পড়ার বইয়ের বাইরে, আমার প্রথম পঠিত গল্পের বই ছিল সম্ভবতঃ 'ভারতনাট্যম', মাসুদ রানা সিরিজের। তখন আমি ক্লাস সিক্সে পড়ি। স্কুলে লম্বা ছুটি। বড় ভাইয়ের বিছানায় বইটা পড়ে ছিল। আমি বইটি নিয়ে চুপি চুপি পড়া শুরু করি। বলা বাহুল্য, বইটা ছিল, প্রাপ্ত-বয়স্কদের জন্য। ভারতনাট্যমের নায়িকার ( নাম টা এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না) সেই বিখ্যাত স্টেজ-নাচের বর্ণনা পড়ে মাথা পুরোপুরি ঘুরে গেল। মনে হল সামনে দেখছি সেই নাচ। কিছুক্ষণ পর শুরু হলো মাসুদ রানার থ্রিলার আর নায়িকার সাথে প্রেম। রূদ্ধশ্বাসে পড়ে শেষ করে ফেললাম, এক দিনের ভেতরে (অবশ্যই সবাইকে লুকিয়ে)। নেশা ধরে গেল গল্পের বইয়ের প্রতি।
ভাইয়া কিছু দিন পরপর ই গল্পের বই নিয়ে আসতেন, আর আমি সু্যোগ বুঝে চুপি চুপি পড়ে ফেলতাম। এইভাবে, মাসুদ রানা সিরিজের অধিকাংশ বই (ধ্বংসপাহাড়, পাগল বৈজ্ঞানিক, আই লাভ ইউ ম্যান, রানা সাবধান, আমি সোহানা, অগ্নিপুরুষ ইত্যাদি) পড়ে ফেললাম ওই বয়সেই।
মনে পড়ে 'আই লাভ ইউ ম্যান', আর 'অগ্নিপুরুষ' এর লুবনার জন্য ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেছিলাম।
আসলে ঐ বয়সের অনুভূতির কোন তুলনা নেই। মাসুদ রানার অ্যাকশন, রোমান্স, থ্রিলার সবকিছুই মনে শিহরণ বইয়ে দিত।
তবে অতটুকু বয়সে এইসব বই পড়ে একটু এচঁড়ে পাকা হয়েছিলাম বোধ হয়। একবার এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের বাসায় বেড়াতে গেলাম বাসার সবাই। আমি এঘর-ওঘর খুঁজে পেয়ে গেলাম একটা দুঃষ্প্রাপ্য বই। বাংলায় আরব্য রজনী (প্রাপ্তবয়স্ক)। ওই প্রথম আমার বই চুরি (

এক হাজার এক রাত্রির গল্প। বইয়ের পাতায় পাতায় শিহরন। রূপকথার রঙীন কাহিনী। অদ্ভুত মাদকতায় ভরা বর্ণনা। গল্পের ভেতরে গল্প। এক গল্প থেকে আরেক গল্পে। প্রায় প্রতি পাতায় পেন্সিলে আঁকা বিভিন্ন দৃশ্যের ছবি। ২-এক্স টাইপ ছবি (

বই পড়ার ওই যে নেশা লেগে গেল, আর ছাড়তে পারি নাই।
এর পর থেকে যে বই সামনে পেতাম, পড়া শুরু করতাম। একটা সময় বাড়ির সবাই জেনে গেল আমার বই পড়ার কথা। বই হাতে পেলে খাওয়া-দাওয়া ভুলে যেতাম। এটা দেখে বাবা বই কিনে দিতে লাগলেন। একে একে শরৎচন্দ্রের অধিকাংশ লেখা ( মেজদিদি, বড়দিদি, কৃষ্ণকান্তের উইল, পথের দাবী, চরিত্রহীন, গৃহদাহ ইত্যাদি) পড়া হয়ে গেল।
কৈশোর কেটেছে হুমায়ূন আহমেদ এর বই দিয়ে। সেই সময়ে তার লেখা এমন কোন বই ছিল না, যেটা পড়া হয় নাই। অদ্ভুত এক মাদকতায় পরিপূর্ণ ছিল তার প্রতিটা গল্পের বই। হোক সেটা হিমু, মিসির আলী, নিতু বা হাসির গল্প অথবা গা শিউরে ওঠা রহস্য গল্প। হয়তো ঐ বয়সটাই ছিল এরকম। ঐ বয়সের মন, লেখায় খুঁজে ফিরত মাদকতা আর রহস্য।
মাঝে মাঝে হাতে আসতে লাগল সমরেশ, সুনীল, সঞ্জীব। গিলতে লাগলাম।
বাবা প্রায়ই রবিঠাকুরের সঞ্চয়িতা থেকে কবিতা পড়ে পড়ে সবাইকে শোনাতেন আর অর্থ বলে দিতেন। বাবার বর্ণনা আমরা সবাই মিলে বসে শুনতাম। 'আলিঙ্গন ঘনতর করি, সে কথা এখন নহে কহিল সুন্দরী।----- তোমা সনে যা করেছি কঠিন সে কাজ, সুকঠিন, তার চেয়ে সুকঠিন আজ, সে কথা তোমারে বলা।'
তাঁর সংগ্রহে ছিল রবিঠাকুরের অসংখ্য লেখা। নিজে নিজে পড়লে কিছুটা কঠিন মনে হত। তাই আগ্রহটা তেমন করে জমেনি তখনো। ভেবেছিলাম, পুরোনো দিনের লেখক----বুঝি বড় বড় উপদেশমূলক কথা থাকবে তাঁর গল্পে-উপন্যাসে। তাই সচরাচর এইগুলো ধরতাম না।
একদিন হাতের কাছে কোন নতুন বই ছিল না পড়ার মত। সাহস করে 'শেষের কবিতা' ধরলাম। মুহূর্তেই কবিগুরুর ফ্যান হয়ে গেলাম। একে একে তাঁর গোরা, নৌকাডুবি, ঘরে-বাইরে, চোখের বালি ইত্যাদি পড়ে ফেললাম। সাহিত্যের উৎকর্ষতার রূপ ধীরে ধীরে অনুধাবন করতে শিখলাম। এক একটি সাহিত্যকর্ম, সামনে নতুন নতুন জগত উম্মোচিত করতে লাগল।
তবে নিজের অভিজ্ঞতা থেকে মনে হয়, ছোট বেলায় সন্তানদের বাইরের বই পড়ার ব্যাপারে বাবা-মাদের আর একটু সতর্ক থাকাই ভাল। অত ছোট বেলায়, আরব্য রজনীর মত বই পড়লে, মাথা যে কারো ঘুরে যাবার কথা। তবে নিজের এই অভিজ্ঞতা থেকে লব্ধ জ্ঞান ছেলে-মেয়েদের উপর প্রয়োগ করা হবে, সেটা নিশ্চিত।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০১২ সকাল ১০:০০