মেয়ে ঐশী রহমানের বন্ধুদের হাতে খুন হন পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের (এসবি) ইন্সপেক্টর মাহফুজুর রহমান ও তার স্ত্রী স্বপ্না রহমান। আর হত্যার নির্দেশ দেয় ঐশী নিজেই। হত্যাকাণ্ডে চার থেকে পাঁচ জন বন্ধু অংশ নেয় বলেও পুলিশের কাছে স্বীকার করেছে ঐশী। বাবা-মাকে যখন হত্যা করা হয়, তখন ঐশী নিজেও উপস্থিত ছিল।ঘটনার পর রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হওয়া ঐশী রহমান গতকাল নিজ থেকেই পুলিশের কাছে ধরা দিয়ে খুনের সেই নৃশংস ঘটনা বর্ণনা করে। সে পুলিশকে আরও বলেছে, তার বাবা-মায়ের খাবারের সঙ্গে আগেই চেতনানাশক ওষুধ মেশানো হয়। ওই খাবার খেয়ে মাহফুজ দম্পতি যখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, তখনই তাদের কুপিয়ে হত্যা করা হয়। গোয়েন্দা দফতরে ঐশীকে জিজ্ঞাসাবাদে তার মাদকাসক্তির বিষয়টি নিশ্চিত হন গোয়েন্দারা। ঐশীর দেওয়া তথ্য মতে গোয়েন্দা পুলিশ রাজধানীর গেণ্ডারিয়া, বাসাবো, ওয়ারীসহ বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে কাজের মেয়ে সুমিসহ পাঁচজনকে আটক করে। এদের মধ্যে তার বন্ধু জনি ওরফে রনি ও তৃষ্ণা রয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে গোয়েন্দা পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, ঐশী মাদকাসক্ত। সে নিয়মিত ইয়াবা সেবন করত। বন্ধুদের সঙ্গে রাতে মাঝেমধ্যেই বাইরে থাকত। এমনকি গভীর রাতেও বন্ধুদের নিয়ে বাসায় ফিরত। আর এ কারণে তার বাবা বিভিন্ন সময় তাকে মারধর করতেন, তার বখাটেপনায় বাধা দিতেন। বেশ কয়েক দিন ধরে তাকে বাসা থেকেও বের হতে দেওয়া হয়নি। টাকা-পয়সা দেওয়া বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। তিনি আরও জানান, এসব কারণে বন্ধুদের নিয়ে ঐশী তার বাবা-মাকে খুন করার পরিকল্পনা আঁটে। গোয়েন্দা পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, ঐশী নিজ থেকে হত্যাকাণ্ডের দায় নিলেও আরও অন্য কোনো কারণ রয়েছে কি না বা কারও চাপে হত্যাকাণ্ডের দায় ঐশী নিচ্ছে কি না, তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম-কমিশনার মনিরুল ইসলাম গতকাল সন্ধ্যায় বলেন, হত্যাকাণ্ডের মোটিভ এখনো বলা যাবে না। আরও কিছুটা নিশ্চিত হতে হবে। তবে ঐশী ও তার বন্ধুরাই যে এটা ঘটিয়েছে, তা অনেকটা নিশ্চিত।ঐশীর আত্মসমর্পণ : মাহফুজুর রহমান ও স্বপ্না বেগমের একমাত্র মেয়ে গতকাল দুপুরে নিজেই পল্টন থানায় যায় বলে পুলিশ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, দুপুরে পল্টন থানায় এসে ঐশী ডিউটি অফিসারের কাছে গিয়ে তার পরিচয় দেয়। সঙ্গে সঙ্গে তাকে ওসির কক্ষে নেওয়া হয়। ওসি এরপর তাকে নিয়ে যান কাছেই মতিঝিল জোনের উপ-কমিশনারের অফিসে। এরপর তাকে পুলিশের একটি গাড়িতে তুলে নেওয়া হয়। ওই গাড়িতে করে ঐশীকে নিয়ে যাওয়া হয় মিন্টো রোডের গোয়েন্দা পুলিশের কার্যালয়ে। মতিঝিল বিভাগের উপ-কমিশনার আশরাফুজ্জামান বলেন, বেলা ২টার দিকে ঐশী রহমান পল্টন থানায় গিয়ে আত্মসমর্পণ করে। ওই সময় তাকে ক্লান্ত দেখাচ্ছিল। ঐশী তাদের জানিয়েছে, সকাল থেকে সে কিছু খায়নি। প্রথমে তাকে খাবার দেওয়া হয়। এরপর বিশ্রাম দেওয়া হয়। পরে তাকে ডিবিতে হস্তান্তর করা হয়েছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের উপ-কমিশনার মাসুদুর রহমান বিকাল সাড়ে ৩টায় বলেন, ঐশী এখন আমাদের হেফাজতে রয়েছে। গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) সূত্র জানায়, পল্টন থানা থেকে ঐশী রহমানকে মিন্টো রোডের ডিবি কার্যালয়ে নেওয়া হয়। ঘটনার পর থেকে ঐশী যেখানে ছিল, সেসব জায়গায় ডিবি কর্মকর্তারা যান। এ সময় ঐশীও তাদের সঙ্গে ছিল।খুনিরা অপেশাদার : অপেশাদার ব্যক্তিদের ছুরির আঘাতে পুলিশ পরিদর্শক মাহফুজুর রহমান ও তার স্ত্রী স্বপ্না বেগম খুন হয়েছেন বলে ময়নাতদন্তে উঠে এসেছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সোহেল মাহমুদ জানান, নিহত পুলিশ কর্মকর্তার দেহে ছুরিকাঘাতের দুটি এবং তার স্ত্রীর দেহে ১১টি চিহ্ন রয়েছে। এই হত্যাকাণ্ডে একাধিক ব্যক্তি জড়িত ছিল বলে ধারণা করা হচ্ছে। গতকাল সকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে মাহফুজ ও স্বপ্নার ময়নাতদন্ত সম্পন্নের পর ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক সোহেল মাহমুদ আরও বলেন, পুলিশ পরিদর্শককে ছুরি মারা হয় গলায়, এতে শ্বাসনালি কেটে মৃত্যু হয় তার। স্বপ্না বেগমের গলায় দুটি, ডান পাঁজরে তিনটি, বুকে একটি এবং পেটে ও পিঠেও ছুরিকাঘাতের চিহ্ন রয়েছে। ডা. সোহেল বলেন, কমপক্ষে দুই থেকে ততোধিক ব্যক্তি এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। এতগুলো স্ট্যাব করা হয়েছে, তাতে মনে হয় অপেশাদার কেউ এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। তিনি আরও বলেন, যে ছুরি দিয়ে মারা হয়েছে তার দুই পাশ বেশ ধারাল ছিল বলেও আঘাতের চিহ্নে প্রমাণ মেলে। লাশ দুটি উদ্ধারের ৪৮ থেকে ৬০ ঘণ্টা আগে তাদের হত্যা করা হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। মৃত্যুর আগে তাদের কিছু খাওয়ানো হয়েছিল কি না, তা জানতে রাসায়নিক পরীক্ষার জন্য শরীরে বিভিন্ন অংশের নমুনা রাখা হয়েছে। শুক্রবার সন্ধ্যায় নিজেদের তালাবদ্ধ ফ্ল্যাটের একটি বাথরুম থেকে মাহফুজ (৪৫) ও স্বপ্নার (৪২) ক্ষতবিক্ষত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় মাহফুজের ভাই মনসুর রহমান বাদী হয়ে গতকাল মতিঝিল থানায় মামলা করেছেন। এতে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করা হয়েছে। মাহফুজ পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের রাজনৈতিক শাখায় কর্মরত ছিলেন। স্ত্রী স্বপ্না এবং দুই ছেলে-মেয়ে ও এক শিশু গৃহকর্মীকে নিয়ে ওই বাড়ির পঞ্চম তলায় থাকতেন তিনি। মাহফুজের দুই সন্তানের মধ্যে ঐশী ‘ও’ লেভেলের ছাত্রী ও ছেলে ঐহীর বয়স সাত বছর। ঐশীর আচরণ সন্দেহজনক বলে পুলিশের কাছে মনে হচ্ছে। বৃহস্পতিবার সকালে ঐশী ছোট ভাই ও গৃহকর্মী সুমিকে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। শুক্রবার সকালে রিকশায় করে ঐহীকে এক আত্মীয়ের বাসায় পাঠানো হয়।
বাংলাদেশ প্রতিদিন থেকে নেওয়া।