বুঝি না, মানুষ “সেক্স” শব্দটা শুনলে এত আঁতকে উঠে কেন? এমন স্বর্গীয় ব্যাপারে সবাই কেমন করে এতোটা কনজারভেটিভ হয়! যৌন স্বাধীনতা কে যতই বাঁধা দেয়া হয় ততোই তা আত্মঘাতী নোংরামিতে পরিণত হয়। অথচ আয়োজন করে যৌনতা হচ্ছে আত্মার মিলন, নতুন এক প্রাণ সৃষ্টির পবিত্র উৎসব। জমিয়ে যৌনতা উপভোগ হচ্ছে সার্বজনীন ইবাদত; এই ইবাদতে মানুষ যতটুকুন আত্মার বন্ধনে আত্মনিয়োগ করে অন্য ইবাদতে তা হয়তো সম্ভব হয়ে ওঠে না। জাগতিক কোন ধরনের চিন্তা তখন আর কাজ করে না; কেবলই জয় করার ইচ্ছা, কেবলই আত্মার পবিত্র জলে স্নান করা ।
ঘটা করে উর্ধ্ব মহলের তরফ থেকে হাবিজাবি পর্ণ সাইট বন্ধের ঘোষণা কি অবাধ যৌনতা কে উৎসাহিত করা নাকি ব্যক্তি যৌনতায় রীতিমত হস্তক্ষেপ করা তা ঠিক বোঝা গেল না ! মত প্রকাশের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ, ব্যক্তি পর্যায়ের যৌন স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ ! রাজনীতির অধঃপতন এখন যৌন স্বাধীনতার হস্তক্ষেপে গিয়ে ঠেকেছে। দিন দিন রাজনীতি নিতান্তই কেন যেন মনে হয় হস্তক্ষেপের রাজনীতিতে পরিণত হয়েছে। পর্ণসাইট বন্ধের ঘোষণা অনেকেই ভালো বলছেন, অনেকে পর্ণসাইট বন্ধের ঘোষণায় খুশি হয়ে মানত করে নামাজ পড়ার কথাও বলছেন। এটা কি ধর্মান্ধতা নাকি নৈতিক দেউলিয়াত্ব?
যে রাষ্ট্র বেড রুমের নিরাপত্তা দিতে পারে না বলে সাংবাদিক খুন হয়; যে রাষ্ট্রে ধর্মীয় আগ্রাসনে চলে লাশের উন্মাদনা, লেখক হত্যা; যে রাষ্ট্রে ধর্মান্ধতার নামে চলে সংখ্যালঘু জবাই; যে রাষ্ট্রে রাষ্ট্রীয় রিজার্ভ চুরি কে উন্নয়ন হিসেবে আখ্যা দিয়ে মশকরা করা হয়; যে রাষ্ট্রে গুম, হত্যা, ধর্ষণের কোন বিচার পাওয়া যায় না, বিচার চাওয়াও যায় না সেই রাষ্ট্র নৈতিকভাবে দেউলিয়া হবে এটাই স্বাভাবিক আর সে রাষ্ট্রের জনগণ “সেক্স এডুকেশন” কে “অশ্লীল” ভেবে বসে থাকবে সেটাও অতি রঞ্জিত কিছু নয়। যে সমাজে “বাচ্চাবাজি”, “শিশুকামিতা”, “পেডোফেলিয়া” কে ধর্মীয় রীতি মানা হয় সে সমাজে “যৌন স্বাধীনতা” এর কথা কল্পনায়ও আনা যায় না। যে সমাজে মেয়ের মাসিক শুরু হওয়ার সাথে সাথে বিয়ের চিন্তায় ধর্মান্ধ গ্রামবাসীর ঘুম হারাম হয় সে সমাজে “যৌন স্বাধীনতা”র কথা বলাও রীতিবিরুদ্ধ। যে সমাজে আভিশাপ হয়ে দৌলদিয়ার যৌনপল্লী সভ্য সমাজ কে বার বার ধিক্কার দেয়, যৌন পল্লীতে বিক্রি হয়ে যাওয়া বারো তের বছরের মেয়েটিকে এখনো খুঁজে বেড়ায় ওর মা, সে সমাজের মানুষের কাছে “সেক্স এডুকেশন” কে পৌছে দিবে ? রাষ্ট্র?
পর্ণসাইট বন্ধ অনেকটা অবাধ অশ্লীলতায় উৎসাহিত করা, “চোগলখোরী যৌনতায়” উস্কানি দেয়া। পর্ণ সাইট বন্ধ হচ্ছে খুব ভালো, তবে জঙ্গলে লুকিয়ে মেয়েদের গোসল দেখা কে থামাবে? বাসে রিক্সায় মেয়েদের বুক দেখা, স্পর্শকাতর জায়গায় টাচ করা কে থামাবে? বোরখা পড়া মেয়েকে ধর্ষণ থেকে কে থামাবে?
অথচ পর্ণ সাইট বন্ধের চেয়ে সেক্স এডুকেশনের উপর জোর দেয়া উচিত। প্রয়োজন শিশুর নৈতিকতাবোধের কাঠামো মজবুতকরণ। ওসব সাইট বন্ধ করে লাভ কি ! দু দিন পরে আবার চালু হয়ে যায়। আর তাই পর্ণসাইট বন্ধের ঘোষণা তাই খানিকটা “প্রাইভেট নুইসেন্স” এর মত শোনায়।
যৌন স্বাধীনতা,সেক্স এডুকেশন এসব শব্দ এইতো মাত্র কিছুদিন আগে পরিচিত হলো। এখনো এদেশের অধিকাংশ মানুষ সেক্স বলতে কেবল বুক ঘষাকেই বোঝে । শাবানা যখন রাজ্জাকের বুক ঘষে ঘষে বলে “দুষ্টু কোথাকার” তখন মনে করে এটাই বুঝি সেক্স।ছেলে মেয়েরা স্কুল, কলেজে গিয়ে বায়োলজি বিদ্যার গুষ্ঠী উদ্ধার করে; পর্ণ দেখে দেখে মনে করে এই হচ্ছে সেক্স। কত রকম যে স্টাইল আর কত নানান কিসেমের নাম!স্বমেহন, এনলারজমেন্ট, পেনিট্রেশন কিভাবে করতে হবে ওসব ছেলে মেয়েরা এখন এমনিতেই বোঝে। পর্ণ সাইটে ঢুঁ মারতে হয় না। আসলেই কি ব্যাপারটি এরকম ? এটাই কি যৌনতা ? এটাই কি সেক্স এডুকেশন? ওরা এটাকেই সেক্স এডুকেশন ধরে নেয়। পর্ণ সাইটে ঢুঁ মারলে ক্ষতি কি আর লাভই বা কি? পর্ণ সাইটে ঢুঁ মারলে নৈতিক অবক্ষয় হবে নাকি নেশা হবে সেটা ছেলেমেয়েদের কে বোঝাবে? রাষ্ট্র ?
ধর্মান্ধতার উর্ধ্বে নৈতিকতার শিক্ষা, সেক্স এডুকেশনের ধারনা জনগণের সামনে তুলে ধরার দায়িত্ব রাষ্ট্রেরই । সেক্স এডুকেশনের সাথে নৈতিকতার ব্যাপার সম্পর্কিত। হঠাৎ রুমে ঢুকে যদি কোন মেয়েকে উলঙ্গ দেখে ফেলেন সেক্ষেত্রে আপনি লজ্জায় চোখ নামাবেন নাকি ঝাপিয়ে ধর্ষণ করবেন সেটাও সেক্স এডুকেশন শিখিয়ে দেয়।সেক্স এডুকেশন মেয়েদের মাসিক নিয়ে কথা বলার সাহস দেয়। মেয়েটি ফার্মেসীতে ন্যাপকিন কিনতে গিয়ে লজ্জা পাবে কিনা, ইমবেরেসিং ফিল করবে কিনা এসব শেখায়। আজ পর্যন্ত কোন মেয়েকে কনডম কিনতে দেখলাম না। প্রকাশ্যে ছেলেরাই যেখানে কনডম কিনতে ইমবেরেসিং ফিল করে সেখানে স্ত্রী তার স্বামীর জন্য কনডম কিনবে সেটা ভাবাই যায় না। সেক্স এডুকেশনের অভাবে মেয়েরা নিজেদের সমস্যার কথা বলতে পারে না। মায়ের কাছে, বাবার কাছে, ভাইয়ের কাছে, দেবরের কাছে, কারো কাছেই না। কর্মজীবী মেয়েরা ছুটি ছাটা নিতে পারে না।মাসিকের সময় তেনা মেনা পেঁচায় নতুবা মিথ্যা বলে ছুটি নেয়, বাসায় শুয়ে থাকে।
মোরালিটির দিক থেকেও সেক্স এডুকেশন মেন্টাল এনরিচমেন্টের ব্যবস্থা করে। কোন মেয়েকে বাসে রিক্সায় রাস্তা ঘাটে চলাফেরায় ইভ-টিজিং করা হবে কিনা এসব শেখায়।কোন মেয়ের মানসিক ও শারীরিকভাবে কখন বিয়ের উপযোগী হয় এসব শেখায়। মাদ্রাসার ছোট ছোট ছেলেগুলো বড় হুজুরদের কাম বাসনা থেকে কীভাবে মুক্তি পাবে এসব শেখায়। কীভাবে এইডস থেকে বাচঁতে হবে সেসব শেখায়। ছেলে মেয়েরা, স্বামী স্ত্রী একে অন্যের প্রতি কতটুকুন শ্রদ্ধাশীল হবে সেসব শেখায়, কাপল থেরাপি নিতে শেখায়। গর্ভকালীন অবস্থায় মেয়েদের যত্ন নেয়া শেখায়। মেয়ে জন্ম নেয়ার জন্য কেবল স্ত্রী দায়ী না সেটা বুঝতে শেখায়। ব্রা, পেন্টি, ন্যাপকিনের উপকারিতা শেখায়, ব্রেস্ট ক্যানসার নিয়ে শেখায়।
আর যৌন স্বাধীনতা সেক্স এডুকশনের একটি প্রশাখা বলা যায়। যৌন স্বাধীনতা ধর্ষণ থেকে বাঁচায়। যৌন আচরণে পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে উৎসাহ দেয়। যৌন স্বাধীনতা মানে অশ্লীলতা নয়, যৌন স্বাধীনতা হচ্ছে অন্যতম জৈব চাহিদা। বিশ্বের কম বেশি সব উন্নত দেশ গুলোতেই যৌন স্বাধীনতা রয়েছে। যৌন স্বাধীনতা যেখানে লালসা থেকে বাঁচায় সেক্স এডুকেশন সেই যৌন স্বাধীনতা কে পবিত্র কাঠামোতে সজ্জিত করে... (চলবে )
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে এপ্রিল, ২০১৬ দুপুর ১২:৩০