“গেল, গ্রামটা এবার রসাতলে গেল! নালতের মিত্তির বলিয়া সমাজে আর তাঁর মুখ বাহির করিবার জো রহিল না—অকালকুষ্মাণ্ডটা একটা সাপুড়ের মেয়ে নিকা করিয়া ঘরে আনিয়াছে। আর শুধু নিকা নয়, তাও না হয় চুলায় যাক, তাহার হাতে ভাত পর্যন্ত খাইতেছে! গ্রামে যদি ইহার শাসন না থাকে তো বনে গিয়া বাস করিলেই তো হয়!”
আজ দুইদিন ধরে শুধু ‘বিলাসী’র এই বাক্যটা মনে পড়ছে। আমরা অনেক কিছুই মেনে নিই। বিয়ে করা, একসাথে থাকা কিন্তু বিয়ে করা বৌয়ের হাতে ভাত খাওয়া মেনে নেয়া যায়না। সে যে ভাত না খেয়েও থাকতে পারত না তা আমরা বিলকুল ভুলে যায়। আমাদের অবস্থাও আজকাল ওই খুড়ার মত হয়েছে। আমরা বসে বসে শুধু তামাশা দেখি। এ প্রসঙ্গে এক গল্প মনে হয়ে গেল।
একজনের বাসায় চুরি হয়ে গেছে। সে যখন চীৎকার চ্যাঁচামেচি শুরু করে তখন পাড়ার লোকে এসে জিজ্ঞেস করে তার এই কান্নার কারণ কী। কিন্তু সে কিছুই বলেনা। তার বৌ কাঁদতে কাঁদতে বলে “আমাদের সব চুরি হয়ে গেছে গো। ঐ মিনশের জন্য সব চুরি হয়ে গেছে।” সবাই মুখ চাওয়াচায়ি শুরু করে স্ত্রীলোকটির এই কথা শুনে। চুরি হয়েছে ভালো কথা কিন্তু এতে মিনশের দোষ কোথায় তারা বুঝতে পারেনা। তারা একধরনের ধাঁধার মাঝে পড়ে যায়। যদিও স্ত্রী লোকটা তাদের বেশিক্ষণ ধাঁধার মাঝে রাখেনা। স্ত্রী লোকটা সবাইকে যেন সাগর থেকে টেনে তোলে। “ঘরে চোর ঢুকল। আমি মিনশে কে বললাম ঘরে চোর এসেছে। ধর। কিন্তু সে আমাকে বলে ‘থাম মাগী, দেখি চোর কী করে।’ চোর আমাদের সবকিছু নিয়ে যখন ব্যাগে ভরে ফেলল তখনও আমি উনাকে বললাম এবার তো ধর। নাহলে তো চলে যাবে। তখনও সে আমাকে চোখ রাঙিয়ে থামিয়ে দেয়। যখন ঘর থেকে বের হয়ে গেল তখনও সে বলে ‘দেখি কী হয়’। কিন্তু চোর যখন আর ফিরে না আসে তখন তার হুঁশ হয় যে তার সর্বনাশ হয়ে গেছে।”
আমাদের অবস্থাও ঠিক তেমন। আমরা শুধু দেখি কী হয় দেখি কী হয় করে যায়। অবশ্য মাঝে মাঝে ওই খুড়ার মত বলে উঠি। আর মেনে নেয়া যায়না। এত অন্নপাপ।
আমাদের দেশের হাজারো সমস্যা আছে। যেকোন একটা বিষয় নিয়ে চীৎকার চ্যাঁচামেচি করলেই হয়। তারপরও সব কিছুর পরে একটা বিষয় থাকে যা মোটামুটি সবার স্বার্থে ঘা লাগার মত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার রেজাল্ট বের হওয়ার পর মনে হয় আমরা ঠিক বুঝতে পেরেছি এই মুহুর্তে আমাদের দেশের সবচেয়ে গুরতর সমস্যা কোথায়। একটা সরকার তিলে তিলে একটা জাতিকে মেধাহীন করে তুলছে; সবার সামনে এপ্লাসের এক ধরণের স্ক্রিন সেভার সেট করে দিয়ে। পাশের হার আর এপ্লাসের সংখ্যা বাড়ানোর রাজনীতিতে একটা প্রজন্ম ধ্বংস হতে চলেছে। শিক্ষা ব্যাবস্থায় একটা ঘুণ পোকা বেশ আগেই লেগেছে; এতদিন ছিল শুধু ঠাট। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা নামক ঝড়ে যেন তা একেবারে ধ্বসে পড়েছে। আমরা দেখতে পাচ্ছি এত এত পাশের ভিতরে, এত এত এপ্লাসের ভিতরে শুধু ঘুণ পোকার বসবাস।
যদিও আমাদের শিক্ষামন্ত্রী তা দেখতে পাচ্ছেন না। পাবেনও না কোন দিন। তার চশমায় আছে স্বার্থ নামক স্ক্রিন সেভার। যে সেভারে সে শুধু তার স্বার্থই দেখতে পায়। শিক্ষক নিয়োগে দুর্নিতি, এমপিও করণে দুর্নিতি, গাইড বইয়ের চরম ব্যাবসা, কোচিং সেন্টার তার স্ক্রিন সেভারের তলায় লুকানো। সারা দেশ যখন প্রশ্ন পত্র আউট হয়েছে বলে জানে, তিনি তা স্বীকার করেননা, ভর্তি পরীক্ষার এই ফল বিপর্যয় শুধু প্রশ্ন পত্র আউটের ফল নয়; এই দেশের পুরো স্কুল কলেজ শিক্ষা ব্যাবস্থার চরম বিপর্যয়ের ফল, তা যখন সবাই স্বীকার করছে তখন তিনি সেই একি বুলি আওড়ে যাচ্ছেন যে দেশের শিক্ষার তাথৈ তাথৈ উন্নতি হচ্ছে।
তিনি দেখতে পাচ্ছেন না কিন্তু আমরা পাচ্ছি এবং এটাকে তামাশা মনে করছি। কিংবা মনে করছি দেখি কী হয়। এটা বড় জোর ওই নিকা করার মত জিনিস। দেখতে মজাই লাগছে কিন্তু গা করছিনে। কিন্তু আমরা তো ঐ খুড়ার সমগোত্রীয় লোক তাই সবকিছুতে তামাশা দেখিনা। যেমন তামাশা দেখিনা লতিফ সিদ্দিকীর হজ্ব নিয়ে চিন্তা ধারায়। সারা পৃথিবীর মানুষ জানে যে যেখানে হাজার হাজার বিদেশী জড়ো হয় সেখানে অর্থনীতি থাকবেই। সেটা হজ্ব হলেও থাকবে, অলিম্পিক হলেও থাকবে। কিন্তু আমরা সবকিছুর ক্ষেত্রে স্বীকার করলেও হজ্বের ক্ষেত্রে করিনা। হতে পারে সৌদি সরকার প্রতি বছর হজ্ব থেকে সাড়ে ষোল বিলিয়ন ইউএস ডলার আয় করছে, হতে পারে তা তাদের জিডিপির শতকরা তিনভাগ। কিন্তু তা বলা যাবে না।
এদেশের গার্মেন্টস কর্মীরা যে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে বিদেশী মুদ্রা আনছে কিংবা প্রবাসীরা যে আত্মীয় স্বজন ফেলে বিদেশী টাকা পাঠাচ্ছে তার একটা অংশ সত্যিই যে হজ্বের কারণে চলে যাচ্ছে আমরা ভাবতে চাইনা। যেমন আমরা ভাবতে চাইনা শিক্ষা ব্যাবস্থার চরম অবনতি। একটা মেধাহীন জাতির দিকে ঠেলে দেয়াতে আমাদের দেশানুভুতি কিংবা ধর্মানুভূতি কোন কিছুতেই আঘাত লাগেনা। আঘাত লাগে হজ্বের কথা বললেই। আমরা আমাদের শিক্ষা মন্ত্রীর নির্লোজ্জ মিথ্যাচার নির্দ্বিধায় দেখে যায় কিন্তু হজ্ব নিয়ে করা এক জনের ব্যাক্তিগত মতামত এর জন্য শুধু তার পদত্যাগ নয় গ্রেপ্তারের দাবী করতে ছাড়িনা।
ধর্ম কি দেশ ব্যতিরেখে? যদি তাই হয় তাহলে কেন ধর্ম নিয়ে করা একটা মতামতের জন্য তার মন্ত্রিত্ব যাবে? সে যদি ধর্মের বিরুদ্ধে বলে তার শাস্তি তো মৃত্যুর পর স্বয়ং আল্লাহ দেবেনই। আমরা কেন উতলা হচ্ছি তার শাস্তি প্রদানের । তার মন্ত্রালয়ে চলা দুর্নিতি অনিয়মের জন্য তার মন্ত্রিত্ব যেতে পারে। আর যদি ধর্ম দেশের অংশ হয়, তাহলে দেশের যেকোন অন্যায়, অনাচারেই ধর্মানুভূতিতে আঘাত লাগার কথা। শিক্ষা ব্যাবস্থার এই করুণ অধপতনের জন্য আমাদের ধর্মানুভূতি ক্ষতবিক্ষত হওয়ার কথা। কিন্তু আমাদের অনুভূতিতে তখন লাগছেনা। আমরা দেখি কী হয় বলে তামাশা দেখছি। আর হজ্বের মাঝে বাণিজ্য দেখলেই আমরা এ যে অন্নপাপ বলে ঝাপিয়ে পড়ছি। কবে যে দেশীয় স্বার্থের ব্যাপারে আমরা অন্নপাপ বলে ঝাপিয়ে পড়ব !!