ষমতার বৈদ্যুতিক সঞ্চালন লাইনের পরিকল্পনাও করেছে (চিত্র-৫)। শিলিগুড়ি করিডোরের কৌশলগত বাধা (The Chicken's Neck) ভারতকে বাংলাদেশের ভূখণ্ডের উপর দিয়ে বিদ্যুৎ করিডোরের জন্য আগ্রহী করছে। এছাড়াও শিলিগুড়ি করিডোর ইতিমধ্যেই শিলিগুড়ি শহর, প্রচুর রেল, রাস্তা, বিদ্যুতের লাইন এবং পানির খালের কারনে ঘিজি হয়ে গেছে। প্রাথমিকভাবে, ভারত বেশ কয়েকটি বিকল্পের উপর ভিত্তি করে বাংলাদেশের ভূখণ্ডের মধ্য দিয়ে একটি উচ্চ- ক্ষমতার ৮০০ কিলো ভোল্ট ডিসি লাইন নির্মাণের প্রস্তাব করেছিল (চিত্র-৬), পরে এই ডিসি লাইনের পরিবর্তে বরনগর থেকে একটি উচ্চ-ক্ষমতার ৭৬৫ কিলো ভোল্ট এসি লাইনের প্রস্তাব করা হয়েছিল। যা ভারতের বরনগর থেকে বাংলাদেশের পার্বতীপুর হয়ে আবার ভারতের কাতিহার পর্যন্ত নির্মান করার কথা। এই লাইনটি নিয়ে বর্তমানে ফিজিবিলিটি স্টাডি হচ্ছে বলে জানা যায়।
চিত্র-৪: অরুণাচলের বেসিন-ভিত্তিক জলবিদ্যুৎ পটেনশিয়াল।
চিত্র-৫: অরুণাচল প্রদেশের জলবিদ্যুৎ কিভাবে ভারতের মূল ভূখন্ডে নেয়া হবে তার মাস্টার প্ল্যান
চিত্র-৬: ভারতের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের ভূখণ্ডের উপর দিয়ে বিদ্যুৎ করিডোর লাইন নেয়ার জন্য প্রাথমিক প্রস্তাব।
CNA (সেন্টার ফর ন্যাভাল এনালাইসিস, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রতিষ্ঠান) দ্বারা পরিচালিত ২০১৬ সালের একটি স্টাডির ফলাফলে দেখা যায়, শুষ্ক মৌসুমে (নভেম্বর-মে) যমুনা নদী থেকে বাংলাদেশের জাতীয় প্রবাহের প্রয়োজন (নভেম্বর-মে) ২১০০০০ কিউসেক, ২০১৬ সালের হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশ এর থেকে ২৫% কম পানি পেয়েছে। শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশের নদীর পানির ৬৫% উৎস হল যমুনা নদী। CNA সমীক্ষায় বলা হয়েছে যে ব্রহ্মপুত্রের পানির সরবরাহ ঘাটতির কারণে বাংলাদেশ ২০১৬ সালেই মানর নিরাপত্তার চাপের সম্মুখীন ছিল যা বাংলাদেশের উজানে আরও বাঁধ নির্মাণ এবং পানির অপসারণ কার্যক্রমের ফলে আরও তীব্র হবে।
যেহেতু ভারত হিমালয়ের বরফ বেল্ট থেকে যে জলবিদ্যুৎ সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পারে তার অর্ধেকই শিলিগুড়ি করিডোরের পূর্বে, তাই স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশের ভূখণ্ডের মধ্য দিয়ে ভারতের উচ্চ ক্ষমতার বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইনের প্রয়োজন হবে। বাংলাদেশ যদি ভারত, নেপাল ও ভুটান থেকে জলবিদ্যুৎ আমদানিতে জড়িত হওয়ার নামে ভারতকে বৈদ্যুতিক করিডোর লাইন দিয়ে বসে, তাহলে বাংলাদেশ ভয়ংকর সংকটে পড়বে।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:১৯