মাটির ভেতরে গান
১.
দেহ থেকে ওঠে আসে আর এক দেহ, মাটির ভেতর।
দেখে মৃৎ শোভিতঅঞ্চল, নির্বাপিত সময়ের বাহন একটি গাছ
নিচে বিক্রমাদিত্যের ঘোড়া, পায়ে পায়ে পথের পালন।
বহুদূর চলে গেছে নতুন জাতক, তাই অবসন্ন ধুলোর সংগীত
আছে হাওয়া মাটির ভাঁজ থেকে উঠে আসা গুল্মের প্রবাহ
দেখে দেহের টুকরো হাত মাথা পেট সবই উড্ডীন
আছে শুধু চিহ্ন, ভাষা ব্যবহারের গোথিক প্রচলন।
মৃতের শরীর ভাবে, এককাল শেষ হয়ে মূলমাটিতে আবার
বিবাহের ব্যথা
কন্যা তুমি উৎসারিত কোন গাঙুরের জলে
অভিশপ্ত রাজণ্যের পুত্র আমি, আমার বাসরে সাপ।
২.
আজ বৃষ্টি পড়লো বসন্ত হাওয়ায়
আজ সনাতন নিদ্রায় পীর মৃত্যু
ওড়ে উঁই ওড়ে আলো
পিন্দিয়া সবুজ শাড়ি ওড়ে আসমানি।
ভুঁদোর আমরা অষ্টভাই
ভুঁদোর আমার ভাই নাই।
আমি সঙ্গ নিঃসঙ্গ আমার বংশে বলিদান
জানি এক রক্তধারা আবার একই রক্ত থেকে
বহু প্রাণ পরিক্রমা।
তাই সংজ্ঞাহীন বহুপ্রজ রাস্তা
দেখি রাস্তায় রাস্তায় ভূত ভূতুমের খেলা
খেলা করে বাবু খেলা করে মাঝি
আমাকে মাতার যতো অবহেলা।
৩.
প্রশ্নকারীকে আমার পরিচয় দিই
বলি গোত্র -ভসুয়া বাঙ্গাল আমি,
চিকিৎসালয়ের পাশে আছে শহীদ মিনার।
বলি মাতৃবাংলা আমার সকল অঙ্গ
তথায় নিবাস করে ধানপাটনদীনালা
আমার মাটিতে রক্তজল
আমার মাটিতে খরা
আমার উঠোনে নৃত্য করে ডাকাত নিজাম।
মানুষ চলেছে অইপারে
মানুষ দেখেছে রেলঅতিক্রম
ওরে ও খরার গান
ওরে ও বন্যার গান
আমরা ভুবন মেরে কলাগাছ ধরে
বহিয়া চলেছি বিশ্বপার।
৪.
বধূ আমার অঙ্গ ঝরিয়া গেলো
তবু তোমার সঙ্গ শেষ হয় না।
হাড়ে হাড়ে যদিও বৈশ্বানর ব্যথা
সেথায় তোমার বধূজন্ম, অবয়ব গাথা।
স্বভাব গড়িয়ে যায় ফুল ফুটে যায়
তোমার গহনা থেকে দিকে দিকে
কি সব সম্ভাবনা।
উঠেছে যে মাটি বুকে পিঠে নাভির কিনারে
তাতে সঙ্গঅসঙ্গের অকৃত্রিম স্মৃতি,
আমি টোকা দিই আমি খর্ব হই
কি সহজে খুলে যায় প্রত্নজৈবশীলা।
৫.
দেহটাকে ভেলা করে জলে ভাসালো কে
সঙ্গী নাই সাথী নাই জলে ধরলো কে।
ওমা আমার শতো কন্যা শতো পুত্রের যতন
দেহটাকে ভাগ করে ভেলা করলো কে।
আমার পাতাল পরিক্রমা আমার ক্ষত্রিয় চলা
আমার দিকে দিকে ঘুরে মাছ ও শ্যাওলা।
দিয়েছি ঘরানা আর বলেছি ঠিকানা
সমাহিত দেহঘরে রূপঅরূপের খেলা
সময় চলিয়া যায় সময় পাথর হয়ে যায়
জন্ম জন্ম আমার মাটির প্রমা।
খেয়েছি বিষের ভাণ্ড দুধভাত করে
দেখেছি সাপের নৃত্য জগত সংসার ভরে।
৬.
বলে চিরনিদ্রা বলে চিরশান্তি ঘুম ঘুম চিরনিদ্রা।
প্রকৃতভাবে চিরজাগরণ। এক দাঁড়ানো পৃথিবী
মাঠ ঘাট আলোঅন্ধকার নিয়ে জেগে থাকে অনুপল
বলে স্মৃতিকথা বলে তীর্থযাত্রী, মৌনগাথা।
আমি দিগম্বর আমার কোমর থেকে আলোবাঁশি
আমার শরীর থেকে সাতটি অমরাবতি।
আসে রাধিকা বালিকা কুলবধূ
বলে চিরনিদ্রা চিরনিদ্রা ঘুম ঘুম শান্তি চিরনিদ্রা
আমি বলি জাগরণ সত্য জাগরণ দৃশ্যকলা
এক মানবীর গুল্মলতায় শতেক রাস্তা
আমি পথিক আমার মাথা করেছি উপুড়।
৭.
আজ আমার জগত-বিদ্যালয় বন্ধ
আজ আমি কেবলই ছুটি।
এ কি সংখ্যা শেখালো বোধের শিক্ষক
এ কি বিদ্যা শেখালো মাথার শিক্ষক।
আমার প্রশ্নের ভেতরে করে খেলা শূন্য থেকে শূন্য
আমার প্রশ্নের ভেতর উত্তর হয় শূন্য এবং শূন্য।
আজ আমি নিরুত্তর, প্রশ্নহীন কেবলই ছুটি
কর্মছুটি দৃশ্যছুটি শব্দছুটি ওরে।
কী পত্র দিয়েছে বন্ধুর বোন ওরে
কী কাহিনী শোনাবে বন্ধু, আসামী আমাকে
এসব আমরা অবসরে ভাবি
হাজার বসন্তে করি সঙ্গমের দিনলিপি।
৮.
পুরসভার আলো। নিচু হয়ে পড়েছে ঘাসে।
ঘাস দ্বীপবাসী, জানে ঘনপুঞ্জে নিরবধি গ্রহণের প্রথা
আমাকে উধাও করে চিরসেবা প্রতি জনে জনে
আলো থেকে সরল জননীর মুখ
আলো থেকে পুকুর জলের কথা।
একদিন ঘাস, নিরুত্তর; কারণ ক্রমশ জনসংখ্যা
বেড়ে গেছে নদীর ওপরে। গায়ের ওপরে।
তখন একটি সরীসৃপ ভাবে মৃত্যুগ্রহণকালীন আলো
জ্যোতির্ময়।
৯.
তুমি গৃহে থাকো আমি থাকি পথে,
দেখি রূপের রাখাল যায় শত আয়োজনে।
শব্দ বাঁধে ডেরা বাঁধে চতুস্পদী মাঠে
নিরুপদ্রব পথঘাট এই বৈশাখে
পথে উভলীলা, পথে পৌষ সংক্রান্তির মেলা
পথ থেকে প্রভু পথ গান ধরে শীতে।
আমি ভিক্ষুকের রাজা
আমি থালা হাতে রাজা দশরথ
প্রজার হিত চাই প্রজার প্রহরা
মাগো দাও অন্ন দাও বীজ
রাজা প্রজা মিলেমিশে শীত নদীর গীত।
১০.
আমি অনাড়ম্বর বুদ্ধ। আমি আদি অনাদি
আমার চোখ ভরা ধ্যান।
আমার অশোক গাছে ঝুলে ত্রিজগতের পাখি
আসে সুজাতা, বিমাতা আগমনী বার্তা পাই, পিতা অবতার।
ওরা দীনবেশ, ওরা অচঞ্চল দেহে ধরে অপৌর বীজ
আমি ঊর্ধ্বমুখে থাকি আমার জগতভরা মেঘ।
ওরে ও বৃষের ভাই আমার এখন যোগাযোগ নাই
ওরে ও গাভীর বোন আমার পয়সাকড়ি নাই।
নগর উঠেছে, মহানাগরিক কলা শেখে মানুষের পীড়া
নগর গাইছে, মহাপ্রলয়ের গান শোনে মানুষের পীড়া
আমার মাথায় বটবৃক্ষ
আমার শরীরে মহাবৃক্ষ,
জয় হাওয়ার জয়
জগত ব্যাপিয়া ভাষা মিথ্যা, জাগে শুধু ভয়।
১১.
আমার অনেক আয়ু রয়ে গেছে। যা অনতিক্রম্য
সেই শক্তি পালনে গেছে সরল জীবন।
যেন সকলে পুতুল, পথে পথে শিশুর কাহিনী।
পিতা তুমি অশ্রুতপূর্ব, তবু অধিষ্ঠান করো বাড়ি বাড়ি
আমি যুবক-পুতুল, হা করে রেখেছি ভূলোক।
চিকিৎসা সুস্বাস্থ্য দেবে এমন ডাক্তার নেই
যখনই চেতন-গড়ল নামে মাথার ভেতরে
এক কাপালিক অসুর কেমন করে খায় রক্তমাংস
তখন সমাধি স্থির
গোপনে মাটির ঘরে ভাসানের ইচ্ছা।
১২.
যতো পারো শাস্তি দাও। আমি অনিবার্য, একমাত্র মৃত।
যে ইশারাবলে জন্মলাভে জগত অতিথি,
সে আবার চমৎকার মৃতের জনক।
আছি দিনরাত্রি, পুর আলো, জনসংঘে,
অনুজ্জ্বল মাটির আলো আকাশে আকাশে।
যে আকাঙক্ষা নির্বাপিত, প্রাণ হারানোর বিনিময়ে
সেসব অনেক জন্ম রাখি অন্য জনের নামে।
সে এখন নতুন জাতক, ঘুরে মাতৃকুলে
তখন আমার আমি আছি সকল মানবে।
'পলাশী ও পানিপথ(২০০৯)' থেকে