লেগে থাকতে হবে রে বাছা, লেগে থাকতে হবে! চণ্ডিদাসের কথা শুনেছিস তো, ওই যে ব্যাটা মাছ ধরার নাম করে পুকুরে বড়শি ফেলে বারো বছর বসে ছিল রজকিনীর জন্য। কিংবা ধর, রবার্ট ব্রুস- ব্যাটা যুদ্ধে হেরে হেরে ছাতু হয়ে গেলেও ধৈর্য হারালো না; তাই তো শেষ মেশ জিতল। আমরা এদের কাছ থেকেই তো শিক্ষা নিয়েছি। ধৈর্যেই মোক্ষ লাভ। আবার বলতে পারিস, আমরা হচ্ছি ভিতরে ভিতরে জ্বিহাদী দল, আমরা কেন এই সব ইহুদি নাসারাদের কাছ থেকে শিক্ষা নেব? আসলে সব সময় বক্তিয়ার খিলজির মত ঝাপিয়ে পড়লে হয়না। শেষে বকরির মত অকালে প্রাণ হারাব, জ্বিহাদ মাথায় উঠবে। আমাদের মুরুব্বী মানে গোলাম আজম, তিনি এটা প্রথম বুঝতে পারেন। আমাদের রক্ত গরম ছিল তখন, এমন ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করা আমাদের দ্বারা সম্ভব ছিলনা, আর তাই তো তিনি নেতা আমরা তার অনুসারী- মানে মুরিদ। আমরা তো যুদ্ধ হেরে একেবারে হতভম্ভ; যেন মাঝ দরিয়ায় খাবি খাচ্ছি, কখন শহীদ হয়ে যায় তার ঠিক নেই। কিন্তু তিনি সামান্য বিচলিত হলেন না। কেমন কেমন করে সব ম্যানেজ করে নিলেন। আসলে তিনি প্রাণের পাকিস্তানের উপর আস্থা হারাননি কখনো। তিনি জানতেন, পাকিস্তান ইসলামী দেশ, আর ইসলামী দেশ রেখে তো আর সেকুলার মানে ধর্মহীন দেশে তাঁর মত ইমানদার বান্দা থাকতে পারেন না। তাই আমরা যখন হতভম্ভ তখন তিনি পেয়ারা পাকিস্তানের এই খণ্ডিত অংশকে আবার পাকিস্তানের সাথে যুক্ত করার ঠিক চেষ্টা করেছিলেন, পারেন নি। কিন্তু আমাদের ঠিক উদ্ধার করেছিলেন। আমাদের নামে কেস দিয়েছিল সেই সময় এই দেশের কুলাঙ্গার বেধর্মীর দল। তিনি পাকিস্তান আর সৌদি আরবের মাধ্যমে এমন চাপ দিলেন যে বাপবাপ করে আমাদের ছেড়ে দিল। তিনি সঙ্গে সঙ্গে দেশে ফিরে আসেন নি। কারণ তিনি তো আর চোরের মত দেশে আসতে পারেন না । পরে সব কিছু ঠিক ঠাক করে বীরের বেশে ফিরে এলেন।
তিনি যখন আমাদের মাঝে ফিরে এলেন, আমরা প্রাণ ফিরে পেলাম। তিনি শুধু ফিরলেন না- একেবারে পরিকল্পনা সাজিয়ে ফিরলেন। তিনিই আমাদের শেখালেন এই ধৈর্যের কথা; তিনি আমাদের বললেন যে আমাদের মাথা গরম করলে হবে না। কী তার আত্মশক্তি, কী তার সাহস! আমরা মুগ্ধ হতাম তাঁকে দেখে; আমদের বুকে বল আসত। সে সময় অনেক দালালেরা তাঁকে রাজাকার বলেছে তিনি কিছুই মনে করেননি। আমরা তাঁকে এই সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে বলেছেন, “সমস্যা কী? রাজাকার তো স্বেচ্ছাসেবক; ভালো উপমা; আমরা তো স্বেচ্ছায় ইসলামের খেদমত করছি। আমার শুনতে তো খারাপ লাগে না, বরং ভালো লাগে।” আমাদেরও ভালো লাগা শুরু হল। আমরা দেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে দিলাম রাজাকারের আসল মানে। এবং কী তাজ্জব ব্যাপার! দেখি অনেকেই তখন আর রাজাকার মানেই খারাপ তা মনে করছে না। আমরা দেখতে থাকলাম আমাদের পায়ের নিচে মাটি জমতে শুরু করেছে। আমরা উনার কাছে আরো ঋণী হয়ে গেলাম!
অবশ্য এর মাঝেই আমাদের হৃদয় ভেঙে গেল একদিন। ভেঙে গেল কী রীতিমত চুরমার হয়ে গেল। আমাদের প্রাণের নেতা গেল বাইতুল মোকাররমে জানাজার নামাজ পড়তে। কিন্তু ওখানেও কিছু দালালেরা ছিল। তাঁর দিকে জুতা ছুঁড়ে মারল। কিন্তু তিনি কিছু মনে করলেন না। আমাদের বললেন, “তায়েফের কথা কি তোমরা ভুলে গেছ? নবীজিকে (সা) মেরে রক্ত বের করে দিয়েছিল। কিন্তু তিনি দিশা হারাননি। আমাদেরও দিশা হারালে চলবে না।” আমরা আরও শক্তি পেলাম। আমাদের কাছে তার মহানুভতা বেড়ে গেল। আমরা জিহাদ করার নতুন শক্তি লাভ করলাম। আজ দেখ- তাঁর ধৈর্য, তাঁর বিচক্ষণতায় তাঁর জানাজা পড়া হল সেই বাইতুল মোকাররমে। আর শুধু কি জানাজা পড়া, এত এত লোক দেখে আমাদের মন ভরে যায়। এখন শোকে কান্না আসার কথা থাকলেও আসলে এটা আমাদের আনন্দের কান্না। আমরা আমাদের লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। জনগণ আমাদের অতীত ভুলে গেছে। যদিও কিছু কিছু মানুষ এখনও ভোলেনি; কিন্তু ব্যাপার না, আমরা হুজুরের দেখানো পথে এগিয়ে যাচ্ছি- কামিয়াব আমরা হবই, ইনশাল্লাহ।
তিনি আমাদের বুদ্ধি দিয়েছিলেন ইসলামী ব্যাংক, ইবনে সিনা হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার জন্য। আমরা এর মর্ম তখন বুঝতে না পারলেও এখন পারছি। এখন আমাদের কেউ নিষিদ্ধ করতে গেলে দুইবার ভাববে। আমরা তাঁর দূরদর্শিতা দেখে মুগ্ধ হচ্ছি। তিনি একই সাথে আমাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্লাটফর্ম এনে দিলেন এর মধ্য দিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলে মেয়ে এখন আমাদের কাছে হাত পাতে, আমাদের সাহায্য নেয়; এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেগুলোই আমাদের সব চেয়ে ভুগিয়েছে। মার্শাল্লাহ, এখন তারা আমাদের পক্ষে আসছে, এখন কোন কোন বেধর্মী ছাত্ররা আমাদের বিপক্ষে বললেও এরা প্রতিবাদ করছে। আমাদের আর প্রতিবাদ করা লাগছে না সব জায়গায়। তিনিই আমাদের বলেছিলেন এই সব ছেলেমেয়েদের আমাদের দলে ভেড়াতে। তাদের টাকা পয়সা, ধর্ম যেকোন ভাবে প্রলুব্ধ করে আমাদের বিশ্বাস তাদের অন্তরে ঢুকিয়ে দিতে। আমরা গ্রামে গ্রামে গিয়েছি, কাজ করেছি। এখন, সুবন্নাল্লাহ, আমাদের ছাত্র সংগঠন সব চেয়ে শক্তিশালী। আর সব ছাত্র সংগঠন তো স্বার্থপর; এরা নিবেদিত প্রাণ।
এমন কাজ তিনি আরও করেছিলেন। তিনি হঠাৎ গণতন্ত্রের জন্য আমাদের কাজ করার কথা বললেন। আমরা তখন তো পরস্পরের সাথে মুখ চাওয়া চাওয়ি করছি; আমরা হলাম ইসলামী দল, আমাদের কি গণতন্ত্রের ভক্ত হওয়া মানায়? আমরা হচ্ছি জ্বিহাদী, আমাদের কি এইসব ইহুদি নাসারাদের শেখানো তন্ত্র মেনে চললে চলে? এরা বলে জনগণ সকল শক্তির উৎস, নাউজুবিল্লাহ। আমাদের মুখ পানে চেয়ে তাঁর বুঝতে অসুবিধে হলনা আমরা কী ভাবছি। তার চিন্তাশীল চেহারায় এক চিলতে হাসি খেলে গেল। আমরা দেখতে পেলাম তার বিদ্রুপ। তিনি বললেন, “এখন গণতন্ত্র সবাই খাচ্ছে। আমাদের এই পন্থা ধরতে হবে। নবীজি ইহুদিদের সাথেও চুক্তি করেছিলেন। আমরা তো আর গণতন্ত্রে বিশ্বাস করছি না। কিন্তু এটা লোককে বুঝতে দেয়া যাবে না। এই দেশে বিপ্লব করা যাবে না। যেই দেশে যেই তরীকা। আগে ক্ষমতা নিতে হবে, তারপর এই সব ইহুদি মার্কা গণতন্ত্র দিয়ে কুলুব করব।” হুজুরের মুখে কুলুব করার কথা শুনেও আমাদের খারাপ লাগে নাই, বরং আমাদের কানে যেন মধু বর্ষিত হচ্ছিল। হুজুর বললেন, আমাদের এখন এই লীগ কিংবা বিএনপি সবার সাথে হাত মেলাতে হবে। এরা নারী নেতৃত্বের দল। নাউজুবিল্লাহ। কিন্তু সময় পরিস্থিতে তা করা জায়েজ আছে। আমরা এদের সাথে মিটিং করলে যে সব পত্রিকা আমাদের মুখ জনগণকে দেখায় না তারাও না দেখিয়ে পারবে না। আমরা এক মঞ্চে বসব। নির্বাচনের পর তো আমাদের সাহায্য ছাড়া কেউ ক্ষমতায় আসতে পারল না। আমরা বিএনপিকে সমর্থন দিলাম। এদের আমরা বেশি পছন্দ করি। এদের নেতায় আমাদের হুজুরকে দেশে আসতে সাহায্য করেছিল। তবে অন্যদলও আমাদের কাছে আসে। হুজুরের কাছে দোয়া নিতে আসে।
বুঝলি, ধৈর্য! ধৈর্য ধরে মাটি কামড়ে পড়ে থাকলেই শুধু হবে না, এর সাথে একটু একটু এগুতে হবে। যেমনটা হুজুর দেখিয়ে গেছেন। তিনি বলেছিলেন, “শোন, এই লীগ আর বিএনপি যদিও একই। এরা উভয়ই আমাদের সাহায্য চায় কিন্তু দেখতে হবে কাদের সাথে গেলে আমরা শুধু মাটি কামড়ে পড়ে থাকব না। মাটি কামড়ে খেয়ে নিতে পারব”। তিনি আরও বলেছিলেন, “এই লীগের অনেক সমস্যা। এদের এখনও অনেক পচে যাওয়া বুদ্ধিজীবী আছে যারা সময়ে-অসময়ে আমাদের গালি দেয়। বরং বিএনপিকে বেছে নেয়া ভালো। এরা সেকুলার টেকুলার বলে লাফায় না, আর এদের এখানে তেমন বুদ্ধিজীবীও নেই, অধিকাংশই পরজীবী। এদের মধ্যে সূচ হয়ে ঢুঁকে ফাল হয়ে বের হওয়া যাবে।” এখন দেখেছিস, শক্তিতে আমরা ওদের চেয়েও শক্তিশালী। ওরা ঠিকমত একটা মিটিং পর্যন্ত করতে পারেনা। আর আমরা সারা দেশ অচল করে দিতে পারি। এই আমাদের আর এক প্রাণের হুজুর মতিউর রহমান নিজামির ফাঁসির রায়ের পর কেমন হরতাল ডেকে দিলাম। আমরা পারি। এতদিন আমরা ওদের ফ্লোর দিয়েছি। এখন ওরা দেয়। ওরা ওদের সমাবেশ পিছিয়ে দিয়েছে রায়ের আগেই। এসব দেখে, আর হুজুরের কথা ভেবে আমার চোখে পানি আসে।
তবে হুজুরকে আমরা আর কতটুকু ধারণ করতে পেরেছি, তোরা তার চেয়ে ঢের বেশি পেরেছিস। তোরাও হুজুরের মত মানুষের মাঝে বিশ্বাস ঢুকিয়ে দিতে পারিস। তোরা পেরেছিস হাজার হাজার স্কুল কলেজের ছেলেমেয়েদের একাত্তর ভুলিয়ে দিতে। এক সময় সেকুলাররা বলত প্রশ্ন করার কথা। এখন তোরা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রশ্ন করতে প্রলুব্ধ করছিস। আমরা পারিনি সেই সময় দেশ ভাগকে ভারতের ষড়যন্ত্র বলে চালিয়ে দিতে কিন্তু তোরা এখন পেরেছিস। এই কিছুদিন আগে শাহবাগ শাহবাগ করে তো আবার একাত্তরের বিভীষিকার কথা মনে করিয়ে দিয়েছিল এই সব নাস্তিক, নাফরমানেরা। তোরা যে যুদ্ধটা করলি, ওরা একেবারে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। তোরা একের পর এক গল্প চালিয়ে যাচ্ছিস। লোকে ধরে ফেললে হতোদ্যম না হয়ে আবার নতুন করে শুরু করিস। আর তোদের কী কারিশমা! বেশীর ভাগ লোক বিশ্বাস করে। কিছু কিছু নাস্তিক আছে, ওরা অবিশ্বাসী। ওরা কিছুই বিশ্বাস করেনা। ওদের নিয়ে তোরা যে পড়ে থাকিসনা এটাই তোদের সবচেয়ে বড় শক্তি। এই যে তোরা সাইদী সাহেবকে চাঁদে নিয়ে যেয়ে কী সফলই না করলি আন্দোলনটাকে। আমাদের তো মাথায়ই আসত না। হুজুর তোদের এই কথা শুনে পরম শান্তি পেয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “আলহামদুলিল্লাহ্, আমার আর এই দেশে বেঁচে থাকার দরকার নেই। আমার অসামাপ্ত কাজ এখন এরাই করতে পারবে। আমি এখন শান্তিতে মরতে পারব।”
তিনি ইন্তেকাল করার আগে একটি কথা বলে গেছেন তোদের জন্য। ধৈর্য! ধৈর্যের সাথে শিকড় বিস্তার করার কথা।