এইতো কিছুদিন আগে পাবলিক পরীক্ষার আগে বেশ উৎসব উৎসব পরিবেশ কাজ করত। এই উৎসবটি ছিল জাতীয় নকল উৎসব। পরীক্ষার্থীরা পরীক্ষার আগের দুইদিন পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিত কিন্তু কোন কিছুই মাথায় ঢুকাতো না বরং কলমে পেন্সিলে সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম বর্ণে লিখে ফেলত একএকটা প্যারাগ্রাফ। তাদের ধৈর্য দেখে আমি সে সময় মুগ্ধ হতাম। এ যেন কে কত ছোট করে লিখতে পারে তার এক অলিখিত প্রতিযোগিতা। অনেককে দেখতাম কাঠমিস্ত্রির কাঠ চাছার যন্ত্র নিয়ে বিদ্যালয়ের দিকে হাটা দিতে। একই বেঞ্চে যখন প্রতিদিন পরীক্ষা দিতে হয়, আগের দিনের বেঞ্চে লেখা নকল না সরালে তো নতুন কিছু লেখা যায়না।
সেসময় কার গাইড বই যেমন পপি গাইড, অবিস্মরণীয় গাইড আবার নকল করার জন্য বিশেষ ভাবে ছাপানো হতো যাতে একটা রচনা কিংবা প্রশ্নের উত্তর নকল করতে দুই পৃষ্ঠা বহন না করতে হয়, মানে প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন বা রচনা এক পৃষ্ঠার এপিঠ ওপিঠে লিখে শেষ করা থাকত। এগুলো ছাড়াও আবার দেখতাম খুব ছোট অক্ষরে লেখা কিছু চটি বই যা বহন করা সহজ। মানে ছোট সাপের বিষ বেশি আর কি। মেয়েদের আবার নকল করার একটু সুযোগ বেশি ছিল, মানে নকল লিখে নিয়ে যাওয়ার। সে সময় সবাই সাদা শেমিজ পরতো এবং পরীক্ষার আগের রাতে তা কালো অক্ষরে অক্ষরে শৈল্পিক হয়ে উঠত।
সেসময় কোন অভিভাবক তার ছেলেকে নকল করতে নিষেধ করত বলে শুনিনি। হয়তো অনেকে ছেলের এই নকল প্রস্তুতি সচেতন ভাবে এড়িয়ে যেত। অনেকে ছেলের এই নকল প্রতিভায় নতুন কিছু যোগ করা যায় কিনা তা নিয়ে সেচেষ্ট ছিল। শিক্ষকগণকে দ্বিতীয় বাবার মর্যাদা দেয়া হয় আর তাই তাঁরাও কখনো নকলে বাঁধা দেননি। বরং তাঁদের এই ছেলেদের স্বরস্বতি দূরে ঠেলে দিলেও তাঁরা মমতা দিয়ে আশ্রয় দিয়েছেন। ছাত্রদের নকল এগিয়ে দেয়া ছাড়াও কখন মেজিস্ট্রেট আসছে তা ছেলেদের জানিয়ে দেয়া তাঁদের নৈতিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ত।
যেহেতু উৎসব তাই এখানে সবার অংশগ্রহণ থাকা বাঞ্ছনীয়। আর তাই পরীক্ষার্থীদের তুলনায় অনেক অনেক গুন বেশি মানুষ কেন্দ্রের দিকে চলে যেত। কেউ নকল দিতে, কেউ নকল দেয়া দেখতে। আমরা যারা ছোট ছিলাম তারাও যেতাম। নকল পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব যারা নিজ ঘাড়ে তুলে নেয় এবং সরকারি ভাবে নিয়োজিত পুলিশ যারা নকল রোধে বদ্ধ পরিকর তাঁদের মাঝের লড়াই বেশ জমত। কখনো এইদিক থেকে কেউ দৌড় দিল নকল দিয়ে আসতে, পুলিশ ছুটল তার পিছু পিছু । অন্যদিক তখন ফাঁকা। অন্যরা নকল পোঁছে দিয়ে আসল সেই দিকের রুমগুলোই।
সেই সময়ের ঘটনা। আমি আমার বন্ধুদের সাথে গিয়েছি এইচএসসি পরীক্ষা দেখতে। আমাদের কলেজের পিছনে কয়েক হাত দূরে একটা পুকুর ছিল। পুকুরের দুইপাশ দিয়ে যেয়ে নকল পৌঁছে দেয়া চাট্টেখানি কথা না। যেহেতু পুলিশরা আর কিছু না হোক এই নকল না দিতে দেয়ার ব্যাপারে খুব সচেতন ছিল। যদিও তারা যে খুব বেশি নির্দয় ছিল তা বলতে পারিনা। কারণ পরীক্ষা শুরুর ঘন্টা দুয়েক পর তারা সুযোগ দিত দর্শকদের দায়িত্ব পালনের।
পরীক্ষা শুরুর প্রায় আধঘন্টা পর খেলা শুরু হয়ে গেল। একজন উসাইন বোল্টের মত দৌড়ে যেয়ে চরম চাতুরতার সাথে পুলিশকে ফাঁকি দিয়ে নকল পৌঁছে দিতে সমর্থ হয়। কিন্তু ফেরার সময় আর কোন পথ না পেয়ে পুকুরে ঝাপ দিয়ে সাতার কেটে আবারো পুলিশকে বোকা বানিয়ে দর্শকদের মাঝে ফেরত আসে। তখন তো সে রীতিমত নায়ক। তারপর দেখি দলে দলে লোক নকল পৌঁছে দিতে দৌড় দিচ্ছে। কেউ সফল হচ্ছে কেউ আবার পুলিশের বাড়ি খেয়ে ফেরত আসছে।
এসময় চোখে পড়ল আরেক মজার জিনিস। একজন পুলিশ নকল ঠেকাতে নাকি তাদেরকে এই ব্যতিব্যস্ত করে রাখার জন্য রাগে জানিনা, একজন নকল সরবরাহকারীকে খুব জোরে মারার জন্য তার বরাদ্দকৃত লাঠিটা চালিয়ে দেয়। এবং আমি লক্ষ করি এই সরবরাহকারী তড়িৎ বেগে তাকে লাঠির নাগালের বাইরে নিয়ে নিজেকে রক্ষা করে কিন্তু পুলিশ নিজের গতি নিয়ন্ত্রন করতে পারেনা। সে পুকুরের মাঝে ঝপাং করে পড়ে যায়। এবং সাথে সাথে দর্শকদের মাঝে সে কি উল্লাস। মনে হয় যেন খেলার শেষ মুহুর্তে গোল করে চ্যাম্পিয়ন হয়েগেছে স্বাগতিক দল।
পরীক্ষা শেষে আমার এক মামাকে একজন জিজ্ঞেস করেছিল। কী রে, পরীক্ষা কেমন হল? “কেমন হয়েছে জানিনা। তবে স্যার যদি পাশ করেন তাহলে আমি পাশ। স্যারের লেখা নকল হুবুহু লিখে দিয়ে এসেছি।” মামার নির্লিপ্ত উত্তর।
নকলের এই উৎসবের হঠাৎ ছন্দপতন ঘটে সেই সময়ের শিক্ষা প্রতিমন্ত্রীর কিছু দৃঢ় পদক্ষেপে। এবং দুয়েক বছরের মাঝে আমরা লক্ষ করি সারাদেশ নকল মুক্ত হয়ে গেছে। এবং এই সময়েই বাংলাদেশে শিক্ষা ব্যবস্থায় জিপিএ পদ্ধতির প্রবর্তনও করা হয়েছে। আমরা দেখতে থাকলাম হুহু করে জিপিএ পাঁচ পাওয়া শিক্ষার্থীর পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে আগের বছরের রেকর্ডকে ভেঙে। এতে শিক্ষার মান উন্নত হল কি হলনা তা নিয়ে পরে মাথা ঘামানো যাবে কিন্তু এই সময় পরীক্ষার হলে নকল উৎসব আর হয়নি।
জামানা বদল হয়ে গেছে। মুড়ি মুড়কির মত জিপিএ ৫ পাওয়া গেলেও কিছুকিছু অভিভাবক তাঁদের সন্তানের উপর ভরসা রাখতে পারছেন না। তারা আগের যুগের বাবাদের মত নকল এগিয়ে দেয়ার মত বোকাটিও আর না। তার চেয়ে তারা সহজ পদ্ধতি খুঁজে পেয়েছে। তারা পরীক্ষার দুইএকদিন আগে পুরো প্রশ্ন পত্রটায় তার সন্তানের হাতে তুলে দিচ্ছে। এর আগে যে দেশে কখনো প্রশ্নপত্র পরীক্ষার আগেই পাওয়া যায়নি তা না। কিন্তু তা বর্তমান সময়ের মত মহামারী আকার ধারণ করেনি কখনো। আগে বিসিএস পরীক্ষার প্রশ্ন আউট হতো মাঝে মাঝে। কখনো শুনতাম এসএসসি কিংবা এইচ এস সি পরীক্ষারও প্রশ্ন বের হয়েছে। আমরা এই নিয়ে বিস্মিত হতাম। এখন, অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে প্রশ্ন পত্র বের না হওয়াই বিস্ময়ের, হলেই স্বাভাবিক। সেই জেএসসি থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা পর্যন্ত সব জায়গায় প্রশ্ন বের হয়ে যাচ্ছে।
আগের শিক্ষামন্ত্রী নকল হয় এটা স্বীকার করেছিলেন। আন্তরিকভাবে চেয়েছিলেন দেশকে নকল মুক্ত করতে। দুয়েক বছরের মধ্যে সে মহামারী দূর হয়ে গেছে। বর্তমানের সমস্যা হচ্ছে, সরকার সমস্যাটা স্বীকার করছে না। আমি যদি আমার অসুখকে স্বীকার না করি তাহলে তার চিকিৎসা হওয়া তো সম্ভব না। আগে তো আমাদের এটা স্বীকার করতে হবে যে এটা একটা রোগ। সেই সময় দেশব্যাপী নকল জিনিষটাকে বৈধতা দেয়া হয়েছিল। নকল করে পাশ করা তখন গ্লানিকর ছিলোনা। এইভাবে যদি প্রশ্ন বের হতে থাকে অদূর ভবিষ্যতে এটাও স্বাভাবিক হয়ে যাবে সবার মাঝে; যেমনটা হয়ে গেছে ঘুষ দেয়া কিংবা নেয়ার ক্ষেত্রে।