পাকিস্তানী বাহিনীর কনভয়ের উপর ভারতীয় জঙ্গি বিমান আক্রমন চালায়। এতে পাক বাহিনীর ৯০টি গাড়ি ধ্বংস হয়। এছাড়া পাকিস্তানী বাহিনীর সৈন্য বোঝাই কয়কেটি লঞ্চ ধ্বংস হয়। বঙ্গোপসাগরে নৌবাহিনীর যৌথ কমান্ডের সফল আক্রমনে ধ্বংস হয় পাকিস্তানী সাবমেরিন গাজী। সাবমেরিনটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট হতে পাকিস্তান ধার নিয়েছিলো।
এদিন নৌবাহিনীর যৌথ কমান্ড চট্রগ্রাম সমুদ্রবন্দরের সব নিরপেক্ষ রাষ্ট্রের জাহাজগুলোকে বন্দর ত্যাগের নির্দেশ দেয়। তারা নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিতেও তাদের অপরাগতা প্রকাশ করে। প্রধান হুশিয়ারী ছিল চট্টগ্রাম বন্দর সম্পর্কে। বলা হয়, আপনারা সবাই চট্টগ্রাম বন্দর ছেড়ে চলে যান।
এ সতর্কবানীতে দুটি কাজ হলো- এক, বিশ্বের সব দেশ বুঝল বংলাদেশের বন্দর গুলো রক্ষা করার কোন ক্ষমতা পাক বাহিনীর নেই। দুই- ভারতীয় নৌবাহিনীর জাহাজ ও বিমানগুলো সব বন্দরকে ঘায়েল করার সুযোগ পেল।এদিকে তখন স্থলে মিত্রবাহিনীও এগিয়ে চলছে। পাক বাহিনীর বিভন্ন ইউনিটের মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রায় বিচ্ছিন্ন।
ভারতীয় বাহিনী প্রধান সড়কগুলো জায়গায় অবরোধ সৃষ্টি করে। তাই ঢাকার সঙ্গে কুমিল্লা, চট্টগ্রাম এবং রংপুর আর যশোরের সঙ্গে নাটোর ও রাজশাহীর যোগাযোগ সম্পূর্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। শুধু ঢাকার সঙ্গে যশোর ও খুলনার যোগাযোগ ব্যবস্থা অব্যাহত ছিল।
ভারতের ৫৭ মাউন্টেন ডিভিশন আখাউড়ার যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর সাথে মিলিত হয়। ভারতীয় সেনাবাহিনী আখাউড়ার দক্ষিন এবং পশ্চিমাংশ দিয়ে অবরোধ করে। এখানে পাকবাহিনী মিত্রবাহিনীর সাথে যুদ্ধে টিকতে না পেরে আত্নসমর্পন করে। ফলে আখাউড়া সম্পূর্ণরূপে শত্রুমুক্ত হয়। এই যুদ্ধে সুবেদার আশরাফ আলী খান, সিপাহী আমীর হোসেন, লেটেন্যান্ট বদিউজ্জামান, সিপাহী রুহুল আমীন, সিপাহী সাহাব উদ্দীন ও সিপাহী
মুস্তাফিজুর রহমান শহীদ হন। আখাউড়া মুক্ত হওয়ার পর কিছু পাকিস্তানী সৈন্য ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। এদিন ১৬০ জন পাকিস্তানী সৈন্য মিত্রবাহিনীর হাতে নিহত হয়।
এদিন নিরাপত্তা পরিষদের পুনরায় যে অধিবেশন বসে তাতে সোভিয়েত ইউনিয়নের এক প্রস্তাবে বলা হয় পূর্ব পাকিস্তানে এমন এক ‘রাজনৈতিক নিষ্পত্তি’ প্রয়োজন যার ফলে বর্তমান সংঘর্ষের অবসান নিশ্চিতভাবেই ঘটবে এবং পাক-বাহিনীর যে সহিংসতার দরুণ পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে তাও অবিলম্বে বন্ধ করা প্রয়োজন। একমাত্র পোল্যান্ড প্রস্তাবটি সমর্থন করে। চীন ভোট দেয় বিপক্ষে। অন্য সকল সদস্য ভোটদানে বিরত থাকে।
ঐ দিন আরও আটটি দেশের পক্ষ থেকে যুদ্ধবিরতি ও সৈন্য প্রত্যাহারের পক্ষে নিরাপত্তা পরিষদে আর একটি প্রস্তাব উত্থাপিত হয়। এবার সোভিয়েত ইউনিয়ন তার দ্বিতীয় ভোট প্রয়োগ করে। একই সময়ে ‘তাস’ মারফত এক বিবৃতিতে সোভিয়েত সরকার ‘পূর্ব’ বাংলার জনগণের আইনসঙ্গত অধিকার স্বার্থের স্বীকৃতির ভিত্তিতে সঙ্কটের রাজনৈতিক সমাধানের দাবী জানান।
এই সংঘর্ষ সোভিয়েত সীমান্তের নিরাপত্তার প্রশ্ন জড়িত বলে উল্লেখ করে এবং পরিস্থিতির অবনতি রোধকল্পে বিবাদমান পক্ষদয়ের যে কোনটির সঙ্গে জড়িত হওয়া থেকে বিরত থাকার জন্য বিশ্বের সকল দেশের প্রতি আহ্বান জানান।
এদিকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে উত্তপ্ত অবস্থা চিন্তিত করে তোলে প্রবাসী সরকারকে। কারণ এদিনও ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি। ভারতের প্রতিরক্ষা সচিব শ্রী কেবি লাল ‘বাংলাদেশ একটি বাস্তবতা বলে’ উল্লেখ করে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়া শুধুমাত্র সময়ের ব্যাপার বলে সাংবাদিকদের কাছে মন্তব্য করেন। রাজনৈতিক এ পরিস্থিতি মুক্তিযোদ্ধাদের যাতে দূর্বল না করে তোলে তাই মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি কর্ণেল ওসমানী জাতির উদ্দেশে বেতার ভাষণ দেন।
এদিকে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ এর পুতুল শাসক গভর্নর ডা. মালিক দেশবাসীর কাছে সাহায্যের আবেদন জানান। তিনি বলেন, দেশ আক্রান্ত। ভারতীয়দের সহযোগীতায় কিছু বিশ্বাসঘাতক দেশ আক্রমন করেছে। এ দেশের সেনাবাহিনী তাদের প্রতিরোধ করছে। তাদের সাহায্য করার জন্য প্রতিরক্ষা তহবিল করা হয়েছে। সে তহবিলে মুক্তহস্তে সাহায্য করার জন্য তিনি সবার প্রতি আহ্বান জানান। তবে তার আহ্বানে কেউ যে এগিয়ে আসেননি তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না।
এই দিনেও বাংলাদেশকে নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গন উত্তপ্ত ছিল। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মূল লড়াইটা ছিল দুই পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নয়ের মাঝে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল বাংলাদেশের পক্ষে আর যুক্তরাষ্ট্র ছিল পাকিস্তানের পক্ষে। মূলত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকে কেন্দ্র করে বিশ্ব শিবির দুইভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছিল । এই দিন জাতিসংঘে চীনের প্রতিনিধি বলেন, কোন শর্ত ছাড়াই পাকিস্তান থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার করতে হবে। চীনের প্রধানমন্ত্রী চউ এন লাই ভারতীয় হামলার মুখে পাকিস্তানকে সর্বাত্মক সহায়তা দেয়ার কথা বলেন।
তথ্যসূত্রঃ স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র, মূলধারা’৭১, লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে, একাত্তরের রণাঙ্গন, মুক্তিযুদ্ধ জানুঘর, উইকিপিডিয়া, ইত্তেফাক, কালেরকন্ঠ, সংবাদ, এনওয়াইবাংলা।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০১৪ দুপুর ১:২৮