বর্তমান সময়ে ইসলাম বিশেষজ্ঞের পরিমাণ হয়তো বেশ সীমিত, নতুবা তাদের বর্তমান-প্রযুক্তি ব্যবহারে অনীহা, আর তাই জাকির নায়েক হয়ে উঠেছেন ইসলামের বক্তিয়ার খিলজি। তিনি ছুটিয়ে চলেছেন তাঁর যুক্তির ঘোড়া পৃথিবীর এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত। তাঁর যুক্তির তরবারি কেটে চলেছে ইসলাম নিয়ে সন্দেহ পোষণকারী সমস্ত যুক্তির জাল। আর মুসলমানেরা তাকিয়ে দেখছে তাঁর ঘোড়া যাওয়া পথে উড়তে থাকা ধুলোর মাঝে খুন হয়ে যাওয়া সন্দেহকারীদের। যাদের নিয়ে তারা হয়তো তটস্থ ছিল দুইদিন আগে তাদের যুক্তির সাথে না পেরে উঠে। এই সমস্ত সন্দেহ পোষণকারীদের নাস্তানাবুদ হতে দেখে তারা পায়ের নিচে মাটি খুঁজে পায়। তারা সেই শক্ত মাটিতে হাটু গেড়ে বসে জাকির নায়েকের দিকে তাকায়। তারা দেখতে পায় ধুলো উড়িয়ে চলে যাচ্ছে একবিংশ শতাব্দীর বক্তিয়ার খিলজি। তারা কৃতজ্ঞতায় মাথা নিচু করে।
জাকির নায়েকের তরবারিতে যে সবাই মুগ্ধ হয় তা ঠিক না। অনেকেই মনে করে তাঁর তরবারি আসলে খাটি সামুরাই তরবারি না। আসলে তারা তা মনে না করে পারেনা। কেননা, তারা দেখে এই তরবারিতে আসলে কচু কিংবা কলা গাছ কাটে, বাঁশে কোপ পড়লে বেঁকে যায়। অবশ্য তাঁর গুণমুগ্ধরা তাঁর তরবারির এই বেঁকে যাওয়াকে দেখেনা। অবশ্য দেখতে পারার কথাও না। জাকির নায়েক তাঁর চলার পথে এমন ধুলা উড়ান তাতে একটু খেয়াল না করলে এইসব চোখে বাধেনা। চ্যাপ্টার নম্বর, সুরা নম্বর আর হাদিস নম্বরের চাকচিক্যে এইসব দিকে খেয়াল দেয়ার ফুরসৎ কই!
কিন্তু কিছুকিছু ব্যাপারে তার দিকে খেয়াল না দিয়ে পারা যায়না। জাকির নায়েকের অনেক অনেক যুক্তির মাঝে মুসলিম দেশে অন্যধর্ম প্রচার কেন না-জায়েজ, ইসলাম থেকে নাস্তিক বনে যাওয়া কোন মানুষ যদি নাস্তিকতা প্রচার করতে থাকে কিংবা ইসলামের বিপক্ষে কিছু বলে সেক্ষেত্রে তার বিধান কী হবে, যুদ্ধবন্দী নারী কিংবা দাসীর সাথে যৌনসম্পর্কের ব্যাপারে তার মতামত কিংবা ওসামা বিন লাদেনের মত ইসলামের আহমদ মুসার ব্যাপারে তাঁর চিন্তাধারা তাঁকে নিয়ে ভাবতে বাধ্য করে।
জাকির নায়েক মনে করেন, তিনি সারা পৃথিবী জুড়ে ইসলামের বাণী প্রচার করতে পারলেও একজন অন্য ধর্মাবলম্বী একটা ইসলামিক দেশে তার ধর্ম প্রচার করতে পারেন না। তাঁকে এই বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি তার অত্যন্ত প্রিয় উদাহরণ ‘২ আর ২ কত হয়’ দিয়ে প্রমাণ করেন যে একটা ইসলামিক দেশে অন্যধর্ম প্রচার করতে দেয়ার কোন যৌক্তিক কারণ নেই। ধরুন, আপনি আপনার স্কুলে গণিতের শিক্ষক নিবেন। আপনি আগ্রহী প্রার্থিদের কাছে জিজ্ঞেস করলেন, দুই আর দুই যোগ করলে কত হয়? তাদের মধ্যে কেউ উত্তর করল শূন্য, কেউ তিন কেউ চার কিংবা কেউ পাঁচ। আপনি কি এই শূন্য, তিন, পাঁচ উত্তর দাতাদের আপনার স্কুলে গণিতের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিবেন? নিবেন না তো? আপনি তো ওই চার বলা উত্তর দাতাকেই নিয়োগ দিবেন। তদ্রুপ, যেহেতু কোরানে বলা হয়েছে ইসলাম আল্লাহর কাছে একমাত্র স্বীকৃত জীবন ব্যবস্থা সেহেতু একটা ইসলামিক রাষ্ট্র কখনই অন্য ধর্মের প্রচার বরদাস্ত করতে পারেনা। অবশ্য আপনার কাছে ভগবান, ঈশ্বর কিংবা একান্তই আপনার চিন্তার ফলশ্রুতিতে পাওয়া বিশ্বাসকে একমাত্র স্বীকৃত সত্য মনে হলে কিছু করার নেই।
আমাদের দেশে বলে কয়ে ব্লগাররূপী নাস্তিক খুন করা হচ্ছে। সেই বিষয়ে এই সময়ের বক্তিয়ার খিলজি তার মতামত না দিয়ে পারেননি। জাকির নায়েক বলেন,প্রতিটা শিশু মুসলমান হিসেবে জন্মগ্রহণ। তারপর হয়তো পিতামাতা, শিক্ষক কিংবা সমাজের কারণে অন্যধর্ম পালন করা শুরু করে। একজন মানুষ যদি ইসলাম ধর্ম থেকে অন্য ধর্মে চলে যায়, তাহলে সেটা পাপ। তবে তাকে খুন করা যায়েজ নয়। মহানবী (সা) একজনকে এই অপরাধে খুন করতে বললে, তাঁকে যখন জানানো হয়েছিল সে বিবাহিত তিনি তাকে মাফ করে দেন। তাই ইসলাম ত্যাগ করলেই তাকে খুন করতে হবে এমন না, তবে এই ব্যক্তি যদি ইসলাম ত্যাগ করে ইসলামের নামে কুৎসা রটায়, ইসলামের ভুল ধরে বেড়ায় তাহলে ইসলামিক আইনে তাকে খুন করতে হবে। আমাদের দেশে অনেক হুজুর নাস্তিকদের খুন করা জায়েজ বলে ফতোয়া দিয়ে দেয়, ইসলামের বক্তিয়ার খিলজিও সেই দাওয়াই দেন।
দাসীদের সাথে যৌন্যসম্পর্ক করা যাবে কিনা জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, তোমরা তোমাদের স্ত্রীগণ আর দাসীদের সাথে যৌনকর্মে লিপ্ত হতে পারবে। যদিও ইসলামে দাস ব্যবস্থা বিলুপ্তির দিকেই ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে কিন্তু সেই সময়ে যুদ্ধে অনেকেই আটক হতো যারা দাস হিসেবে পরিগণিত হতো। তবে, মুসলমানদের বলা হয়েছে তোমরা যারা বিয়ে করার সামর্থ রাখনা তারা এই দাসীদের সাথে বিয়ে কর, আর মহারানা বাবদ তাদের স্বাধীনতা দিয়ে দাও। তবে একজন মুসলিম নারী যদি চাই একজন যুদ্ধবন্দী পুরুষকে বিয়ে করবে তাহলে ইসলাম তাকে সেই সুযোগ দেয়না। কেন, একজন যুদ্ধবন্দীকে একজন মেয়ে বিয়ে করতে পারবে না, সে বিষয়ে খিলজি তেমন কিছু বলেননি।
ইসলাম শান্তির ধর্ম। বক্তিয়ার খিলজি ইসলামের ঝান্ডাবাহক। কিন্তু আহমদ মুসা রূপী বিন লাদেনের ক্ষেত্রে খিলজি সাহেবের পক্ষপাতিত্ব আছে। যদিও আহমেদ মুসা কোথায় কিভাবে শান্তি আনল তা তিনি বিস্তারিত বলেননি। তিনি বলেছেন, যদি আহমেদ মুসা ইসলামের শত্রুদের বিরুদ্ধে জিহাদ করেন তাহলে তিনি তাকে সমর্থন দিবেন। যদি আমেরিকাকে তিনি ভয় দেখান, তিনি তাকে সমর্থন দিবেন কেননা আমেরিকা সবচেয়ে বড় টেরোরিস্ট। কেননা, ইসলাম বলে প্রতিটা টেরোরিস্ট একজন মুসলিমকে ভয় পাবে। যদিও, তিনি বলেননি ওসামা বিন লাদেন টেরোরিস্ট কিনা।
জাকির নায়েক বিবর্তনবাদ বিজ্ঞানীদের কাছে গ্রহণযোগ্যতার কারণ হিসেবে একে বাইবেল বিরোধী বলে মনে করেন। তার মতে বেশীরভাগ বিজ্ঞানী বাইবেল বিরোধী আর তাই এটা প্রমাণ সাপেক্ষ না হলেও বিজ্ঞানীরা তাকে সমর্থন না দিয়ে পারেনা। যদিও বিবর্তন বিষয়ে বক্তিয়ার খিলজির বক্তব্যকে গুরুত্ব দেয়ার কিছু নেই কেননা তিনি নিজেকে বিজ্ঞানী বলে দাবী করেননি। কিন্তু তিনি যা জানেন বলে দাবী করেন, সেই বিষয়ে তার যুক্তির এই খেলোতা তাকে নিয়ে দুইবার ভাবনার অবকাশ তৈরি করে। একজন মানুষ যাকে দেশের শিক্ষিত-অশিক্ষিত মানুষ অন্যতম জ্ঞানী মনে করে তার চিন্তার এমন দৈন্যতা চিন্তার জন্ম দেয়। কেননা তিনি প্রকারন্তরে ধর্মীয় মৌলবাদ উষ্কে দিচ্ছেন। তিনি চাপাতি হাতে জিহাদিদের জানিয়ে দিচ্ছেন তারা যা করছে তা কোন পাপ নয় বরং ইসলামের খেদমত। বক্তিয়ার খিলজি প্রকারন্তরে জানিয়ে দিচ্ছেন, ইসলাম ছাড়া অন্যধর্মের এই পৃথিবীতে থাকার কোন নৈতিক ভিত্তি নেই। হয় তিনি ভুল বলছেন কিংবা ইসলাম আসলেই তার মতই বলে। আমরা ইসলাম না জানা মানুষ ইসলামের যে শান্তির কবুতর উড়াই তা আসলে আমাদের মনের খেয়াল। আমরা যেভাবেই ভাবি না কেন, বক্তিয়ার খিলজি তার ঘোড়া ছুটিয়ে চলেছেন, তার ঘোড়ার খুরে ঊড়ছে ধুলোবালি,আর সেই ধুলোই হারিয়ে যাচ্ছে মুক্তচিন্তার কিরণ।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ সন্ধ্যা ৭:১৩