ঘটনার আবহ মাস ছয়েক আগে। প্রাচ্যনাটে স্কুলে কোর্স-এর শেষ সময়। ফাইনাল প্রোডাকশনের আগের দিন রাতে সবাই রিহার্সেল শেষে চলে গেছে, কেবল আমি, স্বপ্ন আর মাহফুজ ভাই দিলু রোডের একটা খাবারের হোটেলে বসে আছি। মাহফুজ ভাই নাটকের দ্বিতীয় প্রধান চরিত্র। শো'র চারদিন আগে অফিসের কাজে তাকে চিটাগাং চলে যেতে হয়েছিলো, ফিরেছেন সেদিন। একেবারে ব্যাগ-প্যাকসহ হাজির হয়েছেন স্টেশন থেকেই! পরদিন শো, তিনদিনের অনুপস্থিতিতে, অনুশীলনের অভাবে আর পরিচালকের অগ্নিমূর্তিদর্শনে তার আত্মবিশ্বাসের থলে শুষ্কপ্রায়! আমি আর স্বপ্ন তাকে আত্মবিশ্বাসী করার প্রজেক্টে নামলাম। ঘন্টাখানেক সময় ব্যয় করে মোটামুটি একটা মিনি রিহার্সেল দিয়ে, কীভাবে কোন কথার কি অঙ্গ এবং মুখভঙ্গি হতে পারে তা নিয়ে আলোচনা করে করে তাকে নাটকের 'চরিত্রে' প্রবেশ করানোর প্রাণান্ত প্রয়াস। তিনি পরদিন সফল হয়েছিলেন, আত্মবিশ্বাসের সাথে মঞ্চে অভিনয় করেছেন। সেটা অন্য গল্প। এবার আসল গল্পে ফিরে আসি।
শো এর আগেরদিন রাতে মাহফুজ ভাইকে নিয়ে বসার সময়টাতেই পাশের দোকানে গিয়ে একফাঁকে একটা মার্কার কিনেছিলাম। ভাইয়ার স্ক্রিপ্টে তার ডায়ালগের অংশটুকু দাগিয়ে দেয়ার জন্য। দোকানদার নতুন। মার্কারের দাম লেখা ছিলো না প্যাকেটের গায়ে, তাই সে দ্বন্দ্বে পড়ে গেলো কি করবে। তার ধারণা বলছে সেই মার্কারের দাম ৭০/৮০ টাকা, আর আমি জানি তার দাম ৩৫/৪০ টাকা। আমি সবসময় এই মার্কার কিনি, এটা বলার পরও তার দ্বন্দ্ব যায়নি! সে আমার কাছ থেকে ৮০টাকা রেখেছিলো, এবং বলেছিলো তার মালিক আসলে তাকে জিজ্ঞেস করে দাম জেনে নেবে এবং সেই অনুযায়ী টাকা ফেরত দিয়ে দেবে। তার কনফিউজড অবস্থা দেখে আমারও মায়াই লাগলো, তার কথা অনুযায়ীই কাজ করলাম। পরদিন টাকা নিয়ে নেবো সেই কথাই রইলো।
কিন্তু পরদিন আর দিলু রোডের দিকে যাওয়া হয়নি, সরাসরি মহিলা সমিতিতে শো-এর জায়গায় চলে গিয়েছিলাম। তারপরের তিন/চার মাসও যাওয়া হয়নি। ঘটনাটা একপ্রকার ভুলেই গিয়েছিলাম। মনে মনে ভেবে নিয়েছিলাম ওই টাকাটা ফেরত পাবার ছিলো না, ওভাবেই খরচ হবার ছিলো! এপ্রিলের শেষে প্রাচ্যনাট গ্রুপে জয়েন করার পর এখন প্রতিদিনই দিলু রোড এলাকায় যাওয়া হয়। ওই দোকানের সামনে দিয়েও প্রতিদিন যাই। খেয়ালও করি না কখনো কখনো, আবার কখনো মনেও থাকে না কি ঘটনার সংযুক্তি দোকানটার সাথে। আবার যখন মনে পড়ে তখন মনে মনে হেসে উঠে ভাবি, 'এই সেই দোকান!'... তবু ৮০টাকার পাওনা আদায়ে মন আর ভাবে না!
আজ সকাল বেলা পরীক্ষা ছিলো, সেই চিন্তায় চিন্তায় বের হতে গিয়ে টাকা না নিয়েই বের হয়ে গেছি। ব্যাগে ছিলো মাত্র ৭০/৭৫ টাকা! কার্জন হল পর্যন্ত ২৫ টাকা দিয়ে যাত্রা শুরু, তারপর এটা-সেটা টুকিটাকি খরচ-পাতির ধাক্কায় মাত্র ২০টাকার মালিক হয়ে ৩৫ টাকা রিকশা ঠিক করে কলাবাগান গেছি। সেখানে পৌঁছে যার বাসায় গেছি তার কাছ থেকে টাকা নিয়ে ভাড়া দিয়েছি! হাতের ২০টাকার ১২ টাকা খরচ করে বাংলামটর, ৫টাকা খরচ করে দিলু রোডের মাথায় নামলাম। ৩ টাকার মালিক হয়ে গেলাম ফটোকপি'র দোকানে। ফটোকপি যেখানে করায় সেটা হলো সেই স্টেশনারি দোকান যার কথা আগে বলছিলাম। আমার মাথাতেও ছিলো না যে এখানে আমি বেশ কয়েক মাস আগে কিছু টাকা পেতাম, এমনকি ওখানের লোকটা কেমন ছিলো দেখতে তাও মনে নেই। আর ভেবেই নিয়েছি, সেই লোক থাকলেও নিশ্চয়ই আমাকে মনে রাখেনি, হয়তো তারও মনে আছে 'একজন টাকা পায়', কিন্তু সে কে সেটা এতদিনে আর মনে নেই।
আমি ফটোকপি'র পেজটা বের করে উনার হাতে দেয়ার পর উনি হঠাৎ বলে উঠলেন, 'আপনি তো আমার কাছে ৪০ টাকা পান'!!!!......আমি প্রচন্ড অবাক হয়ে লোকটার মুখের দিকে তাকালাম! আমার তো ওই ঘটনা মনেই ছিলো না! মাথা থেকে পুরা আউট হয়ে গেছে! অথচ উনি স্পষ্ট মনে রেখেছে! আমার চেহারা সহ! দেখলাম উনি হাতে ৪০ টাকা নিয়েই বসে আছেন। আমাকে দেখেই ক্যাশবক্স থেকে ৪০ টাকা বের করে হাতে নিয়ে নিয়েছেন! টাকাটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিতে দিতে বললেন, 'আপনাকে তো প্রতিদিনই দেখি দোকানের সামনে দিয়ে যান, টাকাও নিতে আসেন না। আমিও কয়েকবার ডাকবো ভেবে আর ডাক দেই নাই!'...আমি তখনো অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছি আর ভাবছি, 'আজকে আমার হাতে একদমই টাকা নাই, আর আজকেই এরকম অনাকাংক্ষিতভাবে টাকা পেলাম!!!..........তারচেয়ে বড় কথা, লোকটা এত সৎ!!......এরকম মানুষ তাহলে হারিয়ে যায়নি, এখনো তবে কিছু সংখ্যা আছে!......লোকটা তো ভুলে থাকার অভিনয়ও করতে পারতো এতদিন পর!'
এর মধ্যে ফটোকপি হয়ে গেছে! আমি ফটোকপির টাকা দিয়ে চলে আসার সময় লোকটা বললো, 'আপু, আমি আজকেই দেশের বাড়ি চলে যাবো। ফরিদপুর। অনেকদিন তো ঢাকায় থাকলাম। দোয়া করবেন!'...আমি হাসিমুখে 'অবশ্যই...ভালো থাকবেন...' বলে চলে আসলাম।
কিন্তু মনের মধ্যে তখনো ভাবনারা জট পাকাচ্ছে, ঘনীভূত হচ্ছে। কী আজব অভিজ্ঞতা! জীবনের লাল-নীল বৈচিত্র্যের তবে এত প্রকটতা! মনটা বেশ গুমোট হয়ে ছিলো, হঠাৎ খুব ভালো হয়ে গেলো! জীবনে ভালো লাগার মতো অনেক কিছুই আসলে আছে, যেগুলো খুব সন্তর্পণে অনাকাংক্ষার অবকাশে আমাদের অভিজ্ঞতার ঝুলিতে জমা হয়। সুখ-অসুখের দাঁড়িপাল্লায় সুখানুভূতিকে ভারী করতে আসলে এরকম অকস্মাৎ অথচ গভীর মানবিকতার অভিজ্ঞানই যথেষ্ট!
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই জুন, ২০০৯ রাত ১১:৩৭