স্কুলে পড়ার সময় খুব খেলাধুলা করতাম। ফুটবল, ক্রিকেট কিংবা ভলিবল কিছুই বাদ যেত না। তখনকার একবন্ধুর বলা একটা কথা খুব মনে পড়ে। হয়তো কথাটা মনে গেঁথে থাকবে আজীবন। একদিন পাশের গ্রামের কোন দলের সাথে ফুটবল কিংবা ক্রিকেট খেলা ছিল। যারা খুব ভালো খেলত বলে বেশ নামডাক ছিল। আমাদের প্রায় সবার মাঝে এক ধরণের চাপা ভয় ছিল বড় ব্যবধানে হারব বলে। তারপর নিজ গ্রামে খেলা। সবার সামনে হারু পার্টি হতে কে চায়? কিন্তু আমাদের মাঝে একজন ছিল যার চিন্তা ধারা অন্যরকমের। সে হারতে জানত না। প্রতিপক্ষ দলের প্রশংসা করাতে সে রেগে গিয়ে বলল, “ওদের দুই হাত দুই পা, আমাদেরও দুই হাত দুই পা। ভয় পাওয়ার কী আছে, আমরাই জিতব।
আপাতদৃষ্টিতে এটাকে খুব সহজ কথা মনে হলেও সেদিন আমরা এই কথাতে অনুপ্রাণিত হয়ে ছিলাম, এবং বলা বাহুল্য সে ম্যাচ আমরা হারিনি। এরপর থেকে জেতা আমাদের জন্য ডাল ভাত হয়ে গিয়েছিল। কিছুদিন থেকে একটা কথা শুনে আসছি বনের বাঘে খায়না, মনের বাঘে খায়। কথাটির সাথে আমাদের ছোটবেলার এই ঘটনার বেশ মিল পাওয়া যায়। সেই মিল আমরা পায় আমাদের ক্রিকেট দলের মাঝেও। এশিয়া কাপের আগে আমরা কি চিনতাম আফগানিস্তানকে? কিন্তু আমাদের পত্রিকাওয়ালারা চিনিয়ে দিয়েছিল আমাদের। খেলার আগেই আমরা দর্শকরাই চাপে পড়ে গিয়েছিলাম। একটা অসস্তি কাজ করছিল সবার মাঝে যে হয়ত বা আমরা ম্যাচটা হেরে যাব। দলে তামিম সাকিব নেই। মনে হয় সেই ভয় ঢুঁকে গিয়েছিল দলের মাঝেও। ফলে যা হওয়ার কথা তাই হয়েছিল।
বিশ্বকাপ শুরুর আগ থেকেই আমাদের মাঝে, আমাদের খেলোয়াড়দের মাঝে আফগানিস্তান নিয়ে একটা খচখচানি ছিল। আমাদের পত্রিকাওয়ালারা বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছিল যে আমরা কিন্তু আফগানিস্তানের কাছে হেরে যেতে পারি। তারা প্রস্তুতি ম্যাচে ভালো করেছে; আমরা করিনি। এমন কি স্কটল্যান্ড প্রস্তুতি ম্যাচ ভালো করলেও তারা ফলাও করে ছাপে। আমরা ভয় পেতে থাকি। সাকিবরাও মানুষ, ভয় তাদের মাঝেও আসতে পারে। আমরা খেয়াল করিনা। আফগানিস্তানের সাথে খেলাই কি সেই ভয় সেই জুজু কাজ করেনি? প্রথমে এমন করে দেখেশুনে খেলাই বলে দেয় ভয়টা ছিল। যার কারণে চাপে পড়ে গিয়েছিল দল, অনেক দর্শক তো ধরেই নিয়েছিল আজকেও হারছি। কিন্তু ধন্যবাদ সাকিব, মুশফিক কৌশিকদের। তারা আমাদের মত চাপে ভেঙে পড়েনি। চাপকে জয় করে বড় ব্যবধানে জিতে অহেতুক মনের বাঘ দেখে ভয় পাওয়া মানুষদের গালে থাপ্পড় দিয়েছে।
কিন্তু আমাদের পত্রিকাওয়ালারা তাদের এই দাপুটে জয় দেখেও আশান্বিত হতে পারেনা। তারা বিশ্বাস করেনা যে আমরা অনেকদূর যেতে পারি। তারা বিশ্বাস করেনা এই দলের বিশ্বকাপ জয়ের ক্ষমতা আছে। ছিয়ানব্বইয়ের বিশ্বকাপের আগেও কেউ ভাবেনি শ্রীলংকা বিশ্বকাপ জিতবে। কিন্তু তারা জিতেছে কারণ তাদের মাঝে বিশ্বাস ছিল যে তারা পারবে।পত্রিকাওয়ালারা মনে করে বিশ্বকাপ যেতার ক্ষমতা শুধু ভারত কিংবা পাকিস্তানের। ভারত পাকিস্তানের ম্যাচের আগে তাদের পত্রিকা জুড়ে তাদের গুণকীর্তন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় তাদের মনোভাব। অথচ আমরা দেখি এই ভারত পাকিস্তান অস্ট্রেলিয়া নিউজিল্যান্ডের পরিবেশে কী নাকানিচুবানিই না খাচ্ছে। অথচ তাদের নিয়ে তাদের কী উচ্ছ্বাস। হয়ত ব্যবসায়ী চিন্তাধারায় তারা এমন করে ভারত পাকিস্তান নিয়ে মেতে ওঠে।
তারা যদি শুধু তাদের নিয়ে মেতে থাকত তাহলেও হতো, তারা তাদের প্রতিবেদনে ফুটিয়ে তোলে আমাদের দলের উপর তাদের ভরসা নেই, তারা আমাদের খেলোয়াড়দের অনুপ্রাণিত করার বদলে করে উল্টোটা। তাই আমাদের শুধু অস্ট্রেলিয়ায় প্রতিপক্ষ নয়, প্রতিপক্ষ হয়ে যায় সাংবাদিকদের মনের বাঘও। আমরা দেখতে পায়, সাকিবের আচরণের সমস্যা নিয়ে তারা ফলাও করে ছাপায়, তামিম কী খারাপ কাজ করল তা নিয়ে তাদের যত উৎসাহ। তারা ভেবে দেখেনা এই করে তারা মন ভেঙে দিচ্ছে দেশের হাজার হাজার উঠতি সাকিব তামিমদের। যাদের কাছে বিরাট কোহলি নয়, এই সাকিব মুশফিক নায়ক। সাকিব মুশফিক সম্পর্কে তারা খারাপ কিছু শুনতে চায়না। সাকিবের খারাপ আচরণ বোর্ডের ব্যাপার। তারা বোঝেনা তা ঢাক ঢোল পিটিয়ে এই সব আগামী প্রজন্মকে বলার কোন মানে নেই।
যেকোন বিচারে সাকিব কি ভালো নয় আফ্রিদির তুলোনায়, অথচ আমাদের পত্রিকা ওয়ালারা বিশ্বাস করেনা। তাদের যৌবন কালে তারা দেখেছিল আফ্রিদি কোন একদিন একটা রেকর্ড করেছিল। তারপর পদ্মা মেঘনায় বয়ে গেছে অনেক পানি, তিস্তা শুকিয়ে গেছে কিন্তু তারা সেই রেকর্ডের কথা ভুলতে পারেনা। তাদের মনের মাঝে রয়ে গেছে সেই নায়ক। আফ্রিদিকে নায়ক করে আমাদের লাভ কী, আমাদের লাভ কী টেন্ডুলকার, আকরাম ভালো খেললে? কিন্তু এরা বোঝেনা, এরা ভুলতে পারেনা তাদের ছোটবেলার নায়কদের। এরা বুঝতে পারেনা এই দেশের নবাগতরা আফ্রিদি বা কোহলি নয় সাকিব তামিমদের নায়ক ভাবে। তাদের মত হতে চায়। তাই তাদের কাছে সাকিবদের ব্যক্তিগত জীবনের ভুল যদি সে করেই থাকে তা প্রকাশ করা উচিৎ নয়।
আজ পত্রিকায় দেখলাম অস্ট্রেলিয়ার সাথে এক পয়েন্ট পেলেই খুশী হবে বাংলাদেশ ( প্রথম আলোর খেলার পাতা)। আসলেই কী বাংলাদেশ দল ধরে নিয়েছে আমরা হেরে যাব? নাকি প্রথম আলোই শুধু ভাবছে হেরে যাবে কৌশিকরা। আর অস্ট্রেলিয়ার সাথে যদি হেরেও যায়, এই খেলার অভিজ্ঞতার কারণে কি শ্রীলংকাকে হারানো সুবিধে হবে না ? আমরা কেন না খেলে অস্ট্রেলিয়ার সাথে এক পয়েন্ট নেব? বরং জিতে তিন পয়েন্ট নেব, যেমন জিতব পরের সব খেলাতেই। যতদিন আমরা বিশ্বাস করব না যে আমরা বিশ্বকাপ জিততে পারি ততদিন বিশ্বকাপ জিতব না আমরা। আমাদের পত্রিকাওয়ালাদের উচিৎ এই বিশ্বাস বপন করা আমাদের খেলোয়াড়দের মাঝে। অবশ্য তার আগে এই বিশ্বাস তাদের মাঝে আসা জরুরী।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ বিকাল ৪:৩৩