লেখার সাথে যুক্ত হবো, এরকম কোন স্বপ্ন-চিন্তা ছিলোনা কোনওদিন। না আমার-না আমার বাবা-মায়ের। তবে আকারে ইঙ্গিতে আব্বার সুপ্ত একটা ইচ্ছের কথা জানা গিয়েছিলো- তাঁর ছেলে বক্তব্য দেবে আর মাঠভরা মানুষ, অডিয়েন্সজোড়া শ্রোতা তা মুগ্ধ হয়ে শুনবে। বিভিন্ন সামাজিক কাজে নেতৃত্ব দেবে।
সেটাতো হয়ই-নি, আমি বরং স্বস্তি পাই পর্দার পেছনে থেকে যে কাজগুলো করা যায় নিভৃতে, সেগুলোতে। সে ধারাতেই কিভাবে কিভাবে যেনো লেখাটাই ভালো লাগতে থাকে। যদ্দুর মনে পড়ে, সৈয়দ আবুল মকসুদের সহজিয়া কড়চা আমাকে গদ্য লেখায় প্রবলভাবে আকৃষ্ট করেছে। চলমান সামাজিক কঠিন বিষয় নিয়ে গদ্য লেখায়ও যে উইট তৈরী করা যায় নিরবে; সহজিয়া কড়চা পড়ে আমার সবসময় এটাই মনে পড়তো।
হুমায়ূন আহমেদ একটা বই উৎসর্গ করেছিলেন প্রখ্যাত আইনজীবি গাজী শামসুর রহমানকে। কোন বইটা আমার মনে পড়ছে না, কিন্তু বইয়ের উৎসর্গপত্রটা মনে আছে হুমায়ূনীয় বৈশিষ্ট্যের কারণে। হুমায়ূন লিখেছিলেন- গাজী শামসুর রহমান, যিনি নিজে চোখ বুজে থাকেন কিন্তু সবাইকে বাধ্য করেন চোখ খোলা রাখতে। বিষয়টা হলো- আইনজীবি হিসেবে গাজী শামসুর রহমান অত্যন্ত প্রভাবশালী ও কার্যকর ছিলেন। আদালতে তাঁর তীক্ষ্ণধার যুক্তির সামনে প্রতিপক্ষের আইনজীবি অসহায় হয়ে যেতেন। গাজী শামসুর রহমান যখন হেয়ারিংয়ে এসব যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করতেন, তখন অভ্যাসবশত চোখ কিছুটা বন্ধ করে থাকতেন। কিন্তু তাঁর কথার ওজন এবং গুরুত্বের কারণে বাকি সবাই উদগ্রীব হয়ে তাঁর কথা শুনতে বাধ্য হতেন। চোখ বন্ধ করার চিন্তাও করতে পারতেন না।
সহজিয়া কড়চার সৈয়দ আবুল মকসুদকে পড়ে এবং তাঁর ব্যক্তিগত জীবনাচরণের সাথে পরিচিত হয়ে আমার আইনজীবি গাজী শামসুর রহমান সম্পর্কে হুমায়ূন এর ওই উৎসর্গপত্রটাই মনে পড়লো। ইনিও সর্বাঙ্গে সাদা কাপড় জড়িয়ে মৌনঋষির ভূমিকায় অতি সাধারণ জীবনযাপন করেছেন, অথচ সমাজের জটিলতম বিষয়গুলোকে এমন সহজ, ধীরস্থির ও রসাত্মকভাবে লিখে গেছেন যে পাঠক তা পড়ে কোনওভাবেই মৌন থাকার সুযোগ পায়নি। বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা জয়ের পর অতি উচ্ছাসের সময়ে তিনি একটা কলামে লিখেছিলেন- ‘মৎসপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’- যেটাকে অসাধারণ বললেও কম বলা হয়।
কদিন আগেই ব্লগার ভুয়া মফিজ স্যাটায়ার নিয়ে একটা পোস্টে উইটের সাথে কনটেক্সট বোঝার গুরুত্ব নিয়ে লিখেছিলেন। আমার মনে হয়- এই যায়গাটায় সৈয়দ আবুল মকসুদ অপ্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন। যেকোনো লেখায় সমসাময়িকতার সাথে তিনি ইতিহাস, সমাজ, রাজনীতি ও সংস্কৃতিকে নিজস্ব ঢংয়ে এমনভাবে মেশাতেন, যে কনটেক্সট-টা ধরতে পারার সাথে সাথে ভুয়া মফিজ এর লেখা অনুযায়ী পাঠকের কাছে তা ‘অনন্য’ হয়ে ধরা পড়তো।
সহজিয়া কড়চা পড়লেই আমার সক্রেটিসের কথা মনে পড়তো; চোখে একটা ছবি ভাসতো- একজন মুনী ধ্যানমগ্ন হয়ে গল্প বলে যাচ্ছেন আর তাঁর সামনে বসা ভক্তবৃন্দ তন্ময় হয়ে সে গল্প শুনছে।
আজ হঠাৎই সে ছবিটা ভেঙে গেল। সকালে প্রথম আলোতে দেখি, সৈয়দ আবুল মকসুদ গত হয়েছেন। ব্যক্তিগতভাবে এই মানুষটার সাথে আমার কোনও সংশ্লেষ নেই। এক দুবার সামনে দেখেছি হয়তো। কিন্তু তাঁর লেখার মাধ্যমে আমি অনুপ্রাণিত ছিলাম, সবসময় চাইতাম তাঁর মত লিখতে। আমার অনেক লেখাতেই তাঁর ছাঁয়া আছে।
করোনা আমাদের কাছ থেকে অনেককেই কেঁড়ে নিয়ে গেলো। প্রকৃতির নিয়মে সবাইকেই যেতে হবে। আবার প্রকৃতিও নিজ নিয়মেই শুন্যস্থান পূরণ করে ফেলবে। তবুও কিছু কিছু স্থান শুন্যই থেকে যাবে ইতিহাস হয়ে।
অফিসে-বাসায় যুগপৎ ব্যস্ততা আমাকে ব্লগ থেকে দূরে রেখেছে। কিন্তু সৈয়দ আবুল মকসুদ এর মৃত্যু আমাকে আবেগাক্রান্ত করে ফেলেছে। হয়তো বিভিন্ন মতের ক্ষেত্রে আমি তাঁর সাথে একমত নই, তবুও চিন্তাশীল এই মানুষটি আমার অতি পছন্দের একজন লেখক ছিলেন।
ঋষি সৈয়দ আবুল মকসুদ, শান্তিতে থাকুন।
ফটোগ্রাফার অনির্বাণ অনির তোলা ছবিটা নেয়া হয়েছে উইকি থেকে।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২১ সকাল ১১:১৫